
ভোররাতে আকাশে যখন মেঘের চাদর, চারপাশে নিস্তব্ধতা, তখন জামালপুরের কোনো এক গ্রামের রান্নাঘরে শুরু হয় ব্যস্ততা। আগের দিন সন্ধ্যায় জবাই করা হয় গরু বা মহিষ। হাঁড়িতে গমগম করে ওঠে চালের গুঁড়া আর মাংসের অপূর্ব সংমিশ্রণ। এই সব আয়োজন একটিই উদ্দেশ্যে— ভোরের দোয়া শেষে পিঠালি পরিবেশন। এক বাটির এই খাবারে যেন মিশে থাকে পুরো এক জনপদের শোক, শ্রদ্ধা, সম্পর্ক আর স্মৃতি।
সারারাত রান্নার ধোঁয়ার মাঝে জেগে থাকে পুরো বাড়ি। বড় যেহতের (চল্লিশা বা ‘যেহত’) আয়োজন মানেই আলাদা প্রস্তুতি। আগের দিনই আশপাশের গ্রাম থেকে লোকজন আসেন কেউ সহায়তা করতে, কেউ রান্নার কাজে। উঠোনে জবাই হয় এক বা একাধিক গরু-মহিষ। তারপর সারারাত ধরে চলে চুলার জ্বাল, হাঁড়ির নাড়া, মশলার ঘ্রাণ— এক উৎসবমুখর প্রস্তুতির আবহ।
ভোরবেলা বিশেষ মোনাজাতের পর পরিবেশন হয় পিঠালি। আলেম-ওলামা, হাফেজ, পীর-মুরিদ, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী— সবাই একত্র হন এই তবারকের খাতিরে। কোরআন তেলাওয়াত আর মোনাজাত শেষে শুরু হয় সেই অনন্য পিঠালির মহোৎসব। কেউ খান নীরবে, কেউ স্মৃতিমেদুর হয়ে।
এই পিঠালি শুধু একটি রান্না নয়— এটি একটি অনুভব, সম্পর্ক জাগানোর আয়োজন। মৃতের ঘর আবার ভরে ওঠে মানুষের পদচারণায়। যারা কখনো আসেননি, তারাও চলে আসেন এই দাওয়াতে। কলাপাতা বা ওয়ান টাইম প্লেটেই পরিবেশন হয়, কিন্তু সম্পর্কের গভীরতা থাকে অসীম।
আজকাল পিঠালি শুধুমাত্র যেহতে নয়— পিকনিক, মিলাদ, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এক বিশেষ খাবার হিসেবেও স্থান করে নিচ্ছে। এটি এখন ঐতিহ্য আর ভালোবাসার স্বাদমাখা এক রান্না।
জামালপুর ছাড়িয়ে পিঠালির সুবাস ছড়াচ্ছে শেরপুর, কুড়িগ্রাম, বগুড়া, এমনকি দেশের বাইরেও। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, আমেরিকায় বসবাসকারী প্রবাসী জামালপুরবাসীরাও এই খাবার দিয়ে আয়োজন করছেন যেহতের। চালের গুঁড়া থেকে মসলা, সবকিছু সংগ্রহ করে বিদেশে বানিয়ে নিচ্ছেন সেই শেকড়ের স্বাদ।
পিঠালির স্বাদ একপ্রকার নিরব ইতিহাস— দেখতে হালিমের মতো হলেও স্বাদে আলাদা। চালের গুঁড়ার ঘনত্ব, মাংসের কোমলতা আর বাহারি মসলার গন্ধে এক অনন্যতা এনে দেয় এই খাবারে। মসুর ডাল ব্যবহার হয় না, বরং অন্য উপকরণেই তৈরি হয় ঘনত্ব।
পিঠালি এখন শুধু শোকের রান্না নয়, এটি এখন ভালোবাসার ভাষা। মোনাজাত শেষে পরিবেশিত এই খাবার যেমন মুখে বসে, তেমনি বসে হৃদয়ে। ঐতিহ্য, সম্পর্ক আর শেকড়ের টানে যে রান্না জন্ম নেয়, তার নাম পিঠালি— জামালপুরের গর্ব, এখন বাংলাদেশের ও প্রবাসের ভালোবাসা।
পিঠালি এখন আর শুধুই রান্না নয়, এটি এক নিঃশব্দ সংলাপ— চালের গুঁড়ায় লেখা এক চিরন্তন ভালোবাসার চিঠি।
নুসরাত