
চলতি বছর হজের কার্যক্রম সম্পন্ন করে ১০ জুন ৩৬৯ হাজি নিয়ে সকাল ১০টা ৫৪ মিনিটে সৌদি এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট এসভি-৩৮০৩ ঢাকায় নিরাপদে অবতরণ করে। মূলধারার গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাজিরা সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, যা বিগত বছরগুলোতে তেমন একটা দেখা যায়নি। সুষ্ঠু হজ ব্যবস্থাপনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের সব নীতিনির্ধারকরা অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। আগামী দিনে আরও সুন্দর ও সুচারু ব্যবস্থাপনার জন্য এখান থেকে শিক্ষা নিতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতি বছর প্রায় ২৫ লাখ মানুষ হজ পালন করেন। সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যে কোনো দেশের প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ১ হাজার ব্যক্তি হজে যেতে পারবেন। চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন পবিত্র হজ পালন করতে সৌদি আরবে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছেন।
হজ পালন আল্লাহর প্রতি বান্দার অকৃত্রিম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। আর সম্পদশালী, সচ্ছল ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবানদের জন্য জীবনে একবার হজ করা ফরজ। সারা বিশ্ব থেকে পবিত্র নগরী মক্কায় অর্থ ব্যয় করে হাজির হওয়ার মাধ্যমেই হজ পালন করতে হয়। পবিত্র নগরী মক্কায় আসা এবং এখানের আচার-অনুষ্ঠান সম্পাদন, ভ্রমণ ইত্যাদি কার্যক্রমের মধ্যেই শুধু হজের উদ্দেশ্য শেষ হয়ে যায় না বরং হজ পরবর্তী সময়েও রয়েছে তাদের জন্য বিশেষ জীবন-যাপন ও আমলি জিন্দেগি। বাংলাদেশ থেকে সাধারণত বৃদ্ধ বয়সের মানুষ জীবনের শেষ সময়ে এসে হজব্রত পালন করেন। ইদানীং কমবয়সীরাও হজে যাচ্ছেন। এর কারণ হলো চাকরি জীবন শেষ করে প্রাপ্ত অবসরভাতা কিংবা গুটি গুটি করে জমানো টাকা অথবা পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত জমি বিক্রি করে আল্লাহর ঘর কাবা জিয়ারত ও হজের উদ্দেশে গমন। আমাদের অধিকাংশ হাজি সাহেবদের চিত্র এমন। কালিমা, নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত হলো ইসলামের পঞ্চস্থম্ভ। প্রতিটি ইবাদতের রয়েছে বাহ্যিক ও অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক দর্শন।
পৃথিবীর নানা ভৌগোলিক প্রান্ত থেকে লাখ লাখ টাকা খরচ করে দুই মিলিয়নের অধিক মুসলিম নর-নারী হজের যে আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন তা কেবল শ্বেতশুভ্র বসনের তীর্থযাত্রা নয়। এর রয়েছে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও বৈশ্বিক অনন্য আবেদন। শুধু সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের জন্য জীবনে একবার হজ করা ফরজ। লাখ লাখ টাকা খরচ করে হজ আদায় করে দেশে ফেরার পর অনেক হাজি এক ধরনের ধোঁয়াশার মধ্যে থাকেন। এখন কী করবেন, কী করবেন না। হজ ফেরত ধোঁয়াশার কালো মেঘ সরাতে আজকের নিম্নোক্ত আলোচনা। কাব বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন কোনো সফর থেকে ফিরে আসতেন, তখন মসজিদে (নফল) নামাজ আদায় করতেন। (বুখারি, হাদিস নং ৪৬৭৭)
তাই হজ থেকে ফিরে এসে বাসার কাছে নিকটস্থ মসজিদে দুই রাকাত শুকরিয়া সালাত আদায় করা সুন্নাত। হজ থেকে ফিরে আখিরাতের প্রস্তুতি নিতে হবে। হজের সফর আখিরাতের কথা মনে করিয়ে দেয়, ইহরামের সাদা কাপড় কবরের যাত্রা পথে কাফনের পরিচয় বহন করে। আমাদের পরকালীন সফরে অনেকগুলো স্টেশন রয়েছে। মৃত্যু, কবর, বারজাখ, হাশর, পুলসিরাত, জাহান্নাম ও জান্নাতের মতো অনেকগুলো স্টেশন ও একমাত্র গন্তব্য রয়েছে। সাদা চোখে দেখলে আমরা বুঝতে পারি, হজের প্রতিটি ধাপ মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের সঙ্গে সাজুজ্জপূর্ণ। আরাফাতের ময়দানে সমবেত হওয়া কেয়ামতের ময়দানে সমবেত হওয়ার কথা মনে করিয়ে পুনরুত্থানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বিশ্ব মানবতার মহান মুক্তিদূত, মানব জাতির মহান শিক্ষক নবী মুহাম্মদ সা. আল্লাহর নির্দেশে মানুষকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। পবিত্র মক্কা-মদিনা, মিনা, আরাফাত, মুজদালিফা থেকে ফিরে নিম্নোক্ত আমলগুলো একজন হাজি সাহেব করতে পারেন। হজ থেকে ফিরে একজন হাজি সাহেবের প্রধান কর্তব্য হলো, তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দেওয়া। এটি হজের অন্যতম প্রধান শিক্ষা। এ বিষয়টি হাজিগণ মাথায় রেখে পথ চলবেন। মহান আল্লাহর নিরঙ্কুশ একত্ববাদের আলোকে নিজের ও পরিবারের জীবন গঠনে অনন্য ভূমিকা রাখবেন। শুধু তাই নয়, আল্লাহর প্রদত্ত ও রাসুল (সা.) প্রদর্শিত বিধান মোতাবেক সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে আপোসহীন ভূমিকা রাখবেন। আল্লাহ সুবহানাহু অতা’য়ালা পবিত্র। কুরআনের সুরা তাওবার ৩নং আয়াতে ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে মহান হজের দিন মানুষের প্রতি (বিশেষ) বার্তা হলো, আল্লাহর সঙ্গে অংশীবাদীদের কোনো সম্পর্ক নেই এবং তাঁর রাসুলের সঙ্গেও নেই।’
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ করে আর তাতে কোনো ধরনের পাপাচারে লিপ্ত হয় না, সে সদ্য ভূমিষ্ঠ নবজাতকের মতো নিষ্পাপ হয়ে (হজ থেকে) ফিরে আসে।’ (বুখারি, হাদিস নং ১৪২৪)। রাসুল (সা.) কর্তৃক পাপমুক্তির সনদ পেয়ে উল্লসিত হলে চলবে না। পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত পরিশুদ্ধ জীবন যাপনের শপথ নিতে হবে পুণ্যার্থীদের। নিজের জীবনের শুদ্ধতার সঙ্গে অন্যের জীবনকে আলোকিত করতে প্রয়াস পেতে হবে। জাবের বিন আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মদিনায় এসেছেন, তখন একটি গরু জবাইয়ের নির্দেশ দেন। জবাইয়ের পর সাহাবিরা তা থেকে আহার করেছেন। (বুখারি, হাদিস নং ৩০৮৯)
হজ করে কা’বা জিয়ারত করে বিদায়ী তাওয়াফ শেষে হাজিগণ নিজ গৃহে ফেরেন। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আল্লাহর ঘরের মেহমানদের অভ্যর্থনা জানিয়ে দোয়া নিতে আসেন। হাজিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মোসাফাহা ও কোলাকুলি করা এবং তাদের দিয়ে দোয়া করানো মুস্তাহাব। কিন্তু আমাদের সমাজে এক শ্রেণির অতি আবেগী মুসলমান ফুলের মালা ও হাজিদের সম্মানে নাম উল্লেখ করে সেøাগান দেয়, এসব কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত। এগুলো সীমা লঙ্ঘনের অন্তর্ভুক্ত। হজ থেকে ফিরে আললাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ গরিব-মিসকিন, অসহায়, এতিম ও আত্মীয়-স্বজনকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় এই খাবারকে ‘নকিয়াহ’ বলা হয়। তবে কোনো অবস্থাতেই বিশেষ উদ্দেশ্য সামনে রেখে, অহংবোধ, কিংবা দম্ভোক্তি থেকে লোক দেখানো দাওয়াত ও মেহমানদারি ইসলাম অনুমোদন দেয় না।
মুয়াল্লিমুল হুজ্জাজ গ্রন্থের ৩০৩-পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, জমজমের পানি অসুস্থ রোগীদের গায়ে ব্যবহার করা উত্তম। জমজমের পানি অন্য শহরে নিয়ে গিয়ে লোকদের পান করানো মুস্তাহাব। অন্যদিকে তিরমিজি শরীফের ১১৫ নং হাদিসে হজরত আয়শা (রা.) বলেছেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) জমজমের পানি সঙ্গে নিয়ে যেতেন।’ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে হাদিয়া-তোহফা দেওয়া সুন্নত। মুকাম্মাল মুদাল্লাল মাসায়েলে হজ ও ওমরাহ গ্রন্থের ৩২১-পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, নিজের নামের সঙ্গে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে হাজি বা আলহাজ ব্যবহার করা কিংবা কেউ এই বিশেষণ বর্জন করায় মনঃক্ষণ্ন হওয়া গর্হিত কাজ। লোকে আলহাজ কিংবা হাজি সাহেব বলে সম্বোধন করবে, হৃদয়ে এমন তামান্না পোষণ করা শিরকের পর্যায়ে চলে যাবে। তাই হাজি সাহেবকে সাবধান থাকতে হবে। তবে হ্যাঁ, মানুষ যদি সম্মান করে নামের আগে আলহাজ্ব লেখেন অথবা ‘হাজি সাহেব’ বলে ডাকেন তাতে দোষের কিছু নেই। তবে নিজের মনে যাতে কোনো ধরনের অহংবোধের জন্ম না নেয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে হাজি সাহেবকে। কারণ এ সময় শয়তান ওয়াছওয়াছা দেওয়ার জন্য সদা সজাগ থাকবে।
হজের পর গুনাহমুক্ত জীবন-যাপনই হলো হজ কবুল হওয়ার লক্ষণ। হজ শেষে দেশে এসে হাজিদের উচিত আল্লাহর বিধি-বিধান পালনের প্রতি যথাযথ নিবিড় মনোযোগ দেওয়া। হজ পরবর্তী জীবনে হাজিরা ভালো কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবেন। পাপের কাজ থেকে দূরে থাকবেন। সমাজের প্রতিটি ভালো কাজে অংশগ্রহণ করবেন। অন্যায় প্রতিরোধে রাসুল (সা.) নির্দেশিত পথে বিরামহীন সাধনা চালিয়ে যাবেন। নিজে যেমন অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকবেন, অন্যকেও বিরত রাখার চেষ্টা করবেন। আর হজ পালনকারীরা আল্লাহর মেহমান। তারা অনেক কষ্ট করে শারীরিক ও আর্থিক এই ইবাদত সম্পাদন করেছেন। তাদের উদ্দেশ্যে হজ-পরবর্তী করণীয় ও দিকনির্দেশনা দিয়ে মহান আল্লাহ আয়াত নাজিল করেন। হজ পালনকারীদের বাকি জীবনের করণীয় সম্পর্কে মহান আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে সুরা বাকারায় ২০০ নং আয়াতে বলেছেন- ‘অতঃপর যখন তোমরা হজের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে নেবে, তখন মিনায় এমনভাবে আল্লাহকে (জিকির) স্মরণ করবে, যেমন জাহেলি যুগে তোমরা তোমাদের পিতৃপুরুষগণকে স্মরণ করতে অথবা তার চেয়েও বেশি গভীরভাবে (স্মরণ করবে)। এমন কিছু লোক আছে যারা বলে- হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়াতে (সাওয়াব) দান কর। মূলত তাদের জন্য পরকালে (কল্যাণের) কোনো অংশ নেই।’ হজ-পরবর্তী জীবনে নতুন করে আর কোনো ইচ্ছাকৃত সগীরাহ কিংবা কবিরাহ গুনাহে সম্পৃক্ত হওয়া যাবে না। তবে ভুলে কোন গুনাহ করে ফেললে, আল্লাহ রহমানুর রহিম, তিনি তা ক্ষমা করে দেবেন।
লেখক : সাংবাদিক