
সম্প্রতি বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে রেখে সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদ পুনরুজ্জীবিত করে ৫০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে বলেছে, সংসদে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ছিল একটি ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আইন’। গত বছর ২০ অক্টোবর আপিল বিভাগের রায়ের রিভিউ আবেদন (পুনর্বিবেচনা) নিষ্পত্তি করে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে এ রায় দেন। এই রায়ে দেওয়ানি রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি করার মাধ্যমে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত রায়ে বিচারপতিগণ বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়বস্তু কী ছিল? এটি ছিল কর্তৃত্ববাদী ও ফ্যাসিবাদী শাসকের পক্ষ থেকে একটি স্পষ্ট প্রয়াস, যেখানে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থেকে কেড়ে নিয়ে সংসদের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকেই হুমকির মুখে ফেলা হয়েছিল।’ রায়ে বলা হয়েছে, ‘পর্যবেক্ষণসহ মামলাটি নিষ্পত্তি করা হলো। আনন্দের বিষয়, অত্র রায়ে ছয় বিচারপতি পৃথক পৃথকভাবে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, যা আগামীর বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় অনিন্দ্য ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস। শুনানির দিন আদালতে অ্যামিকাস কিউরি, রাষ্ট্রের অ্যাটর্নিগণ এবং রিটকারী জ্যেষ্ঠ আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, বিচারপতিদের উচিত বিচারিক কাজে রাজনৈতিক বিতর্কে না জড়ানো। কারণ, এমন মন্তব্য বিচারকের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করতে পারে এবং তিনি তীব্র সমালোচনার মুখেও পড়তে পারেন। বিচারকদেরও উচিত রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ না করা। কারণ, এতে বিচারব্যবস্থার সুনাম ও স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আস্থার জায়গাটা নষ্ট হবে। প্রধান বিচারপতি রায়ে বলেন, সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সম্পূর্ণরূপে পুনরুজ্জীবিত করা হলো। এই রিভিউ আবেদন উপরোক্ত পর্যবেক্ষণের সঙ্গে নিষ্পত্তি করা হয়েছে। তবে যে কোনো বিভ্রান্তি দূর করার জন্য এবং বিতর্কিত রায়ের কার্যকরী অংশের কার্যকারিতায় প্রয়োজনে অস্পষ্টতা এবং বিরোধ দূর করার জন্য, ৯৬ অনুচ্ছেদের ২-৮ ধারাগুলো সম্পূর্ণরূপে পুনর্বহাল করার ঘোষণা করা হলো।
ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস করে। এতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ফিরে পায় রাজনৈতিক শক্তি। একই বছর ২২ সেপ্টেম্বর গেজেট বের হয়। পরে সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ৯ আইনজীবী। প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর কল দেয়। কলে ওই সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে ২০১৭ সালের ৮ মে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়। সব মিলিয়ে ১১ দিন রাষ্ট্র ও রিট আবেদনকারীর বক্তব্য শোনেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকগণ। এ রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা কলুষমুক্ত হওয়ায় বিচারকগণ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন। নাগরিকদের ন্যায়বিচারের পথ আগামী দিনে সুগম হবে, এমনটি আশা করাই যায়।
প্যানেল