
.
রাষ্ট্রের পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে সমতার ভিত্তিতে এগিয়ে নিতে কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতেই কোটা ব্যবস্থার প্রচলন। এজন্য জেলা কোটা, নারী কোটা, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটা এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটা নির্দিষ্ট করা হয়। ব্রিটিশ ভারতের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও স্বাধীনতার পরপরই চালু হয় কোটা ব্যবস্থা। সে লক্ষ্যে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ২০ শতাংশ পদে মেধার ভিত্তিতে এবং বাকি ৮০ শতাংশ পদে কোটায় নিয়োগ হতো।
পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ২০ শতাংশ বাড়িয়ে ৪০ শতাংশে উন্নীত করা হয়। ১৯৮৫ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে আরও ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়ম চালু করা হয়। বাকি ৫৫ শতাংশ অগ্রাধিকার কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয়। অগ্রাধিকার কোটার মধ্যে রয়েছে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা ও ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী। পরে ১ শতাংশ পদ প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের জন্য নির্ধারিত করায় মোট কোটা দাঁড়ায় ৫৬ শতাংশে। এখানে উল্লেখ্য, খুঁজে কোটায় পূরণযোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে ১ শতাংশ পদে প্রতিবন্ধী নিয়োগের বিধানটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছিল, যা পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং তারপর নাতি-নাতনিদের জন্যও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
২০১৮ সালের আগ পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে নিয়োগের এই বিধান (কোটায় ৫৬ শতাংশ) ছিল। অবশ্য এই হিসাবটি ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডের (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) সরকারি চাকরির জন্য প্রযোজ্য ছিল। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ২০১৮ সালে সরকার কোটা বাতিল করলেও সম্প্রতি হাইকোর্টের এক রায় মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল করে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি (জুলাই, ২০২৪ সাল) শিক্ষার্থীরা আবার কোটা সংস্কার (বৈষম্যবিরোধী) আন্দোলনের ফলে সরকার (সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে) নতুন কোটা পদ্ধতির প্রজ্ঞাপন ২০২৪ জারি করে। বর্তমানে কোটা ব্যবস্থাকে ৫৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশে আনা হয়েছে। যেখানে সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ কর্পোরেশনগুলোতেও সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে ৯-২০ গ্রেডের সকল নিয়োগে ৭ শতাংশ কোটা অনুসরণ করা হবে এবং অবশিষ্টাংশ ৯৩ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ করা হবে। ৭ শতাংশ কোটার মধ্যে ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য রাখা হয়েছে এবং ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী ও ৩য় লিঙ্গের মানুষের জন্য এবং ১ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য রাখা হয়েছে। এখানে নারী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের কোটা ও জেলা কোটাও বাতিল করা হয়েছে। নতুন কোটার প্রচলন ২০২৪ সালের জুলাইয়ের ২৩ তারিখ থেকে কার্যকর, যা নবম থেকে ২০তম গ্রেডে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবর্ষ ভর্তির সময় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মুক্তিযোদ্ধার সন্তান/নাতি-নাতনিসহ বিভিন্ন অনগ্রসর কোটায় ভর্তির প্রচলন আছে। আমি এখানে কর্মরত এবং দীর্ঘদিন যাবৎ ভর্তি সংক্রান্ত কাজে জড়িত আছি। সেই আলোকে বিভিন্ন কোটায় ভর্তির হিসাবটি পাঠকদের বোঝাতে চেষ্টা করছি। এখানে আনুমানিক ১৮৫০টি আসনের বিপরীতে প্রায় তিন লক্ষাধিক শিক্ষার্থী আবেদন করে একটি নির্দিষ্ট নম্বরের ভিত্তিতে।
শুরুতে ভর্তির বিজ্ঞাপনে কোনো কোটার কথা উল্লেখ থাকে না। অনলাইনে আবেদন ফরমটিতে নির্দিষ্ট নম্বরের শর্তগুলো দেওয়া থাকে। ফলে যোগ্যতার কম থাকলে কেউই আবেদন করতে পারে না (সফটওয়্যার সেটি একসেপ্ট করে না)। সুতরাং ওই নির্দিষ্ট নম্বর না থাকলে কোনো মুক্তিযোদ্ধার সন্তান/নাতি-নাতনি কিংবা অনগ্রসর কোনো শিক্ষার্থী, এমনকি একজন সাধারণ শিক্ষার্থীও আবেদন করতে পারে না। অতঃপর লিখিত পরীক্ষা এবং এসএসসি ও এইসএসসি পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট আসনের দশগুণ (১৮৫০০) শিক্ষার্থীকে প্রাথমিকভাবে উত্তীর্ণ করা হয়। এখানে উল্লেখ্য, প্রথম স্থান অর্জনকারী এবং ১৮৫০০তম স্থানের শিক্ষার্থীর নম্বরের মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যবধান থাকে মাত্র ৮-১০ নম্বর, অর্থাৎ, যদি প্রথম স্থান অর্জনকারী শিক্ষার্থী পায় ৯০ নম্বর তাহলে সবশেষে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীর নম্বর হয় ৮০ (সামান্য কম-বেশি হতে পারে)। এই পরিমাণ নম্বর পেয়েই সাধারণ ও বিভিন্ন কোটার শিক্ষার্থীরা থাকে ভর্তির অপেক্ষায়। পরবর্তীতে তাদের মূল সনদসহ সরাসরি সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়। তাদের উপস্থিতির ভিত্তিতে চূড়ান্ত মেধা তালিকা প্রণয়ন ও ভর্তির জন্য ডাকা হয়।
প্রথম মেধা তালিকা থেকে ভর্তি চলাকালেই বিভিন্ন কোটায় ভর্তির প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। তবে এসব শিক্ষার্থীকে অবশ্যই ন্যূনতম পাস নম্বর (৩৩ শতাংশ, এটাই হচ্ছে কোটায় আবেদনকারী শিক্ষার্থীর সুবিধা) পেয়ে উত্তীর্ণ হতে হয়। সে যে বিষয়ে ভর্তি হতে চায় সেই বিষয়েও ন্যূনতম মার্কস থাকতে হবে। অতঃপর নিজ নিজ কোটার সনদসহ নতুন আরেকটি অনলাইন ফরমে তাকে আবেদন করতে হয়। সংশ্লিষ্ট কোটার মূল সনদ, শিক্ষাসনদ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য পরবর্তীতে তাকে সাক্ষাৎকারে ডাকা হয়। এখানেও দেখা যায় শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রায় ১২০০টি আবেদন জমা পড়ে। অতঃপর মুক্তিযোদ্ধা কোটার ক্ষেত্রে প্রতি বিষয়ে চারজন সন্তান/নাতি-নাতনিকে (২ জন ছেলে, ২ জন মেয়ে) তাদের নম্বরের ভিত্তিতে চূড়ান্ত করা হয়। অন্যান্য কোটার ক্ষেত্রেও একইভাবে তাদের মেধার ভিত্তিতে চূড়ান্ত তালিকা করা হয়। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও একই পদ্ধতিতে হিসাবটি হওয়ার কথা।
এবার আসি চাকরির ক্ষেত্রে। বিসিএস পরীক্ষায় লাখ লাখ আবেদনকারীকে একটি যোগ্যতার মাপে আবেদন করতে হয়। এরপর প্রথমে তাদের বসতে হয় প্রিলিমিনারি পরীক্ষায়। বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, ৪-৫ লাখ আবেদনকারীর মধ্য থেকে মাত্র হাজার বিশেক প্রার্থী প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হয়। পরবর্তীতে এরা ২০০ নম্বরে লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এবং এখান থেকে মাত্র ৫-৭ হাজার প্রার্থী উত্তীর্ণ হয়।
এদের নিয়ে মৌখিক পরীক্ষার আয়োজন করা হয়। যেখানে প্রতিটি বোর্ডে একজন সম্মানিত বিজ্ঞ সদস্যের নেতৃত্বে আরও ৫ জন বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী বিশেষজ্ঞ থাকেন। বুদ্ধিমত্তা, দক্ষতা এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে শূন্য পদের বিপরীতে নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রার্থী বাছাই করা হয়। এরপর পদায়নের সময় মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য কোটার প্রার্থী নির্বাচন করা হয়। অর্থাৎ, বিশাল একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার অনেক ধাপ পেরিয়েই কোটার প্রার্থী ঠিক করা হয়। সরকারিসহ অন্যান্য নন-ক্যাডার পরীক্ষায়ও একইভাবে অনুসরণ করা হয় কোটা পদ্ধতি। মোটকথা, মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রার্থী হলেই বিনা প্রতিযোগিতায় তারা চাকরি পায় কিংবা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে তা নয়। ওপরের হিসাব থেকেও বিষয়টি প্রতীয়মান হলো। বিগত বছরের পরিসংখ্যান থেকেও সেটি প্রমাণিত।
অর্থাৎ, মেধাকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে সব সময়। বর্তমানে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রার্থী আছে কিনা সেটাই দেখার বিষয়। তবে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে কেউ যেন এই সুযোগটিকে বিতর্কিত করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রকৃতপক্ষে গ্রহণযোগ্য কোটা সংস্কারে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এদেশের জনগণ ছিল এবং আছে। সরকারও এক্ষেত্রে কোনো দ্বিমত পোষণ করেনি। তাই সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে আমলে নিয়ে এবং উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে অত্যন্ত যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য সমাধান দিয়েছে, যা এ বছর থেকেই চাকরি প্রত্যাশীরা ভোগ করতে পারবেন।
লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়