
ছবিঃ সংগৃহীত
২০২৪ সালের জন্য বেইডৌ স্যাটেলাইট নেভিগেশন সিস্টেমের তথ্য প্রকাশ করেছে চীন। শুনতে সাধারণ প্রযুক্তিগত প্রতিবেদন মনে হলেও, এর গভীরে লুকিয়ে আছে একটি দেশের ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার দিকচিহ্ন—মাত্র দুই দশকে তারা নির্মাণ করেছে জিপিএসের একটি নির্ভরযোগ্য বিকল্প!
বেইডৌ যাত্রা শুরু করেছিল ১৯৯০-এর দশকে একটি সামরিক প্রকল্প হিসেবে। কিন্তু এখন এটি চীনের প্রযুক্তিগত ও কূটনৈতিক কৌশলের কেন্দ্রবিন্দু। জাতিসংঘ (UN) ইতিমধ্যেই এটিকে একটি বৈশ্বিক নেভিগেশন সেবা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
আর বিস্ময়কর ব্যাপার হলো—চীন শুধু যে মার্কিন জিপিএস নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসেছে তা-ই নয়, বরং ১৪০টি দেশকে নিজেদের নেটওয়ার্কে যুক্ত করতেও সফল হয়েছে!
এটি কেবল প্রযুক্তিবিদদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি প্রমাণ করে যে, চীন কীভাবে তাদের প্রযুক্তিগত ঝুঁকি কমাতে শিখেছে। বিস্তারিত জানতে চান?
বেইডৌর উত্থান
প্রথমেই কিছু পরিসংখ্যান—
চীনের এই স্যাটেলাইট নেভিগেশন খাত ২০২৪ সালে ৭৯.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ৭.৪% বেশি!
বেইডৌ প্রতিদিন এক ট্রিলিয়নেরও বেশি লোকেশন অনুরোধ প্রক্রিয়াজাত করে এবং ৪০০ কোটি কিলোমিটার পথনির্দেশনা দেয়।
জিপিএস নয়, বেইডৌ এখন আরও বেশি কিছু
যদিও এটি শুরু হয়েছিল সামরিক প্রয়োজনে, এখন এটি চীনের অর্থনীতি ও বৈদেশিক নীতির এক অপরিহার্য স্তম্ভ। অনুমান করা হয়, ইতিমধ্যে ২৮৮ মিলিয়ন চীনা মোবাইল ফোনে বেইদৌ সমন্বিত হয়েছে। এটি দেশের ৯৯% শহর ও গ্রামীণ সড়কে এমনকি লেন-লেভেল নির্ভুলতা প্রদান করে—যা প্রচলিত জিপিএস থেকেও অনেক উন্নত।
বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণ
গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে বেইদৌ এখনো জিপিএসকে পুরোপুরি ছাপিয়ে যায়নি, কিন্তু ১৪০টি দেশ ইতিমধ্যেই এটি ব্যবহার করছে। তারা অবশ্য একে জিপিএসের একমাত্র বিকল্প হিসেবে নয়, বরং একটি শক্তিশালী পরিপূরক হিসেবে গ্রহণ করেছে—
আফ্রিকায় ৩০টির বেশি দেশ বেইডৌ নির্ভর রেফারেন্স স্টেশন স্থাপন করেছে, যার মাধ্যমে তারা সুনির্দিষ্ট কৃষি, পানি ব্যবস্থাপনা ও আবহাওয়া পূর্বাভাস পায়।
লাতিন আমেরিকায়, পেরুর চানকাই বন্দরসহ বিভিন্ন স্মার্ট নেভিগেশন ব্যবস্থায় বেইডৌ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে, যেখানে মার্কিন জিপিএস কাভারেজ দুর্বল, সেখানে বেইডৌ পরিবহন ও সরবরাহ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করছে।
একটি শক্তিশালী ‘সেকেন্ড অপশন’
জিপিএস এখনও বিশ্বের প্রধান স্যাটেলাইট নেভিগেশন ব্যবস্থা, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু বেইডৌ বহু দেশকে যুক্তরাষ্ট্র নির্ভরতা থেকে বের হওয়ার পথ দেখাচ্ছে—বিশেষত দক্ষিণ গোলার্ধে, যেখানে জিপিএস কাভারেজ তুলনামূলক দুর্বল।
চীন এই দুর্বলতাকে পরিণত করেছে এক অবিশ্বাস্য সুযোগে—নিজেদের নেটওয়ার্ক দাঁড় করানোর মাধ্যমে।
মূল কথা: প্রযুক্তিগত স্বাধীনতা
চীনের লক্ষ্য কখনোই জিপিএসকে হারানো ছিল না, বরং নিজেদের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য বিকল্প তৈরি করা—যাতে তারা আর কারও উপর প্রযুক্তিগতভাবে নির্ভরশীল না থাকে।
এটি নতুন কিছু নয়। হুয়াওয়ে, ৫জি বা নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে আমরা একই প্রবণতা দেখেছি।
বেইডৌ হয়ে উঠেছে এক প্রতীক—চীন নিজেদের প্রযুক্তিগত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছে পশ্চিমা স্বার্থের চাপে না পড়ে।
বেইডৌ কি কূটনৈতিক অস্ত্র?
হ্যাঁ, বেইডৌ এখন চীনের বৈদেশিক নীতির একটি কৌশলগত অস্ত্র। আগে যুক্তরাষ্ট্র চাইলে চীনের স্যাটেলাইট নেভিগেশন অ্যাক্সেস কেটে দিতে পারতো—এখন আর সেটা সম্ভব নয়।
এটি চীনের পক্ষ থেকে একটি কৌশলী পাল্টা জবাব, তাই না?
এবং এখানেই থেমে থাকার কোনো ইচ্ছা নেই তাদের। বেইডৌ তো কেবল শুরু—এর পর আছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), যোগাযোগ নেটওয়ার্ক, এবং সবুজ জ্বালানির মতো বৈশ্বিক সম্প্রসারণ পরিকল্পনা।
চীনের প্রতিটি পদক্ষেপ তাদের অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাবও বিস্তার করছে।
আগামীতে কী অপেক্ষা করছে? সেটিই এখন দেখার বিষয়।
মুমু