
.
‘দুর্নীতি’ শব্দটির সঙ্গে কমবেশি সকলেই পরিচিত। তবে দুর্নীতির সংজ্ঞা জটিলতায় আমরা ভুগছি দীর্ঘদিন ধরে। দুর্নীতি কাকে বলে কিংবা কী প্রক্রিয়ায় হয় তার সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে, দুদক বা দুর্নীতি দমন কমিশন ঠিকঠাক মতো কাজ করতে পারছে না বলে সাধারণ জনমনে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে। এই ধারণার কারণে দুদকের ভাবমূর্তি নিয়ে নানারকম প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই ধারণার প্রেক্ষিতে দুদকের ভাবমূর্তি নানা প্রশ্নের মুখে পড়ে।
দুর্নীতির বিভিন্ন রকম সংজ্ঞা রয়েছে। ইংরেজিতে দুর্নীতিকে বলা হয় Corruption। দার্শনিক ধর্মতাত্ত্বিক নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো আদর্শের নৈতিক বা আধ্যাত্মিক অসাধুতা বা বিচ্যুতি নির্দেশ করাকে দুর্নীতি বলা হয়ে থাকে। দুর্নীতি শব্দটি যখন বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তখন সাংস্কৃতিক অর্থে ‘সমূলে বিনষ্ট হওয়াকে নির্দেশ করে।’ দুর্নীতি শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল, পরে দার্শনিক সিমারো। তাদের মতে, যিনি ঘুষ এবং সৎ অভ্যাস ত্যাগ করে অর্থ রোজগার করেন, সেটিই দুর্নীতি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মরিসের মতে, ‘দুর্নীতি হলো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যবহার।’
প্রাচীন অর্থনীতিবিদ আইসিনিয়র বলেছেন, ‘দুর্নীতি এমন একটি কার্য, যেখানে অনৈতিক অর্থ প্রদানের কারণে তৃতীয় কোনো পক্ষ সুবিধা পায়। যার ফলে, তারা বিশেষ ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার নিশ্চিত করে। এতে করে দুর্নীতির সাথে যুক্ত পক্ষটি এবং তৃতীয় পক্ষ উভয়েই লাভবান হয় এবং এই কার্যে দুর্নীতিগ্রস্ত পক্ষটি থাকে কর্তৃপক্ষ।’ ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কাফম্যান দুর্নীতির ধারণাকে আরও বিস্তৃত করে বলেছেন, ‘আইনানুগ দুর্নীতি শব্দদ্বয় যোগ করার মাধ্যমে যেখানে আইনকে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ করা হয়, যাতে নিজেদের রক্ষা করার জন্যে আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনের ক্ষমতা আইন প্রণেতার নিকট রক্ষিত থাকে।’ দুর্নীতির বহুবিধ সংজ্ঞা বিবেচনায় দুর্নীতি চিহ্নিত করা খুবই মুশকিল হয়ে পড়েছে। দেশে-বিদেশে দুর্নীতি হয়ে থাকে। একেক দেশের দুর্নীতি একেক রকম। কমবেশি পৃথিবীর সকল দেশেই দুর্নীতি হয়ে থাকে। মানব জাতির এটা একটা মজ্জাগত দোষ বা সহজাত প্রবৃত্তিও বটে। প্রতিবছর আন্তর্জাতিক জরিপ ও গবেষণায় দুর্নীতি মেধানুসারে একটা তালিকা করা হয়। এ তালিকায় বাংলাদেশের নামটি প্রথম কাতারেই থাকে। ইতোপূর্বে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে প্রথম স্থান লাভ করার গৌরবও অর্জন করেছে। দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নশিপের মর্যাদার বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশন কতটা অসহায়, তা জাতি দেখেছে।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার একটানা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় রয়েছে। দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসারী বাংলাদেশে যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে। দৃশ্যমান উন্নতিতে সাধারণ মানুষ যথেষ্ট সুবিধাভোগ করছে বলে প্রচার করা হয়। কিন্তু দুর্নীতি কী বন্ধ হয়েছে? উত্তর হবে ‘না’। দুর্নীতি কখনো সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব নয়। কারণ, তা রক্তে মিশে গেছে। বাঙালি দুর্নীতি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসে সমৃদ্ধ বাঙালি কীভাবে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়েছে, তা ভাবতে গেলেও গা শিউরে ওঠে। উল্লিখিত বিভিন্ন জনের দেওয়া দুর্নীতির সংজ্ঞা বিবেচনায় একটি কমন বা সকল মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞাটি এ রকম হতে পারে– কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী একাগ্র স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে রাষ্ট্র ও জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে বিপুল সম্পদের অধিকারী হওয়াকে দুর্নীতি বলে।
এক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহার ও ধর্মকে পুঁজি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সাধারণত আমরা কেবল অফিস-আদালতে ঘুষ লেনদেনকে দুর্নীতি হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি। বাংলাদেশের বাস্তবতায় যদি বলি, তবে অফিস-আদালতে ঘুষ খাওয়াকে দুর্নীতি কর্মকা- মনে করা হয়। আর এই ঘুষ দেওয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ হলে সেটাকে বিচারের আওতায় আনা হয়। পড়ে যায় হইচই। এর বাইরে ব্যাংকে ঋণ জালিয়াতি, ব্যাংকের টাকা আত্মসাত ও সরকারি অফিসে ভুয়া সনদ ব্যবহার করে চাকরি নেওয়াটাকে দুর্নীতি হিসেবে গণ্য করা হয়।
উল্লিখিত বিষয়গুলো দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে বটে, কিন্তু এগুলোর চাইতেও ভয়াবহ দুর্নীতি হচ্ছে যা রাষ্ট্র বা সরকার হিসেবের মধ্যেই রাখে না। যেমন– ব্যবসা ক্ষেত্রে দুর্নীতি। যে কোনো ধরনের পণ্য মূল্যের একটা সীমারেখা থাকে। দেশীয় উৎপাদিত পণ্যে উৎপাদন খরচ বাদে নিট লাভের হার কত হওয়া উচিত, সে বিষয়ে কোনো নীতিমালা নেই। এই নীতিমালা না থাকাটাও এক ধরনের দুর্নীতি। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় ব্যবসায়ী ১০ টাকার পণ্যটাকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করে। এটাও দুর্নীতি। এ দুর্নীতিকে রাষ্ট্র আমলে নেয় না। ফলে, এক শ্রেণির ব্যবসায়ী রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যায়। আজকে বাংলাদেশে শিল্পের উন্নতি ঘটেছে। আধুনিক বিজ্ঞান সভ্যতায় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হচ্ছে। শিল্পে বিনিয়োগে সরকারি তরফ থেকে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করা হয়। যত্রতত্র শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। কিন্তু পরিবেশকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। শিল্পবর্জ্যে বাংলাদেশের সমস্ত নদীর পানি নষ্ট হয়ে গেছে। বিশেষত রাজধানী ঢাকার চারপাশে গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর পানি দূষিত করে ফেলা হয়েছে। এই তো বেশিদিনের কথা নয়। ১৯৯১ সালেও বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার পানি ছিল টলটলে। প্রচুর মাছ ধরা হতো এ পানিতে। মাছসহ জলজ প্রাণী হত্যার জন্যে দায়ী এ দেশের কথিত শিল্পপতি ও সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। কাগজে কলমে ইটিপি প্ল্যানের কথা থাকলেও কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে শিল্প গড়ে তোলা হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে নদীর দু’ধারে শিল্প স্থাপন করে পরিবেশকে ধ্বংস করা হয়েছে। সুজলা সুফলা নদীমাতৃক বাংলাদেশের সৌন্দর্যকে বিনষ্ট করে কতিপয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠী ধনবান হয়েছে। এটা মহা দুর্নীতি। এই দুর্নীতি নিয়ে আমরা কখনো মাথা ঘামাই না। রাষ্ট্রও নীরব।
বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশন নামে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সাবেক দুর্নীতি দমন ব্যুরো ভেঙে গঠিত হয় ‘দুর্নীতি দমন কমিশন’। দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যুরো ব্যর্থ হওয়ার কারণেই শক্তিশালী স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কমিশন গঠন করা হয় ২০০৪ সালে। পরবর্তীতে বিভিন্ন পর্যায়ে কমিশনের কর্মপরিধি বাড়ানো হয় এবং আইনি নানা সংস্কারের ভেতর দিয়ে কমিশন কার্যক্রম পরিচালনা করে। কিন্তু তাতেও দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব হয়নি। বরং দুর্নীতির প্রকৃতি বদলে গিয়ে আরও উচ্চমাত্রায় দুর্নীতি সংঘটিত হচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশনে যারা কাজ করেন, তারা তো রক্তমাংসেরই মানুষ। লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে সততার সঙ্গে কাজ করার নৈতিক বল কী দুর্নীতি দমন কমিশনের আছে? তাদের কিছু কর্মকা-ে জনগণের হাসির খোরাক সৃষ্টি হয়। একটি উদাহরণ দেই। এক পরিচিত ব্যক্তি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে উপজেলা সহকারী কৃষিকর্মকর্তা হিসেবে আনসার-ভিডিপি কোটায় নিয়োগ পায়। ৭ দিনের একটি আনসার ট্রেনিং সনদ জমা দেয় আবেদনের সঙ্গে। যথারীতি চাকরির শর্তানুযায়ী সব ধরনের প্রক্রিয়া শেষে নিয়োগ পাওয়ার ৩ বছরের মাথায় এসে ধরা পড়ে আনসার-ভিডিপি সনদটি জাল। তিনি ৭ দিনের ট্রেনিং নিলেও আনসার কর্তৃপক্ষ একটি জাল সনদ ধরিয়ে দেয় তার হাতে।
পরবর্তীতে প্রকৃত সনদ জমা দিলেও সেটি আর গ্রহণ করা হয় না। বেচারির চাকরি চলে যায়। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলাও হয়। চাকরি হারিয়ে এখন সে মানবেতর জীবন যাপন করছে। অথচ সে খুবই মেধাবী। নিয়োগ পরীক্ষায় মেধা তালিকায় নাম সংযুক্তির পরও বাড়তি সুবিধার জন্য আনসার-ভিডিপি কোটায় চাকরি গ্রহণ করে। দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তারা একাধিকবার সরকারি খরচে জাঁকজমকভাবে বর্ণাঢ্য গাড়ি বহরসহ তদন্ত করতে যায়। তাদের তদন্তে যে খরচ হয় সরকারি কৃষি কর্মকর্তার সারা জীবনের বেতনের চাইতেও তা বেশি হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের হম্বিতম্বি দেখে মনে হয়েছে তারা রাষ্ট্রের স্বার্থে বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করে ফেলেছে। অথচ যারা আনসার-ভিডিপির জাল সনদ সরবরাহ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দায়ের হলো না। এই হচ্ছে দুদকের কর্মকা-। এ সব কর্মকা-ে দুদকের ভাবমূর্তিই ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
আমার বাড়ি ঢাকা জেলার ধামরাই থানার আড়ালিয়া গ্রামে। গ্রামটিতে একটি অতি প্রাচীন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা কোটি টাকা খরচ করে দেখার মতো একটি বাড়ি বানিয়েছেন। বাড়ির পাশে কয়েক বিঘা জমিও কিনেছেন। খোঁজ নিয়ে জানলাম, ঐ শিক্ষিকার স্বামী দুর্নীতি দমন কমিশনে চাকরি করেন একজন সহকারী পরিচালক হিসেবে। যা হোক, এ নিয়ে কথা বাড়াতে চাই না। দুদকের পদস্থ কর্মকর্তাদের বায়োগ্রাফি নিয়ে কেউ পশ্ন তুলতে সাহস পাবে না।
সরকার সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য শুদ্ধাচার পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছে। যে সমস্ত কর্মকর্তা সততার সঙ্গে ভালো কাজ করেন, তাদেরই শুদ্ধাচার পুরস্কার দেওয়া হয়। দেখা গেছে যে, দুর্নীতিতে অভিযুক্ত অনেক কর্মকর্তাই শুদ্ধাচার পুরস্কারে ভূষিত। যা হোক, দুর্নীতি দমন করতে হলে চরিত্র বদলাতে হবে। রাষ্ট্র কাঠামোয় পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরেই দুর্নীতির বীজ রোপিত। দুদকের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে সততার সম্পদকে আমলে নিতে হবে। এদেশে এখনো অনেক সৎ, যোগ্য সরকারি কর্মকর্তা রয়েছে। তারা নিরীহ প্রকৃতির। কাজে লাগাতে হবে তাদের। কার্যত সৎ ব্যক্তিগণ কোণঠাসা অবস্থায় আছেন। দেশপ্রেমিক সৎ, যোগ্য লোকের অভাব নেই বাংলাদেশে। তাদের দিয়ে প্রশাসন গড়ে তুলতে হবে। যারা মেধা বিবেচনায় সরকারি প্রশাসনে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাদের অনেকের মেধা ব্যয় হচ্ছে অকাজে কুকাজে। এই মেধা যদি দেশের কল্যাণে ব্যয় হতো, তবে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সবটাতেই একটা শৃঙ্খলা ফিরে আসত। অসৎ রাজনীতিক; দুশ্চরিত্রবান সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী মিলে যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, তা ভাঙতে হবে দেশ ও জনগণের স্বার্থে। জননেত্রী শেখ হাসিনাই সেটি ভাঙতে পারবেন বলে জনগণ বিশ্বাস করে। কেননা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির জনকের কন্যা, তাঁর রয়েছে সীমাহীন সততা ও দেশপ্রেম।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক