ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

বাংলাদেশ-জাপানের উন্নয়ন ও সংযোগ

ড. আলা উদ্দিন

প্রকাশিত: ২০:৫০, ২১ এপ্রিল ২০২৪

বাংলাদেশ-জাপানের উন্নয়ন ও সংযোগ

.

প্রথমে ২০০৭ সালে জাপান গিয়েছি ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর পড়াশোনার জন্যতখন প্রায় চার বছর ছিলাম ওসাকায়তখনকার স্মৃতি নিয়ে অন্য সময় লিখবআজ লিখছি সাম্প্রতিক সফর নিয়েগত মার্চ মাসে ১০ দিনের জন্য ওসাকায় গিয়েছিলাম গবেষণা ও সেমিনার সম্পর্কিত কাজেআমি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও জাপানের জেএসপিএসের জয়েন্ট কোলাবরেটিভে একটি গবেষণার কাজ করেছি দুই বছরমার্চে তা শেষ হলোযাই হোক, ১১ তারিখ ফ্লাইট ছিলতার একদিন আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজ ছিলকাজ শেষে বিদায় নেওয়ার সময় ওই পরীক্ষা কমিটির সভাপতি ম্যাডাম (অধ্যাপক সানজিদা ফারহানা) মনোরেল চড়ার আমন্ত্রণ জানালেনঢাকায় মনোরেল/মেট্রোরেল হয়েছে দেখেছি, কিন্তু চড়ার ইচ্ছে কখনো জাগেনিশুনেছি অনেক ভিড়

তাছাড়া জাপানে অনেক চড়েছিকিন্তু হাতে সময় থাকায় তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করলামতিনি একসময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেনসেই সূত্রে ছিলেন আমার শিক্ষকশিক্ষকের কথা না শুনলেই নয়ফলও হলো ভালোমনোরেলের অভিজ্ঞতা ভালো হলোমতিঝিল থেকে মেট্রোতে উঠলাম, ভিন্ন বগিতে অবশ্যএখানে আবার ঠাসাঠাসির কারণে নারী-পুরুষকে আলাদা বগিতে চড়তে হয়।  প্রথম ভ্রমণেই এত ভালো লাগল যে, নিজ দেশে জাপানের মজা পেয়ে গেলামদুপুরবেলা থাকায় লোকজনের চাপও ছিল তুলনামূলকভাবে কমস্বল্পতম সময়ের মধ্যেই মিরপুর ১০ এ গিয়ে নামলামএর আগে তা কোনোদিন সম্ভব ছিল নাস্টেশনে নেমেই বললাম কার্ড করবঢাকায় না থাকলেও কার্ড করতে ইচ্ছা হলো, ট্রেনের অভিজ্ঞতা ভালো লাগলো বলেম্যাডাম একটু অবাক হলেনআমার আগ্রহ দেখে নিজেই আমার কার্ড করিয়ে দিলেনসন্ধ্যার সময় মিরপুর থেকে সচিবালয় ফিরলাম কার্ড ব্যবহার করেইএ এক আশ্চর্য রকম অভিজ্ঞতাভিড় একটু ছিল, কিন্তু সন্ধ্যাবেলায় এত অল্প সময়ে ফিরে আশা ছিল অকল্পনীয় বিষয়বাংলাদেশে সেটাও সম্ভব হলো জাপানের সহায়তায়এত আরাম ও আনন্দ লেগেছে, সঙ্গে কিছুটা অহংকারওআমাদের মেট্রোরেল আছে, আমরাও পারিআমরা যেন ধরে রাখতে পারি, সেটাই এখন প্রত্যাশা

জাপানকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, বাংলাদেশকে স্বাধীনতার পর থেকে সম্ভব সব উজাড় করে দেওয়ারএ পর্যন্ত জাপানই এককভাবে সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন সহযোগী কোনোপ্রকার হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকেইজাপান দিয়েও আনন্দ পায়, যদি বাংলাদেশ ধরে রাখতে পারেবাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব ও তৃপ্তি জাপান খুব পছন্দ করেসাম্প্রতিক সময়ে উল্লিখিত গবেষণা প্রজেক্টের কাজে বাংলাদেশ ভ্রমণে আসা দুজন অধ্যাপকের অতিমত এটিযানজট, তীব্র গরম, ধূলাবালি, ছিনতাইয়ের ভয় ইত্যাদি সকল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ তাদের কাছে অনেক প্রিয়

যাই হোক, জাপান পৌঁছালাম ১২ তারিখ সকালে- ওসাকার কানসাই বিমান বন্দরে সকাল ৫:৩০ মিনিটেঅন্যান্য বার সাধারণত এয়ারপোর্ট লিমোজিন বাসে করে ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটস্থ আবাসস্থলে (তোয়োনাকা ক্যাম্পাসের আশেপাশের স্ট্যাপজে- উমেদা কিংবা হোতারোগাইকে) যেতামএবার বাসে যেতে ইচ্ছে করল নাএকটু অপেক্ষা করতে হবে মূলত ট্রেনে চড়ার জন্যবাংলাদেশে মেট্রোতে চড়ে জাপানে গিয়েই ট্রেনে এবং বিশেষত মনোরেলে চড়ার বাসনা তৈরি হলোট্রেনে করে আবাসস্থলে গেলামউপলক্ষ খুঁজছিলাম মনোরেলে চড়ারপেয়েও গেলাম একদিন পরতাইওয়ানের এক পিএইচডি গবেষক তার বাসায় ডিনারের আমন্ত্রণ করলেনতার বাসায় যাওয়ার মাধ্যম মনোরেলখুব খুশি মনে তোয়োনাকা ক্যাম্পাস সংলগ্ন মনোরেল থেকে গেলাম শজি স্টেশনেতারপর ১০ মিনিট হাঁটার পথমনোরেলে উঠতেই বাংলাদেশের মতো কার্ড টাচ করে ট্রেনে উঠলামযে সময়ে আসার কথা ঠিক সেই সময়েই, সেই সেকেন্ডেই বলা যায়ট্রেনে উঠে ভাবতে লাগলাম, এই ট্রেন এখন আমাদেরও আছেআমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে সদা যানজটের ঢাকা শহরে মতিঝিল থেকে মিরপুর যাওয়া-আসা করতে পারি নিমিষেইচড়ছি জাপানের ওসাকা মনোরেলে আর মনে মনে আনন্দ বোধ করছি বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায়-ভালোলাগায়, সঙ্গে অহংকার ও জাপানের প্রতি কৃতজ্ঞতা

হয়তো জনবহুল দেশ বলে বিদ্যু সঙ্কট, ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি, পেশাদারিত্বের অভাব ইত্যাদি ঘাটতির কারণে কিছু কিছু সমস্যা হবে, তবে নিশ্চয় আমরাও একদিন সফল হবোরাজনৈতিক সদিচ্ছা আর আইনশৃঙ্খলার যথাযথ প্রয়োগ থাকলে হয়তো বেশিদিন লাগবে নাএটি কেবল আমার আশা নয়, জাপানি অধ্যাপকদেরও অভিমত

একজন পুরান ঢাকায় সদরঘাটে নদীর পানির রং দেখে বললেন, জাপানেও ৫০-৬০ বছর আগে এমন ছিলতার মানে বাংলাদেশ হয়তো একদিন জাপানের মতো হওয়ার সম্ভাবনা রাখেএকই ধরনের কথা আরেকজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকও বললেনতিনি বাংলাদেশের অত্যন্ত প্রিয়জন, অধ্যাপক তোমিও মিজোকামি- যিনি ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক স্বাধীনতা সম্মাননা পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে তাঁর অবদানের জন্য২০১৩ সালে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে বাংলায় বক্তৃতা করেছিলেনআমার আতিথ্য গ্রহণ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ভ্রমণ করার ইচ্ছা ছিল তাঁরকিন্তু তকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে শেরাটন হোটেল থেকে তাঁর বের হওয়া বারণ ছিল১৯৭১ সালে বাংলাদেশের পক্ষ নিয়ে ভারতের একটি পত্রিকায় লেখাসহ বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার জন্য তাঁর যে মমত্ব, তা অবিস্মরণীয়তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা ২০০৮ সালেআমার বাসায় (মিনো সিটির অনোহারাস্ত) যেদিন প্রথম এলেন সঙ্গে ছিল ১৯৭১ সালে প্রকাশিত কয়েকটি পত্রিকা ও বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের কপি আমাকে দেখানোর জন্যঅত্যন্ত সুন্দর করে বাংলা, হিন্দি ও উর্দু বলতে পারেনশেষের কবিতাসহ বেশ কয়েকটি বাংলা উপন্যাস জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেছেন তিনিএখন বয়স ৮৩ বছরতারপরেও যখনই ওসাকায় যাই, দেখা করতে আসেনএবার মার্চেও এসেছিলেন দুই নাতিকে নিয়েতাদের দেখালেন বাংলাদেশের একজন অধ্যাপককেকথা প্রসঙ্গে এবারও তিনি বলছিলেন, জাপান আগে কৃষিপ্রধান দেশ ছিলএখন শতকরা ১০ জনও কৃষক নেইবাংলাদেশও যদি সঠিক পথে অগ্রসর হয়, একদিন জাপানের মতো উন্নতি লাভ করবেবিদেশীদের মুখে এসব কথা, আশার বাণী শুনতে ভালোই লাগেমানতে চাই, কিন্তু বাস্তবতা দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হইমনোরেলের মতো শাহজালাল বিমান বন্দরের তৃতীয় টার্মিনালও নিশ্চয়ই বিশ্বসমাদৃত হবেসেটিও জাপানি তত্ত্বাবধানে নির্মিতআশাকরি মনোরেলের মতো তৃতীয় টার্মিনালের মতো বাংলাদেশও ধীরে ধীরে জাপানি উকর্ষের দিকে অগ্রসর হবে।                   

আবার আসি মনোরেলের কথায়শজির মতো সুযোগ পেলেই এবার মনোরেলে চড়েছি- সেনরিচুও গেছিযতবার চড়েছি ততবারই অন্য রকম ভালোলাগা কাজ করেছে, এই জিনিস আমাদের আছে বলেএবার সেনরিচুও মনোরেল স্টেশনে আমার এক প্রাক্তন ছাত্রের (নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) স্মৃতিও যুক্ত হয়েছেঅনুপমসহ শিবাহারা থেকে সেনরিচুও স্টেশন পর্যন্ত মনোরেলে চড়লামআমাদের দুই দেশের মিল-অমিল ও সম্ভাবনা নিয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলামআমরা দুজনেই বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের নানাবিধ বিষয়ের তুলনা করছিলামতিনি (অনুপম চাকমা) সম্প্রতি টোকিওর একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেনসুদূর টোকিও থেকে আমার সঙ্গে দুই ঘণ্টার জন্য দেখা করতে বুলেট ট্রেনে চড়ে ওসাকায় এলেনআবার বিকেলেই ফিরে গেলেন।  জাপানে টোকিও-ওসাকা যাওয়া-আসা কোনো বিষয় নাট্রেনের যাত্রা এত সহজ, সময়মতো এবং সুবিধাজনক যে, এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া জাপানে বসবাসরতদের জন্য কোনো বিষয় নাঅধ্যাপক তোমিও মিজোকামি গত বছর ডিসেম্বর মাসে ওসাকা থেকে টোকিও গিয়ে একটা ক্লাস সেরে একটা হোটেলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর একটি অনুষ্ঠানে যোগদান করে ঐদিনই আবার ওসাকায় ফিরে এসেছেনতার মতে, ভারতে আশ্রিত বাংলাদেশী শরণার্থীদের জন্য কাজ করে তিনি বাংলাদেশের পক্ষে যে অবস্থান নিয়েছিলেন, তা তেমন কিছু নয়, কেবল মানবতাতার জন্য এভাবে রাষ্ট্রীয় সম্মানে তিনি অভিভূতপ্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট তিনি ভীষণ কৃতজ্ঞপ্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে যোগদানের আগে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।   

মনোরেল দেখতে প্রায় এক হলেও মনোরেলের একটা সংস্কৃতি আছে, তা কিন্তু ভিন্নযেমন- রেলে ওঠার জন্য সবাই লাইন ধরে দাঁড়ায়, একটি ছোট শিশুও লাইনে দাঁড়িয়ে ট্রেনে উঠতে পারবে, তার পড়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেইকেউ তাড়াহুড়া করে নাজায়গা না পেলে পরের ট্রেন ধরবে সেই মানসিকতা নিয়েই থাকেকেউ কাউকে টপকে পার হতে চায় নানারী-পুরুষ আলাদা বগির দরকার হয় নাট্রেনের গন্তব্য অনুযায়ী অনেক লাইন দেখা যায় স্টেশনেলাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারা বই পড়ে, গল্প করেবই পড়ার মূল চিত্র দেখা যায় ট্রেনের ভিতরেপ্রায় সবাই বই পড়ে, অনেকের বইয়ে কভার দেওয়া থাকেফলে, বোঝা যায় না কে কি বই পড়ছেকেউ সেটা জানতেও চায় নাকে কি করে, কি পড়ে এ বিষয়ে কারও ঔসুক্য নেই বললেই চলেআবার অনেককে দেখা যায় মোবাইলেই বুঁদ হয়ে আছেতবে বেশিরভাগই কিন্তু বই পড়ে; কেউ কেউ খবরের কাগজ পড়েএমনকি যারা ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকেন, তারাও বই পড়েনযারা তরুণ-তরুণী ও মাঝবয়সী প্রায় সবার কানে মোবাইলের হেডফোন দেখা যায়তবে ট্রাই বা বাসের মধ্যে, রেস্টুরেন্টে কিংবা রাস্তায় হাঁটার সময় কাউকে কথা বলতে দেখা যায় নাএকজনের কথা ও কাজে অন্যের যেন কোনো অসুবিধা না হয়, এটা তাদের মূল বিবেচ্য- অন্যতম শিষ্টাচার

(বাকী অংশ আগামীকাল)

লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

([email protected])

×