ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৭ জুন ২০২৫, ১৩ আষাঢ় ১৪৩২

বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ

ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন

প্রকাশিত: ২০:০১, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩

বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ

.

বাংলাদেশের ইতিহাসে আজ একটি অনন্য দিন। ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস; বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিন। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখন্ডে নাম জানান দেওয়ার দিন। স্বাধীন একটি দেশের পতাকা পৃথিবীর আকাশে ওড়ার দিন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে যে দেশের জন্ম হয়েছিল তা পূর্ণতা পেয়েছিল পাকিস্তানিদের পরাজিত করার মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর। নয় মাস যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ৯১ হাজার ৬৩৪ সদস্য আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এর ফলে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘটে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। বাংলাদেশের মানুষ পায় এমন একটি অনুভূতি, যার সঙ্গে আর কোনো কিছুর তুলনা করা যায় না। তার আগের নয় মাস অবরুদ্ধ বাংলাদেশ কাটিয়েছে চরমতম নির্মম, দুর্বিষহ, অমানবিক সময়। হারিয়েছে ত্রিশ লক্ষ প্রাণ দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম। এত ত্যাগের বিনিময়ে প্রাপ্ত অমূল্য স্বাধীনতাকে বিজয়ের উল্লাসে উদ্যাপন করার দিন আজ।

যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অবরুদ্ধ বাংলাদেশকে দেখেননি, যারা দেখেননি ঢাকার রাস্তায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্কের গর্জন, যারা দেখেননি ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের ছাত্রদের, পিলখানার জাওয়ানদের রক্তগঙ্গা, যারা দেখেননি লক্ষ লক্ষ মানুষের আর্তচিৎকার, যারা দেখেননি আমারই দেশে, আমারই মাকে বিবস্ত্র করার চরমতম মানবিক অপমান, যারা দেখেননি এদেশের তরুণ সমাজের রুখে দাঁড়ানো, যারা দেখেননি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে মানুষের বাঁধভাঙ্গা আনন্দ অশ্রু, তারা সেই দিনটির কথা ভাবুন একবার। ফিরিয়ে আনুন একাত্তরের সেই বিজয় মুহূর্তকে এবং উল্লাস করুন। আপনাদের জন্য যারা এই স্বাধীন দেশ রেখে গিয়েছেন। যারা জীবন দিয়েছেন। যারা কর্ম দিয়ে দেশটিকে গড়ে তুলেছেন তাদের শ্রদ্ধা করুন। তবেই আমাদের নেওয়া হবে প্রকৃত বিজয়ের আস্বাদ।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সাল থেকে ৫২ ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চে গণহত্যা শুরু হলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ শহীদ দুই লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকসেনাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। সেই হিসাবে বিজয়ের ৫২ বছর পূর্তির দিন আজ। বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ আজকের দিনটি উদ্যাপন করছে। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব ধরনের মানুষের বাঁধ ভাঙা উল্লাসের দিন। আজকের দিনে বাংলাদেশের মানুষ শ্রদ্ধা করবে সেই সব বীর শহীদদের, যারা আমাদের জন্য পৃথিবীর মানচিত্রে একটি দেশ রেখে গিয়েছেন, একটি মানচিত্র রেখে গিয়েছেন, একটি পতাকা রেখে গিয়েছেন। রেখে গিয়েছেন সব ভয়কে জয় করার সাহস শক্তি। যে শক্তি যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে গড়ে তোলার জন্য খুব প্রয়োজন ছিল। আমরা সে সাহস দেখিয়েছি। দেখিয়ে চলেছি। বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই বাংলাদেশ বিনির্মাণে তার কন্যা শেখ হাসিনা অদম্য সাহসের সঙ্গে বিদেশীদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলছেন।মানুষ দিন শেষে শান্তি সমৃদ্ধি চায়’-এমন বাংলাদেশ পেতে আমাদের আর বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা আমাদের কাঙ্খিত সোনার বাংলার দিকে ধাবিত করছে।

বাংলাদেশের মানুষের সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের ইতিহাস জানা দরকার। জানানো দরকার সদ্যজাত শিশুটিকেও। কারণ, আমাদের কয়েকটি প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ভুল ইতিহাস জেনে বড় হয়েছি। পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে সব জায়গায়ই মুক্তিযুদ্ধকে ভুল ন্ডিতভাবে উপস্থাাপন করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ মানে৭১ সালের নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধই শুধু নয়, ১৯৪৭ সালের আগ পর্যন্ত বিষয়টি ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে থাকলেও৪৭ পরবর্তী সময়ে আমরা যা করেছি আমাদের জন্যই করেছি। দেশভাগের ফলে আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছিলাম, তা প্রকৃত স্বাধীনতা ছিল না। এটা বুঝতে আমাদের বেশি সময় লাগেনি। ভাষার প্রশ্নে আমরা প্রথম বুঝতে পারলাম পাকিস্তানি শাসকরা কখনোই আমাদের মেনে নেবে না। শুধু শোষণই করবে।৪৮-’৫২ পর্যন্ত আমরা মাতৃভাষা বাংলার জন্য যে লড়াই করেছি, তা আমাদের স্বাধীনতার প্রথম সোপান। অল্প কয়েকজন মানুষের ভাষা উর্দুকে পুরো পাকিস্তানের মানুষের মাতৃভাষা করার ঘোষণার মাধ্যমে মূলত পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ৫৬ ভাগ মানুষকে অস্বীকার করেছিল। বাংলার তরুণরা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজপথে রক্ত দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, মা এবং মায়ের কাছে শেখা বুলির চেয়ে সত্য কিছু নেই এবং সে জন্য তারা জীবনও দিতে পারে। সেটিই ছিল আমাদের স্বাধীনতার প্রথম সোপান।

মাতৃভাষাকে আমরা রাষ্ট্রভাষা করার সময়েই বুঝতে পেরেছিলাম স্বায়ত্তশাসনের কোনো বিকল্প সামনে নেই। সেই পথ ধরেই ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয় হয়। কিন্তু পাকিস্তানিরা সেই সরকারকেও বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে দিল না। সরকার ভেঙে দিল। আইয়ুব খানের (১৯৫৮) সামরিক শাসন আমাদের অধিকার আদায়ের পথে শেষ পেরেক হিসেবেই তারা ভেবেছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দফা (১৯৬৬) ঘোষণা মূলত অঞ্চলের মানুষের স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা এঁকে দেয়। দফা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার কেন্দ্রে অবস্থান করে। এর ফলে আইয়ুব শাসনের অবসান হয়। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পৃথিবী দেখল এক অন্যরকম ঢাকা শহরকে। পৃথিবীতে সে সময়ে সবচেয়ে আলোচিত শহর ছিল ঢাকা। কারণ, ঢাকার মানুষরা রাস্তায় বের হয়ে এসেছিল এবং তখনকার সামরিক শাসককে গদি থেকে নেমে যেতে বাধ্য করেছিল। মূলত এর মাধ্যমেই বাঙালি পেয়ে যায় অসম্ভবকে সম্ভব করার অসীম সাহস উদ্দীপনা। যার ফসল৭০-এর নির্বাচন। যার ফসল স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ।

১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। কিন্তু পাকিন্তানিরা জানত কেন্দ্রীয় সরকার একবার শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত হলে তাদের এজেন্ডা আর কখনোই বাস্তবায়ন হবে না। আর শেখ মুজিব শুধু পূর্ব পাকিস্তানের শাসক হবেন না। তিনি শুধু পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জন্য সরকার পরিচালিত করবেন না। তিনি পুরো পাকিন্তানের নেতা হয়ে উঠবেন। তখন পাকিস্তান পিপলস্ পাটি বা অন্য রাজনৈতিক দল তাদের অঞ্চলেও জনপ্রিয়তা হারাবে।

তারা ছিলেন অবিচল- শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে কিছুতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না। নানা উপায়ে তারা তালবাহানা শুরু করে। শেষ পর্যন্ত তারা বেছে নেয় ইতিহাসে ভয়ংকর নারকীয় হত্যাকান্ডে পথ- অপারেশন সার্চলাইট। অপারেশন সার্চলাইটই বলে দেয় তারা আমাদের জন্য কতবড় নিষ্ঠুরতার নিদর্শন রেখে গেছেন। এটি শুধু অপরাধই নয়, মানবতার চরম নিষ্ঠুরতা। পূর্ব পাকিস্তানে তারা যা করেছিল তা অঞ্চলে চরম মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল। যা আমরা কখনোই ভুলব না। ক্ষমা করতে পারব না সময়ে যারা এই হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে ছিল, সমর্থন দিয়েছিল, নীরব থেকে ছিল, তাদেরও। বাঙালি বীরের জাতি। বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। ১৭ এপ্রিল সেই সরকার শপথ পাঠ করে এবং সর্বাত্মক যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। ভারতের সহায়তা স্বীকৃতি আমাদের স্বাধীনতাকে করে ত্বরান্বিত।

বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্যারিশম্যাটিক লিডার হিসেবে আবির্ভূত হন, যিনি বাঙালি জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তাঁর মার্চের ভাষণ শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়, এখনো বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করে। তাঁর ভাষণই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে যাওয়ার মূলমন্ত্র। কোটি কোটি মানুষের মুখে মুখে এখনো সেই ভাষণ শোনা যায়। যিনি যৌবনে পরিবার, স্ত্রী-সন্তান-বাবা-মাকে রেখে জেলখানায় কাটিয়েছেন পাকিস্তানের ২৩ বছরের মধ্যে ১৩ বছর বা ৪৬৮২ দিন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁকে পাকিস্তানিরা কারাগারের প্রকোষ্ঠে বন্দি করে রেখেছিল। তাঁর জন্য কবর পর্যন্ত খুঁড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর যখন তিনি দেশ গঠনে ব্যস্ত, সেই সময়েই তাঁকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে একদল বিপথগামী সেনা সদস্য বাংলাদেশের মানুষকে স্তব্ধ করে দেয়। সময়ের তরুণ প্রজন্ম ভাবতেই পারবে না যে, এই দেশে, যে দেশ বঙ্গবন্ধু স্বাধীন করেছেন, সেই দেশে তার নাম নেওয়াটাও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো। বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়নি পরবর্তী ২১ বছর। বঙ্গবন্ধুর একটি ছবি পর্যন্ত কোথাও দৃশ্যমান ছিল না।

যে দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের এক সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারতলাবিহীন ঝুড়িআখ্যা দিয়েছিলেন, সেই দেশের মানুষের বর্তমান মাথাপিছু আয় ২৮২৪ মার্কিন ডলার। কোভিডের ভয়াল ছোবল সত্ত্বেও ইকোনোমিক গ্রোথ .২৫% যা ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় ছিল .৪০% একই সময়ে বাজেট সাইজ .০১ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৮৭.৫৬ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী সেখানে ছিল ৪১.৫১% তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৮.%-এ। অর্জন সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বগুণে। সাহসী দৃঢ়চেতা পদক্ষেপের কারণে। বাংলাদেশ এখন মাথা উঁচু করে কথা বলে। চোখে চোখ রেখে কথা বলে। এই চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস যিনি জুগিয়েছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিজয় উদ্যাপনের এই সময়ে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে আরেকটি বিজয় উদ্যাপনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে তরুণদের স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি যোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলার আরেকটি পদক্ষেপ নিতে হবে এবং গণতন্ত্রের বিজয় উদ্যাপন করতে হবে।

লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি); পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল)

×