
.
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিক্ষা নিয়ে সাধারণের আগ্রহ বেড়েছে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর এগিয়ে আসার আকাক্সক্ষা তীব্র হয়ে উঠেছে। নজর কেড়েছে মায়েদের ভূমিকা। খেটে খাওয়া অভিভাবকও স্বপ্ন দেখে তার সন্তান মর্যাদা নিয়ে বাঁচুক। নারী শিশুদের বাঁধভাঙ্গা স্রোত খুলে দিয়েছে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। শিক্ষার আলোকবৃত্তে সন্তানকে পৌঁছে দিতেই হবে। শিক্ষাই দারিদ্র্যের শিকল ছিঁড়বে। এমনিভাবেই শপথ নিতে শিখিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, দারিদ্র্য হতে মুক্ত না হলে স্বাধীন হওয়া যায় না। তাই তাকে লড়তে হবে, এগোতেই হবে।
স্বাধীনতা মানুষের বৈষয়িক সামর্থ্যকে মজবুত করেছে। সমৃদ্ধির চিহ্নও চারপাশে। তবে মূল্যবোধের ধস ঠেকানো যায়নি- এ কথা অস্বীকার করা যায় না। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে দিকে দিকে। কিন্তু শিক্ষার মান নিয়ে রয়েছে সংশয়। সময়ও থেমে নেই। ভাবনার কাঠামোয় ঘটে যাচ্ছে রূপান্তর। শিক্ষার চরিত্রেও ক্রমাগত বদল আসছে। বহমান সময়ের স্রোত নতুন নতুন চাহিদা তৈরি করে চলেছে। এটাই হয়তো বিবর্তনের ব্যাকরণ। পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারলে শিক্ষাও কাজে লাগবে না। দরকার হবে মানসম্পন্ন শিক্ষা। বিশ্বজনীন শিক্ষা। এমন চাহিদার মুখেই অভিভাবক হন্যে হয়ে খুঁজছে ভালো শিক্ষক, ভালো প্রতিষ্ঠান। সবাই প্রশ্ন করে, এমন প্রতিষ্ঠান কই? খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ই হয়তো এ প্রশ্নের সঠিক জবাব।
ময়ূর নদের পাড়ে চোখ জুড়ানো নিসর্গ। প্রকৃতির এমন সপ্রাণ সাহচর্যে গড়ে উঠেছে এ বিশ^বিদ্যালয়টি। মুক্তিযুদ্ধের বহু স্মৃতি এখানে জড়িয়ে। পাক বর্বরতা, হিংস্রতা আর বাঙালির প্রতিরোধ- এ সবের কাল সাক্ষী এ জনপদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যালেন্ডারে ২৫ নভেম্বর বিশেষ একটা দিন। দিবসটি উদ্যাপন করে এ পরিবারের সব অংশীজন। উপচেপড়া আবেগ আর অহঙ্কারে। ১৯৯১ সাল। একাডেমিক কার্যক্রমের সূচনা লগ্ন। তবে ১৯৮৭ সালের ৪ জানুয়ারি বিশ^বিদ্যালয় যাত্রা শুরুর সংকেত পেয়েছিল। ইতিহাস এ দিনটিকেও মনে রাখবে। আর এ কথাও সত্যি, বিশ্ববিদ্যালয় ভাবনার কুঁড়ি ফুটেছিল ১৯৭২ সালে। ড. কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে এমনই আভাস ছিল। জন্মলগ্ন থেকেই খুলনা বিশ^বিদ্যালয় ভালো করছে। সবাই বলে, এখানে লেখাপড়া হয়। গবেষণা হয়। খেলাধুলা হয়। বিশ^বিদ্যালয়ের বাস কিংবা নান্দনিক ক্যাফে- সবখানেই জমে আড্ডা, চলে গল্প। চলে যুক্তি-প্রতিযুক্তির লেনদেন। মেধার অফুরন্ত উদ্দীপনা। সন্ধ্যায় সেজে ওঠে মুক্তমঞ্চ সংস্কৃতির ব্যঞ্জনায়। আইন স্কুলের মুটকোর্ট কেঁপে ওঠে তার্কিক ঔদ্ধত্যে। নতুন জ্ঞানের সন্ধানে।
প্রশ্ন থাকে, অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এর স্বাতন্ত্র্য কোথায়? উত্তর খুঁজতে কিছুটা এগোতেই হবে। বিশ^বিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়ালেই অনেক ভাবনার খোরাক জুটে যাবে। মেইন গেট কিংবা গেট হাউসের শুধু মনোমুগ্ধকর বাহ্যিক সৌন্দর্যই নয়, নির্মাণশৈলীর অন্তর্গত দর্শন আরও মহত্তর, আরও গভীর। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায় হতে শুরু করে জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদ্বয় পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ইতিহাসের রূপক উপস্থাপনা যে কোনো দর্শনার্থীকে মুগ্ধ করবে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব দেশসেরা স্থপতিদের বিস্ময়কর প্রতিভা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আগাম ধারণা দেয়। ক্যাম্পাসে ঢুকেই চোখে পড়বে জাতির পিতার সৌম্যদর্শন মুখচ্ছবি। একে একে জাতীয় চার নেতা, কবি-সাহিত্যিক, বরেণ্য বিজ্ঞানী, অনেকের স্মৃতি ভেসে উঠবে বিভিন্ন ভবনের নাম ফলকে। শান্ত-সমাহিত পরিবেশ আপনার মনটাকে গভীর প্রশান্তিতে ভরিয়ে তুলবে। একটা আদর্শ লেখাপড়ার পরিবেশ।
অদ্ভুত একটি সহিষ্ণু সমাজ গড়ে উঠেছে এখানে। সহজে প্রতিক্রিয়া দেখায় না ছাত্র-শিক্ষক কেউই। ভিন্ন মতের প্রতি এই সহনশীলতা দুর্লভ। মত তৈরি হয়, মত বদলায়। মুক্ত চিন্তার মুক্ত প্রকাশ ছাড়া জ্ঞানের বিস্তার সম্ভব নয়। এখানে স্বাধীনতা আছে ছেলে-মেয়ে সবার। চলাফেরায়, পোশাক-পরিচ্ছদে, ভাবনায়-কল্পনায়। কোনো ছুঁতমার্গ নেই। পড়ার টেবিলে কিন্তু এরা নাছোড়বান্দা, আপোসহীন। আবার ফুল বাগানেও এরা সাবলীল, স্বচ্ছন্দ। কখনও নান্দনিক ক্যাফেতে, কখনো ছন্দময় মুক্তমঞ্চে। লাইব্রেরি এখন প্রযুক্তির দখলে। শিক্ষার্থী ভীষণ খুশি। প্রযুক্তির উচ্ছ্বাস উদ্যাপন করে তারুণ্য। তারা সপ্রতিভ স্মার্ট ক্লাস রুমে, গবেষণাগারে, ইনোভেশন হাবে। বিদ্যাচর্চা তখনই সৃজনশীল হয়ে ওঠে, যখন শিক্ষার্থী-শিক্ষক-গবেষক মুক্ত, সাবলীল। এই স্বাতন্ত্র্যই উৎকর্ষের প্রধান শর্ত।
অনেকে এ ক্যাম্পাসকে বলে গ্রিন ক্যাম্পাস। সারি সারি গাছ। যেন নিরাসক্তভাবে আকাশের পানে তাকিয়ে অনর্গল সবুজ ছড়াচ্ছে। উগরে দিচ্ছে ললিত সুবাস আর প্রকৃতির স্নিগ্ধতা। যেন সবুজ একটা কার্পেট বিছানো। এখানেই ঠাঁই পায় কত পাখি। ভোরবেলায় ভেসে আসে বিচিত্র সব ডাক। নাম না জানা পাখির কলতান। সবুজের বিস্তারের মাঝে বাহারি ফুল। বাতাসে মন মাতানো ফুলের গন্ধ। সূর্যমুখীর বাগান নাকি টিয়া পাখির ভীষণ পছন্দ। অনেক শিক্ষার্থীকে দেখেছি হলুদ রঙে মিশে গিয়ে টিয়ার সঙ্গে সেলফি তুলছে। সুন্দর থেকে আরও সুন্দর হয়ে উঠেছে সে। খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ে ‘গ্রিন’ শব্দের একটি ভিন্ন ব্যঞ্জনা আছে। অন্য এক জগৎ আছে। এখানে গড়ে উঠছে গ্রিন হাউস। প্রকৃতি বিজ্ঞানীদের এ এক উদ্ভাবনী ক্ষেত্র। সয়েল আর্কাইভে ধরা পড়ে নানা রকম ভূমির বৈচিত্র্য। লেকের পাড়জুড়ে গজিয়ে উঠছে সুন্দরী, গেরুয়া, পশুর, কাঁকড়ার মতো সুন্দরবনের নানা প্রজাতির গাছ।
দেখতে দেখতে সত্যিই ক্যাম্পাসটা বদলে গেল। ফাইন আর্টস স্কুলের উঠানটা কারুশিল্পের উদ্যান মনে হবে। খুদে শিল্পীদের রং তুলিতে আঁকা এ যেন এক স্বপ্নপুরী! এখানে একমনে এরা নির্মাণ করে চলেছে সৌন্দর্যের স্বপ্নসৌধ। অনুপম কারুকার্য খোচিত মসজিদ, স্নিগ্ধতায় ভরা মন্দির, আকাশছোঁয়া অ্যাকাডেমিক ভবন কিংবা কেন্দ্রীয় গবেষণাগার- সবখানেই শিল্প আর বিজ্ঞান হাতে হাত মিলিয়েছে। আর্কিটেকচার ডিসিপ্লিনে সময়ের বাঁধ নেই। দিনরাত সব সময় ল্যাব খোলা। ছাত্র-শিক্ষক একযোগে নিষ্পত্তি করে জটিল নকশার জট। ভিসি অ্যাওয়ার্ডস, ডিনস অ্যাওয়ার্ডস বা গবেষণা প্রণোদনা উচ্চ শিক্ষার বিশ^জনীন পরিবেশ সৃষ্টিতে নিয়ামক ভূমিকা রেখে চলেছে। সমকালীন সমাজ কিংবা বিজ্ঞান বিষয়ক ইস্যু নিয়ে সভা-সেমিনার আর বিভিন্ন স্কুলের আন্তর্জাতিক সম্মেলন শিক্ষার পুরো পরিবেশটাকে বিশ্বমানে পৌঁছে দিচ্ছে।
শিক্ষক গবেষণা করেন, সভ্যতা এগিয়ে চলে এমনই আলোক রেখার পথ বেয়ে। তবে পরিণতমনস্ক শিক্ষকগণই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন সংখ্যায়, প্রকল্পের আকারে। এখানে তা নয়, শুধু তরুণ শিক্ষকই নন, শিক্ষার্থীও শিক্ষকের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গবেষণা বরাদ্দ নিচ্ছেন। প্রতিজ্ঞা করছেন, ভালো কাজ করে সমাজের ঋণ তারা শোধ করবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কিছুু আক্ষেপ ছিল, আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে হয়তো তারা সঠিক জায়গা পাচ্ছেন না। এবার সে স্বপ্নও পূরণ হয়েছে। কিউএস ও টাইমস র্যাঙ্কিংয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয় মাথা তুলেছে অনেক পুরনো, প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠানকে পেছনে ফেলে। প্রতিবছর সহস্রাধিক গবেষণা নিবন্ধ মানসম্পন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ পায়। অনেক গবেষণা বিশ্বমানের। প্রচারবিমুখ এমন শিক্ষাবিদরা নীরবে, নিভৃতে কাজ করে চলেছেন এ বিশ^বিদ্যালয়ে।
কৃতী শিক্ষার্থীর অফুরন্ত জোগান দেয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। এদের দেশে যেমন খ্যাতি, বিদেশেও তেমন চাহিদা। ঝাঁকে ঝাঁকে ছাত্র-শিক্ষক বিদেশে যায়। অনেকেই দেশে ফেরেন না। চাকরি শেষেও তারা বিদেশেই থেকে যেতে চান। আমজনতার করের টাকায় দেশের আলোকিত সন্তানরা সমৃদ্ধ হচ্ছেন। তাদের মেধার ওপর দেশের দাবিই সবচেয়ে বেশি। এটাই সামাজিক দায়। এসব মেধাবী সন্তানের কাজের পরিসর তৈরি করা যেমন আমাদের দায়িত্ব, তেমনি এই মেধাবী ছেলে-মেয়েদের মনে যাতে দেশপ্রেম জেগে ওঠে- সেজন্যও আমাদের সুসংহত প্রচেষ্টা দরকার। এমন শিক্ষাই দরকার, যা নিজেকে মুক্ত করে, নির্মাণ করে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য কল্যাণকর হয়ে ওঠে।
লেখক : অধ্যাপক, ট্রেজারার
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়