ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

গুজবের ডালপালা

ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

প্রকাশিত: ২০:৪১, ২২ অক্টোবর ২০২৩

গুজবের ডালপালা

ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

বোকারা যেটা বোঝে না তা হলো সাম্প্রতিক যে মার্কিন স্যাংশন তা সরকারি দল বা দলের নেতাদের বিরুদ্ধে নয়, এই বিধিনিষেধ দলমত নির্বিশেষে শুধু তাদের জন্যই প্রযোজ্য, যে বা যারা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যে কোনোভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে। এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই, যদি আওয়ামী লীগকে হটিয়ে আগামী নির্বাচনে অন্য কোনো দল ক্ষমতায় আসে, তবে এই নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে। বরং এর উল্টোটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যতদূর জানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা স্যাংশন নীতি আজ পর্যন্ত কোনো দেশে কোনো কাজে আসেনি। এ দেশে যদি তারা তাদের এই নীতি প্রয়োগে তাদের মনের মতো ফল পেয়েই বসেন, তবে কোনো কারণ নেই যে, তারা সামনে এই নীতিতে কোনো ধরনের নমনীয়তা দেখাবে

বাংলাদেশের হালের রাজনীতিতে স্যাংশন এখন একটা বড় বিষয়। বরং বলা ভালো এটিই এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। এতটাই আলোচিত যে, একের পর এক মেগা প্রকল্পের উদ্বোধন আর রুশ ইউরেনিয়ামের উত্তাপকেও ছাপিয়ে মাঝে-মাঝেই পত্রিকায় হেডলাইন হচ্ছে স্যাংশন। আর স্যাংশন নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজবের ঝড়োগতিতে তো কুপোকাত, এমনকি মেট্রোরেল আর পাতাল টানেলও। কে ভিসা স্যাংশনে ধরা খেলেন আর কে না, এতে সুবিধা বেশি পাবে সরকারি দল না বিরোধীরা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা আর স্পেকুলেশনের ডানা এতটাই ছড়িয়েছে যে, তার কাছে ম্লান হয়ে যাচ্ছে এমনকি হযরত শাহজালালের তৃতীয় টার্মিনালও। আর গুজবগুলো ছড়াচ্ছেও বেশ।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ভিসা স্যাংশনের তালিকায় আছে অমন দু’-চারটে নাম সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাড়তে না পারলে সামাজিক মানমর্যাদায় যেন টান পড়ার জোগাড় হচ্ছে। ঢাকা থেকে কক্সবাজার অবধি বিস্মৃত যে নতুন রেললাইন, গুজবের ডানায় ভর দিয়ে স্যাংশনের ফাঁদে পড়া ব্যক্তিদের নামের তালিকা মুহূর্তেই ছাপিয়ে যাচ্ছে সেই দূরত্বকেও। এমনি একটা গুজবের সূত্রটা ধরেই এবারে লিখতে বসা।
কদিন আগে এক আড্ডায় একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির মুখে গুজবটা শুনলাম। ভদ্রলোক এমন দায়িত্ব নিয়ে গুজবটা ছড়াচ্ছিলেন যে, মনে হচ্ছিল নামটা বোধকরি তিনি এই মাত্র বাইডেন সাহেবের হোয়াটসঅ্যাপ টেক্সটে জানতে পারলেন। ভদ্রলোক বলছিলেন, সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নাকি এ দেশের এক অবসরপ্রাপ্ত প্রভাবশালী আমলার সে দেশে যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত সন্তানের ভিসা বাতিল করে তাকে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে! আর বেচারা আমলা ঠেলায় পড়ে মার্কিন মুল্লুকে চৌদ্দ লাখ মার্কিন ডলারে কেনা তার বাড়িটি মাত্র সাত লাখে ছেড়ে দিয়েছেন। শুধু তাই-ই না, টাকাটা নাকি হাতবদল হয়েছে ঢাকায়। গুজবটা শুনে প্রথমটায় ভাবছিলাম ভদ্রলোককে নিবৃত্ত করি, কিন্তু তার পরপরই মনে হলো ‘দরকারটা কি’? গুজবটা সত্যি হলেই তো দেশের মঙ্গল। দেশের চৌদ্দ লাখ তো পাচার হয়েই গেছে, এখন যদি সাত লাখ ফেরত আসে তাতে ক্ষতিটা কোথায়? 
বাংলাদেশ থেকে টাকা যে বিদেশে পাচার হয়, তা তো কেউই অস্বীকার করছে না। এমনকি সরকারি আইনজীবীও তো বিষয়টি দেশের সর্বোচ্চ আদালতে অস্বীকার করেননি। বরাবরই খেয়াল করেছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্যাংশনের বিষয়টি নিয়ে এতটুকুও বিচলিত নন। তিনি বারবারই বিষয়টিকে উড়িয়ে দিয়েছেন। কারণটাও স্পষ্ট। তার সময় সরকারের মাথায় তো পচন ধরেনি। প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর পরিবারের কোনো সদস্য কোনো ধরনের পাচার তো দূরে থাক, সামান্যতম দুর্র্নীতিতেও জড়িয়েছেন বা প্রশ্রয় দিয়েছেন, এমন কথা তো তার ঘোরতর নিন্দুকও বলতে পারবে না। এসব বিষয়ে এই পরিবারের স্বচ্ছতা আর আত্মবিশ্বাস এতটাই প্রবল যে, প্রধানমন্ত্রী তাঁর সাম্প্রতিক জাতিসংঘ সফরের সময় খোদ মার্কিন মুল্লুকের কলিজায় বসেই দারুণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এসব বিষয়ে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন।

স্যাংশন নিয়ে বিরোধীদের উচ্ছ্বাসের কারণটাও আমরা ভালোই বুঝি। রাজনীতির এক অস্থির সময় একটা অসুস্থ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্যান্টনমেন্টে বসে জেনারেলের বুটের ডগা থেকে যেই দলটির জন্ম, যার পচনের শুরুটা গোড়ায় না চূড়ায় আর যাদের শীর্ষ দুই নেতার বিরুদ্ধে টাকা চুরির অভিযোগ প্রমাণিত, যার সঙ্গত পরিণতিতে তারা কারাদ-ে দ-িত, সেই দলের নেতাদের কাছ থেকে এর থেকে সুস্থ কোনো চিন্তা তো আসলে প্রত্যাশা করাটা ঠিক নয়। চোর আর নেতা যে দলের কর্মীদের কাছে একে অপরের সমার্থক, তারা কিভাবে ভিসানীতির শানে নজুলটা বুঝবে? এদের কাছে নেতা মানেই দেশের টাকায় নিজের পকেট বোঝাই করা। আগা থেকে গোড়া অবধি পচন ধরা এদের নেতারা আজকের পরিবর্তিত পৃথিবীর পরিবর্তিত ভূ-রাজনীতির বাস্তবতা বুঝে ওঠার যোগ্যতাই রাখে না।

এদের ধারণা, মার্কিন ভিসা স্যাংশনে ভীত হয়ে যে সব শক্তিশালী মানুষ এ দেশ থেকে এক সময় বাইরে টাকা পাচার করেছে, তারা এখন সরকারবিরোধী শিবিরে ঝুঁকবে। বোকারা যেটা বোঝে না তা হলো সাম্প্রতিক যে মার্কিন স্যাংশন তা সরকারি দল বা দলের নেতাদের বিরুদ্ধে নয়, এই বিধিনিষেধ দলমত নির্বিশেষে শুধু তাদের জন্যই প্রযোজ্য, যে বা যারা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যে কোনোভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে। এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই, যদি আওয়ামী লীগকে হটিয়ে আগামী নির্বাচনে অন্য কোনো দল ক্ষমতায় আসে, তবে এই নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে। বরং এর উল্টোটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যতদূর জানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা স্যাংশন নীতি আজ পর্যন্ত কোনো দেশে কোনো কাজে আসেনি। এ দেশে যদি তারা তাদের এই নীতি প্রয়োগে তাদের মনের মতো ফল পেয়েই বসেন, তবে কোনো কারণ নেই যে, তারা সামনে এই নীতিতে কোনো ধরনের নমনীয়তা দেখাবে।
মাথাটা পচা বলেই এসব স্যাংশন নিয়ে ওদের এত মাথাব্যথা। আমার তো বরং ভিসা স্যাংশনের জন্য মার্কিনীদের ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছা হচ্ছে। তাদের দেশটা যদি চোরদের জন্য অনিরাপদ হয়ে ওঠে, তাতে তো আমাদেরই মঙ্গল। কারণ, আমাদের চোররা তখন আর তাদের চোরাই টাকা ওদেশে পাচার করে স্বস্তি পাবে না। যে কাজটা আমাদের করার কথা ছিল, অর্থাৎ দেশীয় চোরদের দেশ থেকে চুরি করা টাকা বিদেশে পাচারে বাধা দেওয়া, এই কাজটা যদি এখন মার্কিনীরা আগ বাড়িয়ে করে দেয়, তবে তাদের আর অতটা খারাপ বলি কিভাবে? ইরানের একদা পরাক্রমশালী শাহ্ মার্কিন চালে চেকমেট হয়ে একটি ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছিলেন। বলেছিলেন- ‘আমেরিকা যার বন্ধু তার কোনো শত্রুর প্রয়োজন নেই।’ এখন ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও মার্কিন এই দ্বৈত্ব নীতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

লেখক : অধ্যাপক, ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল 
হেপাটোলজি ডিভিশন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় ও 
সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

×