প্রসঙ্গ ইসলাম
কুরআনুল কারীমে সুন্দর করে বলা হয়েছে- ‘নিশ্চয় তোমাদের জন্য আল্লাহ্র রাসূলের (স.) জীবনচরিতে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।’ মুহাদ্দিস খতিব বাগদাদী (রহ.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাতে বলা হয়েছে রাসূলুল্লাহর (স.) জন্মের সময় আওয়াজ এলো, মুহাম্মদ (স.) কে দেশে দেশে ঘুরিয়ে আনো এবং সমুদ্রের তলদেশে নিয়ে যাও, যেন সমস্ত দুনিয়া তার নাম ও নিশানা চিনতে পারে, জিন-ইনসান, পশু-পাখি বরং প্রত্যেকটি প্রাণীর সম্মুখে তাঁকে নিয়ে যাও। তাঁকে আদমের (আ.) ব্যবহার, শীসের (আ.) তত্ত্বজ্ঞান, নূহের (আ.) সাহসিকতা, ইব্রাহীমের বন্ধুত্ব, ইসমাঈলের বাকশক্তি, ইসহাকের সন্তুষ্টি, সালেহর মধুর ভাষণ, লুতের (আ.) হিকমত, মুসার (আ.) কঠোরতা, আইয়ুবের (আ.) সবর, ইউনুসের (আ.) আনুগত্য, ইউশার জিহাদ, দাউদের (আ.) কণ্ঠ, দানিয়ালের প্রেম, ইলিয়াসের (আ.) গাম্ভীর্য, ইয়াহইয়ার চারিত্রিক পবিত্রতা ও ঈসার (আ.) কৃচ্ছ্র সাধনা দান কর এবং সকল পয়গম্বরের চরিত্রের মধ্যে তাঁকে নিমজ্জিত কর।’
যে সমস্ত আলিম এই হাদিসটিকে তাদের কিতাবে স্থান দিয়েছেন তাদের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ ইসলামের পয়গম্বরের সর্বব্যাপক গুণাবলিকে প্রকাশ করা। অর্থাৎ অন্যান্য নবীগণকে পৃথক পৃথকভাবে যা কিছু দান করা হয়েছিল, তা সব একত্রিত করে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে পুঞ্জীভূত করা হয়েছিল। প্রিয় নবী মুহাম্মদ (স.) মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন, সকল অবস্থায় মানুষের সুখ-দুঃখের ভাগি হতেন। মানুষকে এত আপন মনে করতেন এবং মানুষের সঙ্গে এত আপনজনের মতো মিলেমিশে চলতেন, ইতিহাসে তার নজির বিরল।
একবার হযরত আলী (রা.) প্রশ্ন করলেন, ‘হে আল্লাহ্র রাসূল, আপনার স্বভাবের বৈশিষ্ট্যাবলি উল্লেখ করুন। নবী মুহাম্মদ (স.) বললেন, ‘আল্লাহ্র মারিফাত বুদ্ধিমত্তা ও দূরদর্শিতা আমার ধর্ম, মানুষের প্রতি প্রেম ও ভালোবাসা আমার আদর্শের বুনিয়াদ, প্রত্যয় ও আস্থা আমার সম্পদ। চিন্তা গবেষণা আমার সাথী, জ্ঞান আমার অস্ত্র, ধৈর্য আমার ভূষণ, আল্লাহ্র সন্তুষ্টি আমার লক্ষ্য, বিনয় ও ন¤্রতা আমার মর্যাদা, তাকওয়া আমার পেশা, বিশ্বাস আমার শক্তি, সততা আমার সহযোগী ও পরামর্শদাতা, জিহাদ আমার কর্মতৎপরতা ও সালাত আমার নয়নের পুতলি।’ কোনো ব্যক্তি হযরত আয়েশাকে (রা.) আল্লাহ্র রাসূলের (স.) পারিবারিক জীবন, ঘরোয়া পরিবেশের আচরণ ও ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তদুত্তরে আয়েশা (রা.) বলেন, তিনি মানুষের মতোই একজন মানুষ ছিলেন।
নিজের কাপড়-চোপড় নিজেই দেখাশোনা করতেন। কাপড়ে পোকা মাকড় ও উকুন বসতে দিতেন না। বকরীর দুধ নিজেই দোহন করতেন। নিজের প্রয়োজনীয় কাজ নিজেই সমাধা করতেন। নিজের কাপড় নিজেই সেলাই করতেন, তালি লাগাতেন। নিজের জুতা নিজেই সেলাই ও পরিষ্কার করতেন। নিজেই বালতিতে রশি বেঁধে কুয়া থেকে পানি তুলতেন। নিজের বোঝা নিজেই বহন করতেন। গৃহপালিত জীবজন্তুকে নিজের হাতে খাদ্য পরিবেশন করতেন।
চাকর চাকরানির সঙ্গে নিজেই কাজে লেগে যেতেন। নিজেই বাজারে গিয়ে প্রয়োজনীয় সওদাপাতি খরিদ করে নিয়ে আসতেন। কোনো প্রকার সংকোচ বোধ করতেন না। নিজ হাতে আটা পিষতেন। একবার নবী দৌহিত্র হাসান (রা.) তার পিতা হযরত আলী (রা.) কে নানাজি মুহাম্মদ (স.) এর পারিবারিক জীবনের আচরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে হযরত আলী (রা.) বলেন, আল্লাহ্র রাসূল তার ঘরোয়া জীবনকে তিন ভাগে ভাগ করে ব্যবহার করতেন, একাংশ আল্লাহ্র বন্দেগিতে ব্যয় করতেন, একাংশ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথাবার্তা, স্নেহ মমতা, আদর যত্নে ও একাংশ আহার নিদ্রা ও আরামের জন্য ব্যয় করতেন। আরামের জন্য নির্ধারিত অংশের কিছু সময় আবার বহিরাগত লোকদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ ও আলাপ- আলোচনায় ব্যয়িত হতো। লোকদের অভাব অভিযোগ শুনতেন।
দেখা যেত যে, আরাম ও নিদ্রার জন্য শেষ পর্যন্ত খুব কম সময় বেঁচে থাকত। আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) পারিবারিক পরিবেশে অত্যন্ত সরল ও অকৃত্রিম জীবনযাপন করতেন। হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, একদা আমি আমার কক্ষে কিমার সঙ্গে আটা মিশিয়ে উপাদেয় খাদ্য প্রস্তুত করছিলাম। তাঁর অপর স্ত্রী সওদা তথায় উপস্থিত ছিলেন। রন্ধনকার্য সমাপ্তির পর আমরা খেতে বসলাম। রাসূলুল্লাহ্র (স.) একপাশে সওদা ও অপরপাশে আমি উপবিষ্ট ছিলাম। আমি সওদাকে আমাদের সঙ্গে খেতে বলাতে সে তিনবার অস্বীকার করল এবং কিছুতেই খাবে না বলে জিদ ধরল। আমি নাছোড় বান্দা। আমি বললাম, সওদা, তুমি না খেলে আমি তোমার মুখম-লে খাদ্য লেপটে দেব।
শেষ পর্যন্ত বারংবার অস্বীকার করার পর সত্যিই সওদার মুখমণ্ডলে কিমা ও আটা মিশ্রিত খাদ্য লেপটে দিলাম। আল্লাহ্র রাসূল (স.) হেসে দিলেন। দীর্ঘক্ষণ ধরে হাসার পর সওদাকে লক্ষ্য করে বললেন, এবার তুমিও তার মুখে খাবার লেপে দাও, তাহলে তো সমান সমান হয়ে যাবে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর এ অপরূপ ব্যক্তিজীবন সত্যিই উপভোগ্য ও অনুসরণযোগ্য।
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব
[email protected]