
বিশ্বে এখন সবচেয়ে বেশি রিজার্ভের মালিক চীন। তারপর জাপান। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ষোলোতম। আর বাংলাদেশের চৌষট্টিতম
বিশ্বে এখন সবচেয়ে বেশি রিজার্ভের মালিক চীন। তারপর জাপান। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ষোলোতম। আর বাংলাদেশের চৌষট্টিতম। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ সরকারের সময়ই প্রথম রিজার্ভ এক হাজার এক শ’ কোটি ডলারের ঘর পেরিয়েছে। আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাড়ার পরও গত ক’ বছরে কয়েকবার রিজার্ভ এক হাজার এক শ’ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে
ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী নিজের শাসনকালকে বলতেন, ‘একুশ শতকে নতুন ভারত গড়ার স্বপ্নের প্রাক-প্রস্তুতি।’ ওই প্রস্তুতি পর্বে তিনি দুটো স্বপ্নের বাস্তব ভিত দিয়েছিলেন। এক. আধুনিক টেলিযোগাযোগের সূচনা, দুই. কম্পিউটার ব্যবস্থা চালু। একুশ শতকের দুই দশক পেরিয়ে সারাবিশ্বের সঙ্গে ভারতও রাজীবের সেদিনের সে স্বপ্ন বীজের প্রবল পরাক্রমশীলতা দেখছে মোবাইল ফোন ও তথ্যপ্রযুক্তির বিকশিত মহীরুহ রূপে। যে দলের পতাকা নিয়ে রাজীব ক্ষমতায় এসেছিলেন সেই কংগ্রেসের সাংগঠনিক কাঠামো তখন নানা অন্তর্দ্বন্দ্বে বিধ্বস্ত। তা নিয়েই যাত্রা শুরু“করেছিলেন তিনি। আগামীর স্বপ্ন এবং তা বাস্তবায়নের পথ কেটে এগোচ্ছিলেন। তরুণ প্রধানমন্ত্রী তারুণ্যের টেম্পারমেন্ট বুঝতে পেরেই সম্ভবত নতুন শতকের জন্য প্রস্তুতির লড়াই শুরু“করেছিলেন।
কিন্তু ‘বোফোর্স’ কেলেঙ্কারির দাগ শেষমেশ তার সাফল্যের গায়ে কালি মেখে দিয়েছিল। আজও রাজীব গান্ধী নামটির সঙ্গে ‘বোফোর্স’ শব্দটি প্রচ্ছন্নে মিশে আছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের এটি এক অনিবার্য অভিশাপ? ঢাকঢোল পিটিয়ে ফুলের মালা দিয়ে যাকে বরণ করে নেওয়া, সময়ের পরম্পরায় তাকেই আবার গার্বেজে ছুড়ে ফেলা। দুঃখজনক হলো ক্ষমতায় গিয়ে এ ভবিতব্যের কথা অনেকেই ভুলে যান।
ভারতে রাজীব গান্ধী নতুন শতকের প্রস্তুতির স্বপ্ন বুনেছিলেন, বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সেই শতকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্ন দেখালেন। তাঁর স্বপ্নের ছোঁয়ায় জেগে ওঠে দেশের মানুষ। ভোটের জোয়ারে ভাসিয়ে তারা ডিজিটাল বাংলাদেশের পক্ষে রায় দেন। তাদের এ আস্থার ভিত্তি ছিল চমৎকার এক ম্যানিফেস্টো ‘দিন বদলের সনদ।’ তিন টার্মে তারা এখন হিসাব কষে দেখতে চাইছেন কতটা বদল হলো তাদের দিন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে- ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে অনেকটাই। তুলনামূলক বিশ্লেষণে এ সরকারের সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থায় প্রবৃদ্ধি এসেছে রেকর্ড পরিমাণ। কোনো দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার অন্যতম শর্ত তার রিজার্ভ ব্যবস্থা।
বিশ্বে এখন সবচেয়ে বেশি রিজার্ভের মালিক চীন। তারপর জাপান। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ষোলোতম। আর বাংলাদেশের চৌষট্টিতম। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ সরকারের সময়ই প্রথম রিজার্ভ এক হাজার এক শ’ কোটি ডলারের ঘর পেরিয়েছে। আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাড়ার পরও গত ক’ বছরে কয়েকবার রিজার্ভ এক হাজার এক শ’ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে।
জিডিপি ও মাথাপিছু আয়েও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। আগের সরকারের প্রথম তিন বছরে জিডিপির হার ছিল যথাক্রমে শতকরা চার দশমিক চার। পাঁচ দশমিক তিন ও ছয় দশমিক তিন ভাগ। এ সরকারের প্রথম তিন বছরে অর্জন শতকরা পাঁচ দশমিক সাত, পাঁচ দশমিক আট ও ছয় দশমিক সাত ভাগ। আগে মাথাপিছু জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল শতকরা উনিশ ভাগ। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা চব্বিশ ভাগ। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে ভর করে দেশের রিজার্ভ শক্তিশালী হচ্ছে। রেমিটেন্স সত্যিই পাল্টে দিচ্ছে গ্রাম-বাংলার অর্থনৈতিক চিত্র। অন্ধকারে নিমজ্জিত গ্রামগুলো এখন আলোর মুখ দেখছে। গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ঘটছে। রেমিটেন্স দেশের অর্থনীতির মেরুদ- শক্ত করছে।
সাফল্যের খতিয়ান আরও দেয়া যায়, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও কৃষি খাতে প্রকৃত মজুরি বাড়া গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। আগে একজন দিনমজুর তার একদিনের আয় থেকে পাঁচ থেকে ছয় কেজি চাল কিনতে পারতেন, এখন চালের দাম বাড়ার পরও দশ থেকে বারো কেজি চাল কিনতে পারেন। শ্রমজীবী মানুষের আয় বেড়েছে। কৃষি খাতে নানা ধরনের প্রণোদনা, ভর্তুকি, কৃষকদের কৃষিঋণের আওতায় আনা, সার-ডিজেলের দাম কমানো, বিনামূল্যে সেচ সুবিধা দেওয়া, কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড, দশ টাকায় অ্যাকাউন্ট খোলা ইত্যাদি অনেক ইতিবাচক উদ্যোগ সরকার নিয়েছে। এবং এর ফলও মানুষ পেতে শুরু“করেছে। প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে সঠিক সময়ে বই বিতরণ করে অকুণ্ঠ প্রশংসা কুড়িয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। বিভিন্ন স্তরে জিপিএর প্রাবল্যও তাঁকে প্রশংসিত করেছে। বিদ্যুতে কুইক রেন্টাল নিয়ে তর্কবিতর্ক চললেও মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে। যদিও সেজন্য বাড়তি দাম গুনতে হচ্ছে। তবু অতীতের সেই লাগাতার অন্ধকারাচ্ছন্নতা থেকে মুক্তি মিলছে এ-ই অনেক বড় স্বস্তির।
কিন্তু এসব অর্জনকে ম্লান করে দিয়ে সরকারের ইতিবাচক ভাবমূর্তির পথ রোধ করছে নানা ধরনের দুর্নীতি। সমস্যা আছে সিদ্ধান্ত নেয়ার জায়গায়ও। কিছু অপ্রয়োজনীয় ইস্যুতে জড়িয়ে অযথাই জনপ্রিয়তার গোড়ায় আঘাত হানছে। আর তা শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও। বর্তমান একতরফা পুঁজিবাদী বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়েই চলতে হবে। এ অঞ্চলের ভূরাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আন্তর্জাতিক নানা রাজনীতি। বাংলাদেশ এখন অনেক রাঘব বোয়াল দেশের মনোযোগের কেন্দ্রে। সুতরাং রাজনীতিকদের আচার-আচরণ কথা বলায় অনেক কৌশলী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। সরকারের অনেক হেভিওয়েট মন্ত্রী-আমলারা কথাবার্তায় মাঝে মাঝেই মারাত্মক ‘বিপ্লবী’ হয়ে ওঠেন।
তারা ভুলে যান বিশ্বে এখন পুঁজিবাদের পোলারাইজেশন চলছে এবং ওতেই তারা আকণ্ঠ নিমগ্ন। মাঝে মাঝে গলা তুলে ফাঁপা আওয়াজ দেয়ার চেষ্টা তাদের ব্যর্থতা বা কূপম-ূকতাকেই প্রকট করে। কোনো বড় ধরনের ঘটনা ঘটলে মন্ত্রী-আমলারা নিজের মতো করে মত দিতে থাকেন। যে যা ভাবছেন অবলীলায় তাই বলে যান। সে প্রসঙ্গে যার বলার এখতিয়ার নেই তিনিও ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন দেখে দিশেহারা হয়ে যান। দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু মানুষ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে যখন ধরা পড়ে এবং দেখা যায় তার সঙ্গে সরকারের হোমরা-চোমরাদের কেউ কেউ জড়িত তখন দ্রুত তারা সেফ সাইডে চলে যান। মানুষ যখন এসব দুর্নীতির পরিষ্কার তদন্ত চায় সরকারের আচরণ তখন ভীষণ রকম দুর্নীতিবান্ধব হয়ে যায়। এতে একদিকে কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতরা আরও উৎসাহ পায়, অন্যদিকে সরকারের প্রতি বিরূপ মনোভাব আরও মজবুত হয়।
এ মেয়াদে সরকারের হাতে আর বেশি সময় নেই। নীতি দুর্নীতির আমলনামা ভোটারদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। ক্ষমতার রাজনীতিতে বারবার ক্ষমতায় যাওয়ার ইচ্ছে থাকবেÑ তাই স্বাভাবিক। স্বাভাবিকভাবে এ সরকারেরও তা আছে। তাই ভোটারদের খুশি রাখার কাজটি তাদের এ সময়ের মধ্যেই করতে হবে।
ভোটারদের মন বুঝতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে চৌত্রিশ বছরের শক্তিশালী বামফ্রন্টকে উড়িয়ে দিল দুদিনের তৃণমূল- সে ওই ভোটারের মন বুঝতে না পারার জন্যই মূলত। বদলাতে হয় নিজেদের চরিত্রও। চোরকে চোর বলে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সবাই চোর নয়, ভালো যারা তাদের যোগ্য জায়গা দিতে হবে। সততার ইমেজ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তা শুধু কথায় হবে না, কাজে দেখাতে হবে। আর রাজনীতিতেও অবসর প্রথা চালু করা দরকার। কিছু রাজনীতিবিদের বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া উচিত। নবীন শিক্ষিত আধুনিকমনা সদস্য রিক্রুট করার দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে।