ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

খাদ্যপণ্যের সাপ্লাই চেন

মোঃ হুমায়ুন খালিদ

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ৪ অক্টোবর ২০২২

খাদ্যপণ্যের সাপ্লাই চেন

খাদ্যপণ্যের সাপ্লাই চেন

কোভিড-১৯ এর দীর্ঘ প্রভাবে বিশ্বে দৈনন্দিন জীবনের সবক্ষেত্রেই কমবেশি অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন এসেছে। তবে জীবনের অস্তিত্বের জন্য এর সঙ্গে খাপ খাওয়াতেই হচ্ছে। নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে চলতে সর্বদিক দিয়েই সমাজের বড় একটি অংশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মূল্য হিসেবে ইতোমধ্যে হারাতে হয়েছে অনেক মূল্যবান মানুষকে। বর্তমানে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাশিয়া ও ইউল্ডেনের মধ্যকার যুদ্ধজনিত কারণে জ্বালানি ও খাদ্য সঙ্কট। প্রতিটি দেশেই দেখা দিয়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতি। বিশ্ব অর্থনীতিবিদরা বলছেন যে, বর্তমান মূল্যস্ফীতিকে ঠেকানো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পরিস্থিতি সামলানোর চেয়েও কঠিন। সঠিক নির্দেশনার অভাবে এখন মুক্তির পথ বের করা প্রায় অসম্ভব।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে চরম খাদ্য ঘাটতি। বলাবাহুল্য, উন্নয়নশীল ও জনবহুল দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের ওপর এর প্রভাব অনেক বেশি পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ খাদ্য ঘাটতি আরও অনেক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া এই মুহূর্তে আমদানিভিত্তিক খাদ্য সংস্থার ওপর ভরসা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হবে। কারণ, ধনী-গরিব সব দেশের ক্ষেত্রে কমবেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই।

এই অবস্থায় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্য সংরক্ষণ, খাদ্য সরবরাহ সচল রাখা খুবই জরুরী। এ প্রসঙ্গে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি একটু সময় সাপেক্ষ বিষয় হলেও বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতেই হবে। একই সঙ্গে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থার (ঝঁঢ়ঢ়ষু পযধরহ ংুংঃবস) দিকে বিশেষভাবে নজর দেয়া প্রয়োজন।
কারণÑ
প্রথমত : ইতোপূর্বে উৎপাদিত খাদ্যপণ্য যেখানে যে অবস্থায় সংরক্ষিত আছে, তার সঠিক সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে ইতোমধ্যে সৃষ্ট সঙ্কট, বিশেষ করে মূল্যবৃদ্ধিজনিত সঙ্কট মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।
দ্বিতীয়ত : যে কোন সঙ্কটকালে সমাজের সুবিধাজনক শ্রেণি সেই সঙ্কটকে পুঁজি করে নানাভাবে  বেশি পরিমাণে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করে। খাদ্যপণ্য সরবরাহের বেলায়ও তাই। কারণ, খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাটি সুবিধাবাদী মধ্যস¦ত্ব¡ভোগী পাইকার এবং খুচরা বিক্রেতাদের হাতে বন্দী। এ অবস্থায় দেশীয় খাদ্যপণ্য বেশি বেশি উৎপাদনের পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি বর্তমান মজুদ এবং ভবিষ্যতের উৎপাদিত খাদ্যপণ্যের সুষম নিয়ন্ত্রিত সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কোন বিকল্প নেই।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, খাদ্যপণ্যের অযৌক্তিক যে মূল্য বৃদ্ধি ঘটে তা সাপ্লাই চেনের মাঝামাঝি স্তরে যারা জড়িত যেমন- ট্রেডার্স, কমিশন এজেন্ট, পাইকারি বিক্রেতা ও খুচরা বিক্রেতা তাদের হাতেই বৃদ্ধি পায়। ফলে, উৎপাদকগণ কম দামে তাদের পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে ভোক্তা-সাধারণ বেশি দামে ক্রয় করে। এ প্রেক্ষিতে খাদ্য দ্রব্যের সাপ্লাই চেন ব্যবস্থাপনা বর্তমানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বহুদেশেই খাদ্যদ্রব্যের সাপ্লাই চেন ম্যানেজমেন্ট একটা গুরুত্বপূর্ণ অধিক্ষেত্র হিসেবে বিবেচ্য। অর্থ্যাৎ খাদ্যদ্রব্যসহ সকল পণ্যের সাপ্লাই চেন এখন অধিকাংশ দেশে সংগঠিত রূপ ধারণ করেছে।

এতে উৎপাদকের ন্যায্য দাম, ভোক্তাদের ন্যায্য মূূল্য এবং খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা প্রায় নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। বাজার মূল্যমানের স্থিতিশীলতা, ব্যবসায় দক্ষতা বৃদ্ধি, দেশের সর্বত্র খাদ্যপণ্যের সুষম চলাচল, ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিভিন্ন স্তর সৃষ্টি হওয়া, নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হওয়া, পরিপূরক ও বিকল্প পণ্যের বিকাশ, উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতার বিকাশ, সুপ্ত প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি, নতুন নতুন ব্যবসায়ের জন্ম, উৎপাদক, বাজারজাতকারী, পরিবহনকারী ও ভোক্তাদের মধ্যে কার্যকর ও টেকসই মিথস্ক্রিয়া ইত্যাদি   ক্ষেত্রে খাদ্যপণ্যের সাপ্লাই চেন ম্যানেজমেন্ট কমবেশি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। এসব বিষয় বিবেচনায় এক কথায় বলা যায় যে, খাদ্যপণ্য ঘাটতি থাকলেও সংগঠিত ও সদা কার্যকর উত্তম সাপ্লাই চেন সিস্টেম খাদ্য পণ্যের স্থিতিশীলতা রাখতে বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের অসংগঠিত বাজার ব্যবস্থাপনা বা সাপ্লাই চেনের কারণে উৎপাদন পর্যায়ে প্রায় ২০% অপচয় ঘটে। এই অপচয়ের মূল কারণ হচ্ছে-
১) অপরিপক্ব/অদক্ষ হাতে খাদ্যপণ্য হ্যান্ডেলিং;
২) মাত্রাতিরিক্ত এবং অপরিমিতভাবে সার ও বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের প্রয়োগ;
৩) অপরিমিত লজিস্টিক সাপোর্ট;
৪) জ্ঞানের স্বল্পতা;
৫) সাপোর্টিং যন্ত্রপাতি ও সার্ভিস ঘাটতি;
৬) সংরক্ষণ সুবিধার স্বল্পতা;
৭) যাতায়াত ব্যবস্থার ত্রুটি ইত্যাদি।
উপর্যুক্ত অপচয় ছাড়াও পোস্ট হার্ভেটিং পিরিয়ডে আরও নানাভাবে প্রায় ২০-৩০% ক্ষতি (ষড়ংং) ঘটে থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় খুচরা বিক্রেতাসহ বিভিন্ন মধ্যস¦ত্বভোগীদের অনিয়ন্ত্রিত দৌরাত্ম্য। এ অবস্থায় উৎপাদকগণ প্রকৃতপক্ষে যে দাম পায় তার চেয়ে ৬০-৮০% বেশি দামে ভোক্তা সাধারণ পণ্য ক্রয় করে থাকে।
এ প্রেক্ষাপটে উৎপাদকগণ একদিকে ক্ষতিগ্রস্ত এবং অনুৎসাহিত, আবার অন্যদিকে ভোক্তাসাধারণ চরমভাবে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। এ অবস্থাই দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে চরম ভোগান্তির জন্ম দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায় মধ্যস¦ত্বভোগীদের প্রভাব প্রধানত নি¤েœাক্ত কারণগুলোর জন্য হয়ে থাকে -
১) বাংলাদেশের কৃষকগণ যুগ যুগ ধরে মধ্যস¦ত্বভোগী ট্রেডার্স ও কমিশন এজেন্টদের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিধায় কৃষকগণ প্রায় ক্ষেত্রে তাদের নিকট থেকেই আগাম ঋণ গ্রহণ করে থাকে ;
২) বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কৃষকগণ স্থানীয় পরিবহন মালিকদের সাহায্য না নিয়ে পারে না এবং তারা এভাবেই অভ্যস্ত ;
৩) সরবরাহ ব্যবস্থা, অপচয়, সার-রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারী ও বেসরকারী সংস্থাগুলোর উৎসাহ-উদ্যোগ অনেক কম;
৪) সাপ্লাই চেন ম্যানেজমেন্ট স্থাপনসহ এ বিষয়ে বিধি-নির্দেশ প্রদানের নজির খুব একটা চোখে পড়ে না, যা দেখা যায় তা দুুর্যোগকালে ক্ষণিকের তরেই দেখা যায়;
৫) লক্ষণীয় যে, খাদ্যপণ্য সরবরাহ ব্যবস্থার মধ্যে মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে বিদ্যমান ট্রেডার্স কমিশন এজেন্ট, পাইকারি বিক্রেতা ও খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যে একটা অলিখিত সিন্ডিকেট জগদ্দল পাথরের মতো বিদ্যমান এবং
৬) এই অবস্থা দেখভাল করার জন্য কেউ বা কোন সংস্থা দৃশ্যত নেই।
বাস্তবতা হচ্ছে, এই সকল বিষয় দেখভাল করায় যারা থাকেন তাদের অনেকেই আবার আইন প্রণয়ন, নীতিনির্ধারণ ও মনিটরিংয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত।
সুতরাং দেখা যায় যে, উক্ত মধ্যস্বত্বভোগীরাই মূলত দুর্বল ও অসংগঠিত সাপ্লাই চেন সিস্টেম এবং সমন্বয়ের অভাবের জন্য দায়ী। আবার এ সিন্ডিকেট প্রয়োজনীয় কোন তথ্য তৃতীয় কোন পক্ষের সঙ্গে শেয়ার করে না। তথ্য প্রবাহের এ ঘাটতিও উক্ত অসংগঠিত সাপ্লাই চেন ব্যবস্থার জন্য দায়ী।
উপর্যুক্ত বর্ণনা থেকে অনুমেয় যে, আমাদের দেশে বিশেষ করে খাদ্যপণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় কিভাবে উৎপাদকগণ ঠকে এবং কিভাবে ভোক্তাসাধারণ অন্যায়ভাবে অতিরিক্ত মূল্যে পণ্য ক্রয় করে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।
এ পরিস্থিতিতে একেবারে অপরিহার্য কারণেই খাদ্য পণ্যের সাপ্লাই চেন সিস্টেমে যে কোন মূল্যে হস্তক্ষেপ করতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সাপ্লাই চেন ম্যানেজমেন্ট করে মুনাফা অর্জনের সুযোগ থাকায় ব্যক্তিগত ও সরকারী খাতের কয়েকটি কোম্পানি সংগঠিত ব্যবসায় বিনিয়োগ শুরু করেছে।
এ সকল কোম্পানিকে নি¤œরূপভাবে ৩টি শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে :
১) কো-অপারেটিভ সাপ্লাই চেন মডেল;
২) কলাবরেটিভ সাপ্লাই চেন মডেল; এবং
৩) কন্ট্রাক্ট ফার্মিং চেন মডেল।
উক্ত ৩টি মডেলেই পণ্যমূল্য হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে। এ সকল মডেল বাংলাদেশেও প্রয়োগ করা সম্ভব এবং কিছু কিছু প্রয়োগও হচ্ছে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে সর্বত্র আরও ব্যাপকভাবে প্রয়োগ দরকার। বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনা করলে এ মুহূর্তে বাংলাদেশে খাদ্যপণ্য সাপ্লাই চেন ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে কো-অপারেটিভ সাপ্লাই চেন মডেলই বেশি কার্যকর হবে। কারণ, সারাদেশেই সমবায় ব্যবস্থা কমবেশি কার্যকর এবং উৎপাদন থেকে ভোক্তা-সাধারণ পর্যন্ত বিস্তৃত। কো-অপারেটিভ মডেলটির সঙ্গে উৎপাদক ও ভোক্তা-সাধারণ সরাসরি জড়িত কিন্তু অন্য ২টি মডেলে তা নয়।

তবে কো-অপারেটিভ মডেলটি প্র্যাকটিস করতে হলে বর্তমান সমবায় ব্যবস্থার কিছু সংস্কার করার দরকার হবে। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর সমবায় মডেল অর্থাৎ সার্বিক সমবায় মডেলকে গ্রহণ করা যেতে পারে। অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায় যে, কো-অপারেটিভ মডেল খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে উৎপাদক, কৃষকের একসঙ্গে পণ্য সংরক্ষণ, পরিবহন প্রক্রিয়াকরণ, বাজারজাতকরণসহ খুুচরা বিক্রেতার দায়িত্বও পালন করতে পারে। অর্থাৎ মার্কেটিংয়ের সকল স্তরে কাজ করে সমবায় মডেল মধ্যস¦ত্বভোগীদের প্রভাব দূর করতে সক্ষম। অন্ততপক্ষে কমিশন এজেন্ট স্তরটি দূর হবেই।

উল্লেখ্য যে, এই সকল মডেল প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভারতে সরকারের ইতিবাচক হস্তক্ষেপ রয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর কোন ব্যত্যয় ঘটার সম্ভাবনা নেই। কারণ, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এ বিষয়ে বেশি আন্তরিক।
বর্তমানে দেশে যখন খুশি খাদ্যপণ্যসহ অন্যান্য পণ্যের মূল্য অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি করার পরিস্থিতি সামাল দেয়ার লক্ষ্যে যথাসম্ভব দ্রুত উপর্যুক্ত ৩টি মডেলই প্রয়োগ শুরু করা প্রয়োজন। এজন্য প্রথমেই নিয়ে আসতে হবে কো-অপারেটিভ মডেলকে। অন্তত পরীক্ষামূলকভাবে হলেও জাতীয় স্বার্থে এখনই শুরু করা দরকার।

লেখক : সমবায় অধিদফতরের সাবেক নিবন্ধক ও অবসরপ্রাপ্ত সচিব

×