ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ঘটনাবহুল মহরম ও আশুরার তাৎপর্য

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৫৫, ৮ আগস্ট ২০২২

ঘটনাবহুল মহরম ও আশুরার তাৎপর্য

পবিত্র আশুরা

আজ পবিত্র আশুরা বা মহরম মাসের দশম তারিখমুসলিম ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতিতে মহরম, আশুরা ও কারবালা অতি ব্যাপক অর্থবোধক তিনটি পরিভাষাইসলামী মূল্যবোধে এ তিনটির প্রভাবও বেশ সুদূরপ্রসারীহাদিস শরীফে একক দিন হিসেবে আশুরার যে তাপর্য বর্ণিত হয়েছে তার সারসংক্ষেপ হলো- এ পবিত্র দিনে আল্লাহ্ তায়ালা অসংখ্য নবী-রাসুল দুনিয়ার মানুষের কল্যাণে বিভিন্ন সময় আবির্ভূত করেছেনআশুরার দিনে আল্লাহ্ সুবহানাহু তায়ালা আসমান-যমিন, পাহাড়-পর্বত, তারকারাজি, আরশ-কুরসি, লওহে মাহফুজ ও ফেরেশতাদের সৃষ্টি করেনএদিন আদম, হাওয়াকে (আ.) সৃষ্টি করা হয়েছেএ দিনেই তাদেরকে বেহেশতবাস দেয়া হয়

আবার এ দিনেই তাদেরকে বেহেশত থেকে নির্গত করে দুনিয়ায় প্রেরণ করা হয়এদিন অন্তত দুহাজার পয়গাম্বর জন্মগ্রহণ করেন এবং অন্তত ২ হাজার পয়গাম্বর ওফাতপ্রাপ্ত হনহযরত আদম-হাওয়ার তাওবা কবুল হয়েছিল এদিনেআর অঝোর ধারায় রহমতের বৃষ্টির সূচনা হয়েছিল এদিনেপৃথিবী ধ্বংসপ্রাপ্তও হবে এদিনেমহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.) কে এদিনেই চিরতরে নিষ্পাপ ঘোষণা করা হয়েছিলএদিনেই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পৃথিবীকে বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে সাজিয়েছেন, আবাসযোগ্য করেছেনআল্লাহ তাঁর অনেক পেয়ারা বান্দাকে এদিন তাঁর করুণাসিক্ত করেছেনএদিন নমরুদ কর্তৃক ইবরাহিম নবী (আ.) এর জন্য তৈরি অগ্নিকু-কে আল্লাহতায়ালা শান্তির গুলিস্তায় পরিণত করেছিলেন

এদিন ইউনুস নবী মাছের উদর থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন, ইয়াকুব নবী ফিরে পেয়েছিলেন তার প্রাণের দুলাল ইউসুফ (আ) কেআবার এদিন ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে অনেক দাম্ভিক, খোদাদ্রোহীকে শাস্তি দান করেছেনএ দিন মুসা নবী (আ.) কে তাড়াতে গিয়ে নীল নদে কুখ্যাত ফেরাউনের সলিল সমাধি ঘটেছিলঅর্থা একক দিন হিসেবে এত ঘটনাবহুল অবিস্মরণীয় দিবস পৃথিবীর ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি নেই

মহরম ও আশুরার যাবতীয় শিক্ষা শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, আহলে কিতাব তথা ইহুদী-খ্রীস্টানদের জীবনকেও প্রভাবিত করেতাই দেখা যায়, ইহুদী ধর্মেও এদিনকে উপলক্ষ করে রোজা রাখার প্রথা রয়েছেবুখারী শরীফের ২০০৪নং হাদিসে আছে যখন নবীজী (সা.) মদিনা হিজরত করেন তখন তিনি দেখলেন এদিন ইহুদীরা রোজা রাখছেতিনি এর কারণ জানতে চাইলেনতারা জানালো হাজা ইয়ামুন সালেহ- এ এক মহান দিন, এদিন আল্লাহ নবী মুসা ও বনী ইসরাইলকে শত্রু ফেরাউন থেকে নীল নদের ওপারে নিয়ে নাজাত দিয়েছিলেনতাই আমরা সে ঘটনা স্মরণ করে রোজা রাখি

তখন আমাদের নবীজী বলেছেন- আনা আহাক্কু মিনকুম- আমি তো তোমাদের চেয়েও মুসা (আ.) এর অধিক ঘনিষ্ঠসুতরাং আমরাও রোজা রাখবতখন থেকে মুসলমানরা ইহুদী সম্প্রদায়ের একটি রোজা রাখার স্থলে দুটি রোজা রাখতেননবীজী (সা.) আরও ইরশাদ করেছেন আল্লাহ যদি আমাকে হায়াতে রাখেন তাহলে আমি মহরমের ৯ তারিখও রোজা রাখবএখান থেকে বুঝতে পারলাম মহরমের ৯ ও ১০ তারিখ রোজা রাখা ছিল মহানবী (সা.)-এর প্রিয় আমল

উম্মতে মুহাম্মদীর কাছে এদিনটি আরও একটি বিশেষ কারণে অবিস্মরণীয়৬১ হিজরীর এদিনে নুরনবী হযরত মুহম্মদ (সা.) এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, হযরত আলী-ফাতিমা (রা.) এর দ্বিতীয় পুত্র ইমাম হুসাইন (রা.) এবং নবী পরিবারের প্রায় সকল পুরুষ ও সদস্য কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে মর্মান্তিকভাবে শাহাদাতবরণ করেনএ হৃদয় বিদারক ঘটনা আশুরাকে দান করেছে এক নতুন তাপর্যবস্তুত কারবালার ঘটনাটি ছিল হক ও বাতিলের সংঘাত

যুগে যুগে নবী-রাসুলগণের মিশন ছিল বাতিল আর মিথ্যার ওপর সত্যের দাওয়াতকে বুলন্দ করাআখেরি নবী হযরত মুহম্মদ (সা.) এর ওফাতের পর এর দায়িত্ব বর্তায় তার যোগ্য উত্তরসূরিদের ওপরখোলাফায়ে রাশেদীন এ দায়িত্বের আঞ্জাম দেনতারা কুরআন ও হাদিসের আলোকে প্রবর্তিত মহানবীর (সা.) শরীয়তকে সবধরনের বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করেনতাদের তিরোধানের পর এক শ্রেণীর ষড়যন্ত্রকারী ইসলামী শরীয়তকে বিকৃত করতে থাকেতারা নিষ্কলুষ শরীয়ত ও খিলাফতকে গোত্রীয় বন্দীশালায় আবদ্ধ করে ফেলতে চায়যার পরিণতিতে উদ্ভূত হয়েছিল কারবালার ঘটনাইমাম হুসাইন (রা.) এর একটি ভাষণ থেকে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে

তার ভাষায়- যে ইসলামী পন্থাকে অবনমিত করেছে, হয়েছে প্রমোদ বিহারী, যার দরবারে স্বাধীনতা নেই, যে অবৈধকে বৈধ করেছে এবং দুর্বল-দারিদ্র্যের জীবনযাত্রা দোজখের পর্যায়ে নামিয়ে দিয়েছে আমি তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশে প্রস্তুত নই...তাই তিনি জালিমের রক্ত চক্ষুকে আর ভয় না করে নিজের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের দিকে মনোনিবেশ করেনআসলে সেদিন তিনি যদি অন্যায় কাজে সামান্যতমও আপোস করতেন তাহলে ইতিহাস হতো আজ অন্য রকমকিন্তু ইমাম হুসাইন ৭২ জন সঙ্গীসাথীসহ শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করে মুসলমান ও দুনিয়াবাসীর সামনে দেখিয়ে গেছেন অন্যায়ের প্রতিবাদের প্রকৃত ভাষা ও যুগ সন্ধিক্ষণে বীর পুরুষদের ভূমিকা কি হওয়া উচিত

ইতিহাস বলছে, ৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে আমীরে মুয়াবিয়া তার অযোগ্য পুত্র দুরাচারী ইয়াজিদকে খেলাফতের মতো পবিত্র মসনদের উত্তরাধিকারী মনোনীত করেনমুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর ইয়াজিদ খেলাফত গ্রহণ করলে গোটা উম্মাহর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও উত্তেজনা দেখা দেয়উপরন্তু ইয়াজিদ সে যুগের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ইমাম ও ব্যক্তিত্ব হুসাইন (রা.) কে তার হাতে বায়াত হতে নির্দেশ দেনআল্লাহর রাসুলের প্রিয় দৌহিত্র অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে ও ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং ইয়াজিদের  অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেনএদিকে কুফাবাসী সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে তাকে সেখানে আগমনের অনুরোধ করেন

একপর্যায়ে ইমাম হুসাইন (রা.) যখন কুফার উপকণ্ঠে পৌঁছেন তখন দেখা গেল সাহায্যের আশ্বাসদাতা কুফাবাসীগণ তাদের প্রস্তাব থেকে সরে যায়অগত্যা নিরুপায় হয়ে ইমাম হুসাইন (রা.) যখন তার স্বল্পসংখ্যক বন্ধু ও সমর্থক নিয়ে ফোরাত নদীর উপকূলে কারবালায় পৌঁছেন তখন ইয়াজিদ বাহিনীর সদস্য ওমর ইবনে সাদ, ওবায়দুল্লাহ প্রমুখ তার গতিরোধ করে এবং তাকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়মহান ইমাম পবিত্র ইসলাম ও নানাজী হযরত মুহাম্মদের আদর্শের পরিপন্থী কোন কর্মকা-ে সাড়া দিতে পারেন নাএকপর্যায়ে  ইয়াজিদ বাহিনী তাদের ওপর হামলা চালাতে থাকলে তারা মৃত্যুকে পরওয়া না করে ইয়াজিদ বাহিনীর সঙ্গে শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে যুদ্ধ করে যান৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর ইয়াজিদ  সেনারা ইমাম হুসাইনের সঙ্গী-সাথী ও পরিবার-পরিজনের শিবিরে ফোরাতের পানি নেয়া বন্ধ করে দেয়এতে গোটা শিবিরে হাহাকার পড়ে যায়

এ যুদ্ধে ভ্রাতুষ্পুত্র কাশেম প্রথম শাহাদাতবরণ করেনপরে একে একে ৭২ জন শহীদ হনইমাম হুসাইন (রা.) কে যেরূপ নির্মম বর্বরোচিতভাবে হত্যা করা হয় মানব ইতিহাসে সে রকম ঘটনা খুব বেশি নেইতেমনি মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে তিনি যেরূপ সাহসিকতা, নির্ভীকতা ত্যাগ ও নিষ্ঠার নজির তুলে ধরেন তাও দুর্লভইমাম হুসাইনের এ মর্মন্তুদ পরিণতি সারা বিশ্বের মুসলমানকে শোকে-দুঃখে আজও মুহ্যমান করে তোলে এবং সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রামে মহত্ত্বর প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করেতাই মহরম ও আশুরার ঘটনাবলী বিশেষ করে মুসলমানদের কাছে ঈমানি তেজোদ্দীপনার এক অনির্বাণ শিখা

পবিত্র মহরম ও আশুরা একান্ত ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পর্ব হলেও এক সময় কিছু অতি হুসাইনী প্রেমিকের হাতে বাড়াবাড়িতে রূপ নিয়েছেতারা এ নিয়ে তাজিয়া মিছিল করে মার্সিয়ায় উন্মাদনা ছড়ায়, হায় হুসাইন হায় হুসাইন বলে রক্ত ঝরায়, ঢোল, তবলা বাজায়ইসলাম শান্তির ধর্মকারও মৃত্যু বা শোকেও বাড়াবাড়ির সুযোগ নেইসূরা বাকারায় এমন পরিস্থিতিতে ধৈর্য ও আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণের তাগিদ দেয়া হয়েছেআর খুনাখুনিকে জাহিলিপনা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (ইবনে মাজাহ)

মুসনাদে আহমদ বর্ণিত এক হাদিসে আছে- যে উল্লাস হাত এবং মুখের উচ্চারণে হয় তা শয়তানের কাজআর যা অশ্রু ঝরিয়ে হৃদয় মাড়িয়ে স্মরণ করা হয় তা আল্লাহর পক্ষ থেকেপরিশেষে আল্লাহ যেন আমাদের পবিত্র মহরম ও আশুরার বরকত নসিব করেন এবং হুসাইন উত্তর এ পৃথিবী যেন সঠিক আকিদা বিশ^াসের মুসলিম নেতৃত্ব পায়, একতা ভাতৃত্বের জয়ধ্বনি বুলন্দ হয়, ভাইয়ে ভাইয়ে হিংসা হানাহানি দূর হয়- এই মোনাজাত করি

 

লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব

[email protected]

×