ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান

প্রকাশিত: ২০:০১, ৩ জুলাই ২০২১

মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান

তিরিশ লাখ শহীদের রক্তমাখা পথযাত্রায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা তার গন্তব্যে পৌঁছে। আর কয়েক লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানিতার বিনিময়ে লাল সবুজের পতাকা ছিনিয়ে আনা, সেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়। সরাসরি অংশগ্রহণ কিংবা সম্মান হারানো নারীরা ছাড়াও আরও কত মাতা-ভগিনী ও কন্যা তাদের প্রিয়জনদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে দিয়েছেন তাদের সংখ্যা অগণিত। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ সমরের দুঃসহ লড়াইয়ে তাদের পাশে থেকে দৈনন্দিন আহার জোগানো, সেবা শুশ্র‍ুষা করা সবই ছিল স্বাধীনতাকামী বাংলার অসংখ্য নারী সমাজের অকৃত্রিম দায়বদ্ধতা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক ও কণ্ঠযোদ্ধার সাহসিক অংশগ্রহণে নারীরা যে মাত্রায় সম্পৃক্ত হয়েছিল, সেটা মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল আখ্যানের অর্ধাংশ এই গোষ্ঠীর নিঃশর্ত নিবেদন। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ভার্চুয়াল বলয়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির এক আলোচনা সভায় উঠে আসে এসব তথ্য। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের নারী সমাজের অবদান’ শীর্ষক ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। সভায় পৌরহিত্য করেন নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। এ ছাড়া ‘জাহানারা ইমাম স্মারক বক্তৃতা’ উপস্থাপন করেন নান্দনিক কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন। এমন মহতী অনুষ্ঠানে ধর্মনিরপেক্ষ মানবতার আন্দোলনে বিশেষ অবদান রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট বরেণ্য ব্যক্তি এবং সংগঠনকে বিশেষ সম্মাননা ও পুরস্কারে অভিষিক্ত করা হয়। এ বছর ২০২১ সালে ব্যক্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত সমাজকর্মী মালেক যান। সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘকে জাহানারা ইমাম স্মৃতিপদক প্রদান করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের তুলনায় নারীর অবদান কোন অংশেই কম নয়। বরং বেশি। যদিও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীর স্বীকৃতির তেমন স্বাক্ষর নেই, যা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনকও বটে। সামন্ততান্ত্রিক ও ধর্মীয় মৌলবাদী ধারণার যে আধিপত্য তাই নারী সমাজকে এখনও অবরুদ্ধতার কঠিন জালে আটকে রেখেছে। সমাজের অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং পশ্চাৎপদ এই গোষ্ঠী বরাবরই নেপথ্যে নিজেদের কর্মক্ষমতা নির্বিশেষে উজাড় করে দিলেও বাস্তবে তার স্বীকৃতি মেলেই না। নারীরা যথার্থভাবে পুরুষের সমান তালে চলতে এখনও নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন। বর্তমানে দেশের প্রশংসিত উন্নয়ন যজ্ঞে নারীর ক্ষমতায়নের যে সুফল আমরা প্রত্যক্ষ করি বিশ্ব প্রতিবেদনে তার প্রভাবে বাংলাদেশের চিহ্নিত হওয়ার চিত্রও নজরকাড়া। অর্থাৎ সমতাভিক্তিক সমাজ বিনির্মাণে বাংলাদেশ বিশ্ব কাতারে ঈর্ষণীয় জায়গায়। আর দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম স্থান লাভ করে নারী-পুরুষের সমান তালে চলার সুযোগ তৈরির দৃষ্টান্তও হয়েছে। তার মাঝেও হরেক রকম বিপর্যয় বিপত্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে সময়ও লাগছে না। নারী নির্যাতনের লাগাম এখনও পর্যন্ত টানা যায়নি। ঘুণে ধরা মনোবৃত্তিতে সজোরে আঘাত করতে ব্যর্থ হলে নারীদের সামনে আসার পথও বার বার বিঘ্নিত হবে। আমরা এখন তেমন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। উন্নয়নশীল দেশে দ্রুত অগ্রগামিতার সুফলের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতাও নিজস্ব নিয়মে এগিয়ে চলতে থাকে। সঙ্গত কারণেই অত্যাচার, নিপীড়ন, শোষণ ছাড়াও দাবিয়ে রাখার অপসংস্কৃতি ও উন্নয়নের ক্রমধারায় জিইয়ে থাকে রক্ষণশীল ও উগ্র মৌলবাদের নৃশংস আঁচড়ে। আর এই বহির্প্রকাশ আমরা প্রত্যক্ষ করি খোদ সরকারী দলের সংসদ সদস্যদের এক অবাঞ্ছিত বক্তব্যে। তাদের দাবি, মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পর তাদের যে ‘গার্ড অব অনার’ মর্যাদায় ভূষিত করা হয়- তেমন কার্যক্রমে নারীরা অংশ নিতে পারবেন না। এমন অযৌক্তিক ও মান্ধাতার আমলের ধারণাকে লালন করতে গিয়ে অর্ধাংশ নারী জাতিকে যেভাবে অবমাননা করা হলো, তা বাতিল করা সময়ের দাবি। নারী বিদ্বেষী এমন অকারণ প্রস্তাব ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে কি ভাবে দেয়া সম্ভব হলো তা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ, একইভাবে উন্নয়নের সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণেরও ঘোর পরিপন্থী। সমাজের সমান এই অংশটি যদি শুধু নারী হিসেবে কোন কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তা শুধু অমূলকই নয়, অগ্রহণযোগ্যও বটে।
×