
ছবি: জনকন্ঠ
“যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই; পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন”—
কবি গগন চন্দ্র দাসের এই চরণ যেন সত্যি হয়ে ধরা দিয়েছে মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার চারিগ্রাম ও গোবিন্দল ইউনিয়নে। এখানকার মানুষের জীবনে ছাই মানে শুধুই বর্জ্য নয়, বরং জীবিকার উৎস, কখনোবা অমূল্য রতনের ভাণ্ডার!
ঢাকার নিকটবর্তী সিংগাইরের গোবিন্দল ও চারিগ্রাম এই দুটি ইউনিয়নে প্রায় ৭০% শতাংশ পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ছাই থেকে সোনা, রুপা, ব্রোঞ্জ, তামা ও সিসাসহ মূল্যবান ধাতব পদার্থ আহরণ করে আসছে। এই ছাই-নির্ভর অর্থনীতির কারণে এলাকাটি ইতোমধ্যে ‘স্বর্ণগ্রাম’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। শুধু নামেই নয়, এখানকার সোনা একদম খাঁটি—যা দেশের বড় বড় জুয়েলারি মার্কেটেও সমাদৃত।
নারী-পুরুষ মিলেই গড়ে উঠেছে সোনার কারখানা
চারিগ্রাম ও গোবিন্দল—দুই ইউনিয়নের প্রায় ৭০ শতাংশ পরিবার এ পেশার সঙ্গে জড়িত। শুধু পুরুষ নয়, নারীরাও সমানতালে ছাই থেকে সোনা আহরণের কাজে যুক্ত। তাদের নিপুণ হাতে প্রক্রিয়াজাত সোনা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, সিলেট, পাবনা, যশোর, খুলনা, বগুড়া, দিনাজপুর ও আরও অনেক জেলার জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা এখান থেকে নিয়মিত সোনা কিনে থাকেন।
কীভাবে ছাই থেকে উঠে আসে সোনা?
দেশের বিভিন্ন জুয়েলারি দোকান থেকে সংগ্রহ করা ওয়েস্টেজ ছাই—যেখানে থাকে ধাতব ধুলিকণা, তা থেকেই শুরু হয় এই বিস্ময়কর যাত্রা। প্রথমে ছাঁকনির সাহায্যে ছাইকে চালন করা হয়। এরপর ঢেঁকিতে গুঁড়ো করে, পানির সঙ্গে মিশিয়ে পিণ্ড তৈরি করা হয়। শুকনো পিণ্ড উচ্চ তাপে পোড়ালে ময়লা সরে গিয়ে বের হয়ে আসে তরল ধাতব পদার্থ।
এদের মধ্যে থাকে সোনা, রুপা, তামা, ব্রোঞ্জ, অ্যালুমিনিয়াম, এমনকি লোহাও। বিশেষ প্রক্রিয়ায় মাটির গর্তে চুন ও ধানের তুষের মাধ্যমে সেই তরল পিণ্ড পুড়িয়ে সিসা ও অন্যান্য ধাতু আলাদা করা হয়। সবশেষে নাইট্রিক অ্যাসিড ও কেমিক্যাল ব্যবহার করে আলাদা করা হয় খাঁটি সোনা ও রুপা। এই পুরো প্রক্রিয়াই চলে দক্ষ হাতে ও সাবধানে, যা গড়ে তুলেছে এক প্রাচীন কিন্তু শক্তিশালী পেশা।
একটি পেশার টিকে থাকার সংগ্রাম
চারিগ্রামের দাশেরহাটি ও গোবিন্দল গ্রামের অনেক ব্যবসায়ী—যেমন মো. বাবুল মিয়া, মো. আরসেদ আলী, মো. শাজাহান মিয়া, মো. সুরুজ মিয়া ও মো. আজিজুল হক—দীর্ঘ ১৫ থেকে ৩০ বছর ধরে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু দিন দিন তাদের পথ কঠিন হয়ে উঠছে।
ছাই সংগ্রহের সময় পথে-পথে পুলিশি হয়রানি, চাঁদাবাজি, এমনকি রাসায়নিক (নাইট্রিক অ্যাসিড) সংগ্রহেও বাধা আসছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, টাকা না দিলে মাল আটকে দেওয়া হয়, এমনকি ক্রয়-বিক্রয়ের স্বাধীনতাও বিঘ্নিত হচ্ছে।
স্বর্ণগ্রাম রক্ষায় সরকারি নজরদারি চায় সবাই
গোবিন্দল জুয়েলারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খলিলুর রহমান বলেন, “বিভিন্ন জেলা থেকে ছাই আনার পথে ব্যবসায়ীরা নিয়মিত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আমরা চাই সরকার আমাদের এই পেশার প্রতি সুদৃষ্টি দিক।”
সিংগাইর সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. জাহিনুর রহমান সৌরভ জানান, “গোবিন্দল গ্রামে প্রায় ২০ হাজার মানুষের বসবাস। তার মধ্যে ৭০ শতাংশ মানুষ ছাই থেকে সোনা আহরণে নিয়োজিত। এরা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আমি সরকারকে আহ্বান জানাব, তারা যেন এ শিল্পকে রক্ষা ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।”
এই ‘স্বর্ণগ্রাম’-এর গল্প শুধুই একটি পেশার নয়, এটি প্রমাণ করে, মাটি আর মানুষের মেলবন্ধনেই গড়ে ওঠে এক অমূল্য সম্ভাবনা। ছাইয়ের বুকেও লুকিয়ে থাকতে পারে সোনার গল্প!
মুমু