
উত্তরায় বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় স্বজনদের আহাজারি
উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমান বিধ্বস্তের পর থেকে দগ্ধ ও আহতদের হাসপাতালে আসার স্রোত নামে। একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স ছুটে আসছে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, সিএমএইচসহ রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালের দিকে। আর সেই সব অ্যাম্বুলেন্স থেকে ভেসে আসছে স্বজনের কান্নার ভারি আওয়াজ। আর মাঝে মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি সাইরেন বাজিয়ে ছুটছে দুর্ঘটনাস্থলে।
আবার সাইরেন বাজিয়ে ছুটছে হাসপাতালে হাসপাতালে। সে সময় সড়কের দু’পাশে দাঁড়িয়ে শত শত মানুষ হাতের বেষ্টনী দিয়ে নিরাপত্তা দেওয়াল তৈরি করেছে। এর মধ্য দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সগুলো আসছে এবং যাচ্ছে। এখানে সেখানে ছুটছেন অভিভাবকরা। কেউ খুঁজছেন সন্তানকে, কেউ খুঁজছেন ভাগ্নেকে। আবার হাসপাতাল থেকে শিশু শিক্ষার্থীদের লাশ নিচ্ছেন স্বজনরা। প্রিয়জন হারানোর বেদনা আর আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইনস্টিটিউট, সিএমএইচ ও উত্তরার আকাশ। সোমবার বেলা ২টার পর থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স আসা শুরু হয় এসব স্থানে। হাসপাতালে আসা অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের আওয়াজে আশপাশের এলাকা ভারি হয়ে উঠছে।
রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে সোমবার দুপুরে বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা এত ভয়াবহ ছিল যে তা ছিল সকলের কল্পনার বাইরে। এতে বেশ কিছু শিশু শিক্ষার্থী ভয়াবহভাবে দগ্ধ হয়। এরপর থেকে দগ্ধদের নিয়ে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালে এসেই চলছে। প্রায় ৭ ঘণ্টায় অর্ধশতাধিক অ্যাম্বুলেন্স দগ্ধ রোগী নিয়ে বার্ন ইউনিটের জরুরি বিভাগে প্রবেশ করেছে। এর আগে দগ্ধদের নিয়ে সিএমএইচ, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হসপিটাল, উত্তরা লুবনা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টার, উত্তরা আধুনিক হসপিটাল, উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নেওয়া হয়।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় অন্ধকারে অভিভাবকরা যেন নিখোঁজ স্বজনকে খুঁজে পাওয়ার আশার আলোর খোঁজে ছুটে চলেছেন এসব হাসপাতালে। অনেক শিক্ষার্থী লাশ খুঁজে ফেরে। তাদের কান্না আর আর্তনাদে ভারি হয়ে ওঠে চারদিক। নিরাপত্তা বেষ্টনি নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ও আহত স্বজনদের পার করে দেন তারা। তাদের পাশাপাশি পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে কাজ করতে দেখা গেছে।
প্রশিক্ষণ বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। বিধ্বস্ত বিমান এবং আগুনে পোড়া শিক্ষার্থীদের ছবি ভাইরাল হয়। ঘটনার ভয়াবহতা শুনে চারদিকে হাজারো উৎসুক জনতা ভিড় করে হাসপাতালগুলোতে। ঘটনাস্থল দিয়াবাড়িতে জনস্রোত নামে। এদের মধ্যে কেউ কেউ সন্তানের খোঁজে আসেন, কেউ আসেন ছোটভাই, ভাতিজা-ভাতিজি, ভাগ্নে-ভাগ্নির খোঁজে।
শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যার দিকে পাওয়া গেল দুঃসংবাদ। ঘটনার পর নিখোঁজ শিক্ষার্থী সাদের নিথর দেহ উদ্ধার করা হয়েছে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। তার চাচা ও সাংবাদিক আবীর রহমান সাংবাদিকদের কান্নাজড়িত কণ্ঠে এ কথা জানান।
মাত্র ৮ বছর বয়সের সাদ পড়ত মাইলস্টোন স্কুলের বাংলা মিডিয়ামে, তৃতীয় শ্রেণিতে। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল সে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তার বাবা। প্রিয় ছেলেকে হারিয়ে এখন শোকে পাথর হয়ে গেছেন তার বাবা-মা। সাদের মৃত্যুর খবর পৌঁছতেই শোকের ছায়া নেমে এসেছে তার গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কলমা গ্রামে।
সাদের খোঁজে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছিল আবীর রহমান নামে এক ব্যক্তি। তিনি তার ভাতিজা সাদকে হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরেছেন। শেষে খোঁজ মিলল ভাতিজার লাশ। সিএমএইচের এক নিঃশব্দ কক্ষে।
উত্তরায় বিমান বিধ্বস্তের ভয়াবহ ঘটনায় দগ্ধ শতাধিক মানুষের স্বজনদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আঙিনা। সন্তান, নাতি, ভাই-বোনের জন্য স্বজনদের আহাজারি ও আর্তনাদে চারপাশে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।
বিকেলে মেয়ের খোঁজে আব্দুল কাদের তার ভাইসহ এসেছেন জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে। তার মেয়ে আফিয়া তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তার খোঁজ পাচ্ছেন না। তৃতীয় শ্রেণির সায়মা, পড়তো বাংলা ভার্সনে। তার খোঁজে এসেছেন তার বাবার এক সহকর্মী।
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ৫২০ নম্বর কক্ষের মেঝেতে পড়ে কাঁদছিলেন ফাহাদ নিয়ন। ফাহাদ তার চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া ভাগনি মেহরিনের পোড়া কাপড় ধরে কাঁদছিলেন। ফাহাদ বলেন, ‘ও খুব নিষ্পাপ। ওর দুই হাত ও মুখ পুড়ে গেছে। এটা ওর ড্রেস। ও খুব নিষ্পাপ ভাই। ও সারাদিন পড়াশোনা করে।’
মেহরিনের বাসা উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায়। ফাহাদ বলেন, ‘ওর ক্লাস রুমের ওখানে বিমান পড়েছে। আগুনের খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে ২-৩ ঘণ্টা খুঁজেছি, পাইনি। পরে ওর শিক্ষক ফোন করে বলেন, মেহরিন বার্ন ইউনিটে। পরে এখানে আসি। দেখি, ওর দুই হাত পুড়ে গেছে। মুখ পুড়ে গেছে।’
নুরে জান্নাত ঊষা মাইলস্টোনে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। বিমান বিধ্বস্তের আগুনে পুড়ে গেছে ঊষা। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের তৃতীয় তলায় কক্ষের বাইরে ছেলেকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কান্না করছেন তার মা ইয়াসমিন আক্তার। বিলাপ করে বলছেন, আমার মেয়ের সব পুড়ে গেছে, তোমরা কেউ তার জ্বলা বন্ধ করো। আমি আমার মেয়ের কষ্ট সহ্য করতে পারছি না। আমার বুকটা খালি হয়ে যাচ্ছে।
মা ইয়াসমিনের পাশে বসা ছেলে তাহমিন ইসলাম রোহান বলেন, প্রতিদিনের মতো আজকেও বোনকে স্কুল থেকে আনতে যাই। গিয়ে দেখি স্কুলে বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। পরে ক্লাসরুমে গিয়ে খুঁজে দেখি বোনকে পাচ্ছি না। পরে ভেতর থেকে তাকে খুঁজে বের করে দেখি বোনের শরীর পুড়ে গেছে। পরে সঙ্গে সঙ্গে তাকে উত্তরার লুবনা হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখান থেকে পরে বার্ন ইউনিটে নিয়ে আসি।
দগ্ধ মাইলস্টোন স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী রাফসি আক্তার রাফিয়া উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে আছে। ‘খালপাড় ২ নম্বর ব্রিজ’ ছাড়া আর কিছুই বলতে পারছে না শিশুটি।
সোমবার বিকেলে এক গণমাধ্যমকর্মী বিষয়টি ফেসবুক পোস্টে জানান। পোস্টে তিনি লেখেন, খালপাড় ২ নম্বর ব্রিজ’ আর তেমন কিছু বলতে পারছে না। রাফিয়ার মা-বাবার কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করেন। বর্তমানে উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে আছে।
বার্ন ইনস্টিটিউটের সামনে বসে কাঁদছিলেন ঝর্না আক্তার। তার ছোট ছেলে জুনায়েদ তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী, এ দুর্ঘটনায় গুরুতর দগ্ধ হয়ে ভর্তি হয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে তিনি জানান, আমার ছেলে খুব ভালো ছিল। মাঠে খেলতে গিয়েছিল, এখন বার্ন ইনস্টিটিউটে। আমি দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই, মহান আল্লাহ যেন আমার জুনায়েদসহ সবাইকে সুস্থ করে দেন।
একইভাবে কান্নায় ভেঙে পড়েন মুসলিম উদ্দিন। একমাত্র নাতিকে পোড়া দেহ নিয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছেন। তার নাতিও তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। চোখ মুছতে মুছতে বলছিলেন, আপনারা দোয়া করেন, আমার নাতি যেন বাঁচে। একমাত্র নাতি আমার, কী কষ্টে আছে তা বলে বোঝাতে পারব না।
কান্না করতে করতে পারুল নামের এক অভিভাবক বলছিলেন, ‘স্কুল ভবনে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। আমার মেয়ে কোথায়? আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিন।’
তার মেয়ে নুসরাত আক্তার উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। পারুল জানান, তার মেয়ের ক্লাস শুরু হয় সকাল ৮টায়, শেষ হয় দুপুর ১টায়। এরপর কোচিং চলে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত। তাদের বাসাও দিয়াবাড়িতে। স্কুলের পাশের মেট্রোরেল ডিপোতে তিনি সন্তানের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
স্বজনদের আরেকজন সাজ্জাদ, চোখের পানি ফেলতে ফেলতে জানান, তার ভাগনে আফিফ আরিয়ান, সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। আফিফের অবস্থা গুরুতর।
হাসপাতালে উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজ শাখার দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া কলেজ শাখার এক শিক্ষার্থী আতঙ্ক ও বিভীষিকাময় কাহিনী বর্ণনা করেন। চোখের সামনে বিমান বিধ্বস্তের ভয়াবহ মুহূর্ত দেখেও ভয় না পেয়ে তিনি আহত শিশুদের উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়েন। হাসপাতালে আহতদের নিয়ে আসেন। সে মুহূর্তের কথা স্মরণ করে ওই শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের ছুটি হয়ে গিয়েছিল। ছুটির পর স্বাভাবিকভাবেই আমরা চলে আসছিলাম। কিন্তু হঠাৎ ভয়ঙ্কর একটি শব্দ হয়। পেছনে তাকিয়ে দেখি দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। তাও আমাদের প্রাইমারি স্কুল সেকশনে। ওই শিক্ষার্থী বলেন, দু’তিনটি বাচ্চা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলছে, ‘আপু বাঁচাও।’ এ অবস্থায় আমি কীভাবে তাদের ছেড়ে আসি! শিশুদের এমন আকুতি শুনে নিজেকে স্থির রাখতে পারিনি। তিনি দ্রæত তাদের নিয়ে বাংলাদেশ মেডিক্যালে যান। সেখান থেকে তাদের জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাঠান।
একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সাইম খান এসেছেন তার ছোট বোনকে নিয়ে। তার বোন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। আগুনে দগ্ধ হয়ে এখন বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি। সাইম বলেন, আমার বোনসহ যারা আহত হয়েছে, সবার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই। কেউ যেন এমন পরিস্থিতিতে না পড়ে।
অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী লামিমের বাবা স্কুল শিক্ষক বলেন, আমার ছেলে প্রথমে ফোন করে বলেছে, স্কুলে বোমার মতো কিছু মেরেছে। আমার সঙ্গে থাকা তিনজন মারা গেছে। পরে জানতে পেরেছে যে বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। তাকে তার গাইড শিক্ষক নিয়ে যেতে বলেছেন। এখন হোস্টেলে আছে। সুস্থ আছে।
তিনি জানান, আমার সঙ্গে কথা হয়েছে লামিমের। তবে সে ভয় পাচ্ছে। কান্নাকাটি করছে। বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন লামিমের বাবা।
তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রের খোঁজে এসেছেন তার বাবা। তিনি বলেন, কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। কয়েকটি হাসপাতালেও খোঁজ নিয়েছি। ছেলের শোকে তার কান্না ছুঁয়ে যাচ্ছে অন্যদেরও।
প্যানেল মজি