
বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর উদ্ধার কাজে দমকল বাহিনী, বিমান বাহিনী ও সেনা বাহিনীর কর্মীরা
রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। বিমানটি সেখানে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি দোতলা ভবনে বিধ্বস্ত হলে পাইলট ও শিক্ষার্থীসহ অন্তত ২২ জন নিহত হয়েছেন। মর্মান্তিক এ ঘটনায় আহত হয়েছেন শিক্ষার্থীসহ ১৭০ জন। এ ঘটনায় আজ এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে।
সোমবার দুপুর সোয়া ১টার দিকে বিমান বাহিনীর এফ-৭ যুদ্ধবিমানটি বিকট শব্দে মাইলস্টোন ক্যাম্পাসে আছড়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে বিমান ও স্কুল ভবনে। যে ভবনে এটি বিধ্বস্ত হয়- সেখানে বহু স্কুল শিক্ষার্থী ছিল। আগুনে ঝলসে যায় বহু শিক্ষার্থী। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ঘটনাস্থলে উদ্বার কাজে ব্যস্ত ছিল ফায়ার সার্ভিস, বিজিবি, সেনা ও বিমান বাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থার লোকজন।
দুর্ঘটনার পর বিমান বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার এসে প্রথমে পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলামকে উদ্বার করে সিএমএইচে নিয়ে যায়। পরে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান পাইলট তৌকির। তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির পাবনা ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। এক বছর আগে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।
দুর্ঘটনার পর পর উত্তরাসহ আশপাশের ৮টি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে এবং হতাহতদের উদ্ধার করা শুরু করে। পরে উদ্ধার অভিযানে যোগ দেয় বিজিবি ও সেনাবাহিনী। বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারে এবং বিভিন্ন অ্যাম্বুলেন্সে হতাহতদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। বিকেলের আগেই ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভাতে সক্ষম হলেও ঘটনার ভয়াবহতায় মানুষজন শিউরে ওঠেন।
ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় আজ রাষ্ট্রীয় শোক দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন, প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসসহ শোক জ্ঞাপন করেছেন বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি এনসিপিসহ দেশের শীর্ষ রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ, উপদেষ্টামÐলীর সদস্যরা। এ ছাড়া ভারত, পাকিস্তানসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ শোক বার্তা দিয়েছেন।
সোমবার বেলা ১টা ৬ মিনিটে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানটি নিয়ে আকাশে ওড়েন পাইলট তৌকির ইসলাম সাগর। তিনি এদিনই প্রথম একাকি ফ্লাই করেন। এর আগে তিনি এক লাখ ঘণ্টার উড্ডয়ন প্রশিক্ষণ নেন। বজ্র নামের ওই বিমানটি নিয়ে আকাশে উড়ে কিছু সময় পর অবতরণের চেষ্টা করছিলেন। ঠিক তখনই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দোতলা ভবন হায়দার হলে আছড়ে পড়ে বিমানটি। এ ঘটনায় বিমান বাহিনীর একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
দুুপুরে ওই ঘটনার পর পরই উপস্থিত লোকজন সেখানে জড়ো হতে থাকে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়- তখন স্কুল ছুটির সময় ছিল। শিক্ষার্থীরা গেটে অপেক্ষা করছিলেন বাসায় যাওয়ার জন্য। হঠাৎ তারা দেখতে পান, একটি প্লেন সেখানে নিচু দিয়ে উড়ে এসে বিকট শব্দে ভবনটির গেটে মুখ থুবড়ে পড়ে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, তারা এ সময় একজনকে প্যারাসুট দিয়ে নেমে আসতে দেখেছেন। বিমানটি আছড়ে পড়ার পরই সেখানে আগুন ধরে যায়। আর ভবনের ভেতর থেকে দিগি¦দিক ছুটতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। মুহূর্তেই চারপাশে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তার কিছু সময় পরে সেখানে একটি হেলিকপ্টার এসে পাইলটকে উদ্বার করে নিয়ে যায়। তারপর একের পর আসতে থাকে ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, ও বিজিবিসহ অন্যান্য সংস্থার গাড়ি।
সেখানে এক তরুণী জনকণ্ঠকে বলেনÑ বলতে কষ্ট হচ্ছে। কিভাবে আমি তাদের উদ্ধার করেছি। ভয়াবহ এ ঘটনায় যখন চারদিকে আতঙ্ক আর বিভীষিকা, তখন সাহস করে হতাহতদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন কলেজ শাখার ওই শিক্ষার্থী। চোখের সামনে বিমান বিধ্বস্তের ভয়াবহ মুহূর্ত দেখেও ভয় না পেয়ে তিনি আহত শিশুদের উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ওই শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের ছুটি হয়ে গিয়েছিল। ছুটির পর স্বাভাবিকভাবেই আমরা চলে আসছিলাম। কিন্তু হঠাৎ ভয়ংকর একটি শব্দ হয়। পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। তাও আমাদের প্রাইমারি স্কুল সেকশনে। কী ঘটনা হয়েছে তা জানতে ওখানে যাই। পরে দেখি অনেক বাচ্চা খুব বাজেভাবে আহত হয়েছে। দু-তিনটি বাচ্চা এসে আমাকে জড়িযে ধরে বলছেÑ আপু বঁাঁচাও। এ অবস্থায় আমি কীভাবে তাদের ছেড়ে আসি! শিশুদের এমন আকুতি শুনে নিজেকে স্থির রাখতে পারিনি। তিনি দ্রæত তাদের নিয়ে বাংলাদেশ মেডিক্যালে যান।
যেখানে বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে সেই ভবনটিতে তৃতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণির ইংরেজি মাধ্যমের ক্লাস হতো। ঘটনার আগে সবে সেখানে ক্লাস শেষ হয়েছিল। একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী কাওসার বলেন, একটা ফাইটার প্লেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আমাদের জুনিয়র ক্যাম্পাসÑ যেখানে ক্লাস ফাইভ থেকে এইটের ছেলেপেলেরা পড়াশোনা করে, ঠিক সেইখানে প্লেনটা পড়ছে ভাই। আমাদের ছোট ভাইয়েরা ছিল, সবাই ছিল ভাই। ওই খানে বলতে গেলে সবাই পুড়ে গেছে, সবাই ঝলসে গেছে। আমরা ভেতরে গেছিলাম, আগুনের কারণে কাউকে বের করিতে পারি নাই। খুব খারাপ অবস্থা।
ক্রেন দিয়ে উদ্ধার \ সন্ধ্যায় গিয়ে দেখা যায়, দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে বিধ্ব¯ত প্লেনের অংশবিশেষ দেখে বোঝা যাচ্ছে বিমানটি স্কুল ভবনের সামনে পড়ে ছিটকে ভবনের সিঁড়ির সামনে চলে যায়। আর এর দুটি পাখার আঘাতে ধ্বংস হয় শিক্ষার্থীতে পরিপূর্ণ দুটি ক্লাসরুম। আক্রান্ত ওই দুই কক্ষ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। স্কুলের দারোয়ান জানান, ওই ভবনে প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস হতো। বিধ্বস্ত এফ-৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমানটি উদ্ধারে ব্যবহার করা হচ্ছে ভারি ক্ষমতাসম্পন্ন ক্রেন। বিকেলের দিকে বিমানটির অবশিষ্ট অংশ উদ্ধারে শুরু হয় এই অভিযান। দুর্ঘটনায় ভবনের যে অংশে বিমানটি আঘাত হানে, সেখানে ব্যাপক ধ্বংসস্তূপের সৃষ্টি হয়। ধসেপড়া ভবনের অংশবিশেষ এবং বিমানের ভগ্নাবশেষ সরাতে দুপুরের পর ক্রেন আনা হয়। ওই সময় থেকেই সতর্কতার সঙ্গে অপসারণ কার্যক্রম শুরু করে সংশ্লিষ্ট বাহিনী।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে \ এই দুর্ঘটনার খবর বিশ্বের একাধিক সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত, দুর্ঘটনায় ১৯ জনের প্রাণহানির তথ্য দিয়েছে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স। তাদের শিরোনাম ছিল, ‘কলেজ ক্যাম্পাসে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজ বিধ্বস্তে নিহত অন্তত ১৯’। রয়টার্সের বরাতে একই শিরোনামে প্রতিবেদন করেছে চীনা সংবাদমাধ্যম সিজিটিএন।
১৯ জন নিহত এবং শতাধিক আহতের তথ্য জানিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি শিরোনাম করেছে, ‘বাংলাদেশের স্কুলে বিমানবাহিনীর জেট বিধ্বস্তে অন্তত ১৯ জন নিহত।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস শিরোনাম করেছে, ‘স্কুলে বিধ্বস্ত হয়েছে বাংলাদেশের সামরিক বিমান, নিহত অন্তত ১৯’। মার্কিন বার্তাসংস্থা এপির শিরোনামে বলা হয়েছে, ‘ঢাকার স্কুলে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জেট বিধ্বস্তে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৬।
রয়টার্সের বরাতে ১৯ জন নিহত এবং শতাধিক আহতের প্রতিবেদন করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুস্তান টাইমস। তাদের শিরোনাম, ‘ঢাকার মাইলস্টোন কলেজ ক্যাম্পাসে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এফ-৭ জেট বিধ্বস্তে নিহত ১৯, আহত শতাধিক।’
এ ছাড়া উত্তরায় বিমান দুর্ঘটনার খবর দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম গালফ নিউজ, সিঙ্গাপুরভিত্তিক সংবাদমাধ্যম স্ট্রেইটস টাইমস, পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন। এনডিটিভি, ডেকান হেরাল্ড, টাইমস অব ইন্ডিয়াসহ ভারতের প্রধান প্রায় সব সংবাদমাধ্যমেও এ খবর প্রকাশ পেয়েছে।
৬ হাসপাতালে ১৬৪ জন \ এ ঘটনায় ২০ জন নিহতের কথা জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। আহত হয়ে ছয়টি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ১৬৪ জন।
বিভিন্ন হাসপাতালে হতাহতদের সংখ্যা জানিয়েছে আইএসপিআর। এর মধ্যে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৮ জন, জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ৭০ জন ও নিহত ২ জন, সিএমএইচে চিকিৎসাধীন ১৪ জন ও নিহত ১১ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিহত ২ জন, উত্তরা লুবনা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে চিকিৎসাধীন ১১ জন ও নিহত ২, উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৬০ জন ও নিহত ১ জন এবং উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১ জন।
মৃতদেহ ডিএনএ করে পরিবারের কাছে দেওয়া হবে \ এ ঘটনায় নিহতদের মধ্যে যাদের পরিচয় শনাক্ত করা যাবে তাদের মৃতদেহ অতিসত্বর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। বাকিদের ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় শনাক্ত করে পরে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। সোমবার বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। আহতদের চিকিৎসার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছেন। চিকিৎসা কাজ নির্বিঘেœ করার স্বার্থে হাসপাতাল এলাকায় অহেতুক ভিড় না করার জন্য সর্বসাধারণকে বিশেষভাবে অনুরোধ করা যাচ্ছে।
সাগরের পরিবার ঢাকায় \ মর্মান্তিক এ দুঘটনায় নিহত পাইলটকে শেষ চেষ্টা করেও বাঁচানো যায়নি। দুর্ঘটনার পর পরই তার বাবা-মা-বোনকে রাজশাহী উপশহরের ৩ নম্বর সেক্টরের বাসা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। বিকেল ৫টার দিকে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে রাজশাহী বিমানবন্দর থেকে তাদের ঢাকায় আনা হয়। সাগরের মেজ চাচা মতিউর রহমান বলেন- ‘আমরা কিছুক্ষণ আগে তার মৃত্যুর খবর শুনতে পেযেছি। বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে একটি হেলিকপ্টার এয়ারপোর্টে পাঠানো হয়েছে। সেই হেলিকপ্টারে করে সাগরের বাবা তোহরুল ইসলাম, মা সালেহা খাতুন ও ছোট বোন বৃষ্টিকে ঢাকায় নেওয়া হয়েছে। মতিউর রহমান আরও বলেন, ‘স¤প্রতি সাগর রাজশাহী এসেছিল। ছয় মাস আগে তার বিয়ে হয়। তার কোনো বাচ্চাকাচ্চা নেই। ছোট ভাই মরদেহ নিয়ে এলে দাফনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
নিমিষেই হরিষে বিষাদ \ এটা যেন নিমিষেই হরিষে বিষাদ। এ্িদনই প্রথমবারের মতো প্রশিক্ষণ শেষের পর একাকী ফ্লাইট চালানোর সংবাদ দেওয়া হয় পরিবারে। তার পরেই দেখা দেয় দুসংবাদ। সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায় সব উচ্ছ¡াস। বিকেলে রাজশাহী নগরের উপশহর এলাকায় তৌকিরদের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালে কিছুক্ষণ পর পর কান্নার রোল ভেসে আসতে শোনা যায়।
নিহত ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের ডাকনাম সাগর। তাঁদের পরিবার রাজশাহী নগরের উপশহর ৩ নম্বর সেক্টরের আশ্রয় ভবন নামে একটি বাসায় ভাড়া থাকে। তার বাবা তহুরুল ইসলাম, মা সালেহা খাতুন, বোন সৃষ্টি ও ভগ্নিপতি সেই বাড়িতে থাকতেন। বাবা আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করেন। তাঁদের গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট এলাকায়। স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত পরিবারের সদস্যরা জানতেন না যে তৌকির ইসলাম মারা গেছেন। সে সময় জানতেন, তৌকির ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
তৌকির ইসলামের মৃত্যুর খবরের পর রাজশাহী নগরের উপশহর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনে সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষ ভিড় করছেন। সবাই স্বজনদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। এখনো বাসায় তৌকির ইসলামের নানা, নানি ও খালা রয়েছেন। কিছুক্ষণ পর পর কান্নার রোল ভেতর থেকে ভেসে আসছে। মামা মোতাকাব্বির বাইরে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী মানুষ ও সাংবাদিকদের পরিবারের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করছেন।
জানা গেছেÑ তৌকির ইসলাম রাজশাহীর ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। পরে পাবনা ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হন। ২০১৭ সালে তিনি চাকরিতে যোগ দেন। এক বছর আগে তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকাকে বিয়ে করেন। তৌকিরের মা-বাবা ও বোন ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে তাঁর মৃত্যুর খবর জানতেন না। পরিবারের সদস্যরা জানতেন, সাগর জীবিত এবং চিকিৎসাধীন।
একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক আজ \ রাজধানীর দিয়াবাড়ি এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় আজ মঙ্গলবার একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং সোমবার এ তথ্য জানায়।
আজ মঙ্গলবার দেশের সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। পাশাপাশি সব সরকারি, বেসরকারি ভবন ও বিদেশে বাংলাদেশি মিশনেও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। আহত নিহতদের জন্য দেশের সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হবে।
প্রেস উইং জানায়, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় জরুরি প্রয়োজনে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারিতে ইমার্জেন্সি হটলাইন চালু করা হয়েছে। হটলাইন নম্বর-০১৯৪৯০৪৩৬৯৭।
উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা \ রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজ ক্যাম্পাসে বিধ্বস্ত হওয়া বিমান ও হতাহতদের উদ্ধার করা হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।
এই দুর্ঘটনার পর পরই ফায়ার সার্ভিসের নয়টি ইউনিট এবং তাদের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার কাজ শুরু করে। এ সময় হতাহতদের উদ্ধার করা সিএমএইচ, কুর্মিটোলা হাসপাতাল, বার্ন ইনিস্টিটিউট, ঢাকা মেডিক্যালসহ উত্তরার বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
এদিকে রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সোমবার শোকবার্তাটি পাঠান তিনি। শোকবার্তার ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকায় একটি মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনায় গভীরভাবে মর্মাহত ও দুঃখ বোধ করছি। নিহতদের মধ্যে অনেকেই তরুণ শিক্ষার্থী। পরিবারগুলোর জন্য আমাদের হৃদয় শোকাহত। এ ঘটনায় আহতদের দ্রæত আরোগ্য কামনা করছি।
শোকবার্তার শেষে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছে ভারত। সম্ভাব্য সকল সহায়তা ও সহযোগিতা প্রদানের জন্য ভারত প্রস্তুত রয়েছে। এ ছাড়া শোক জানিয়েছেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট, জাপান ও জাতিসংঘ।
শোক জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টার ভিডিও বার্তা \ মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় শোক জানিয়ে ভিডিও বার্তা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সোমবার রাতে দেওয়া ওই ভিডিও বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমার বলার কোনো ভাষা নেই। কীভাবে শুরু করব সেটাও বুঝতে পারছি না। আমার মতো সারাদেশের লোক আজ হতবাক। এ রকম একটা কাÐ ঘটতে পারে আমরা কেউ কল্পনাও করিনি, কারও ধারণার মধ্যে ছিল না। কিন্তু এই অবিশ্বাস্য চ্যালেঞ্জ আমাদের হঠাৎ গ্রহণ করতে হয়েছে। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের যে দুর্ঘটনা, প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে, ছোট ছোট শিশুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, আগুনে পুড়ে মরল, মা-বাবাদের আমরা কী জবাব দেব? কী বলব তাদের? আমরা নিজেদেরকেই তো জবাব দিতে পারছি না।’
তিনি বলেন, ‘অজানা শিশুদের ছবি ভেসে উঠছে। সারা জাতি হতভম্ব, বাকরুদ্ধ। শোকাহত বললে খুব কম বলা হবে। এই দুর্ঘটনার রেশ এখনো কাটেনি, এখনো লাশ আসছে হাসপাতালে। এখনো হাসপাতালে মারা যাচ্ছে, এখনো বাবা-মা সন্তান খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাদের কোনোদিন আর চেনা যাবে কি না, যাদের লাশ দেখছি তার মধ্যে আমার সন্তান আছে কি না, পৃথক করার তো কোনো উপায় নেই। এরা আমাদের সবারই সন্তান, হঠাৎ করে চিরদিনের জন্য চলে গেল। আমরা অবশ্যই তদন্ত করব, তদন্তে তো আর তারা ফিরে আসবে না।’
ভিডিও বার্তায় ড. ইউনূস আরও বলেন, ‘আমরা চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি, সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সব হাসপাতালে মানুষ ছুটে আসছেন। আমরা সবার কাছে অনুরোধ করছি হাসপাতালে ভিড় করবেন না। কারণ আহতদের জন্য এটা ভালো না। তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধের শক্তি নেই। আমাদের ভিড় থেকে তাদের শরীরে কী রোগ ছড়িয়ে পড়বে তা বলা মুশকিল। কাজেই দূরে থেকে দোয়া করেন সবাই। আমরা বাবা-মাসহ সবার কাছে আমাদের সহানুভ‚তি জানাচ্ছি। বাংলাদেশের যত সন্তান আছে সবাই আপনাদের সন্তান। আপনারা নিজেদের মনকে সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করুন। আমরাও নিজেদের মনকে সান্ত¡না দিচ্ছি। আমরা সবাই আপনাদের সঙ্গে আছি, পুরো জাতি আপনাদের সঙ্গে আছে।’
শোক দিবস পালনের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা শোক দিবস ঘোষণা করেছি। আমরা সবাই মিলে তাদের কথা স্মরণ করবো, তাদের আত্মার শান্তি কামনা করব, তাদের রুহের জন্য মাগফিরাত কামনা করব। আল্লাহ আপনাদের শান্তি দিক। জাতির সবাইকে, যারা এই দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত সবাইকে আল্লাহ শান্তি দিক। তাদের জন্য আমরা সবাই দোয়া করছি। আল্লাহ এই শিশুদের জান্নাতবাসী করুন।’
আহতদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার নির্দেশ \ সরকার উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের চিকিৎসা প্রদান করবে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। সরকারি হাসপাতাল ছাড়াও সকল বেসরকারি হাসপাতালে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যে কোনো ধরনের অপারগতায় রোগীকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট অথবা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর জন্যও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সোমবার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
প্যানেল মজি