
জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি
জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। এ জন্য প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করেছে। হাইকমান্ডের নির্দেশ মতে এবার প্রার্থী করার ক্ষেত্রে দলের ত্যাগী এবং ক্লিন ইমেজের নেতাদের প্রাধান্য দেওয়া হবে। ১০০ আসনে প্রাধান্য দেওয়া হবে তরুণ নেতাদের। এদিকে নিজ নিজ সংসদীয় আসনে প্রার্থিতা নিশ্চিত করতে চলছে নেতাদের দৌড়ঝাঁপ।
সূত্র জানায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি আগেই প্রতি আসনে ৩ জন করে সম্ভাব্য প্রার্থী ঠিক করে রাখে। তবে এখানেও নতুন করে সংযোজন বিয়োজন করে অধিকতর যাচাইবাছাই করা হবে। এখন নতুন উদ্যমে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া চলছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সম্ভ্যব্য প্রার্থীদের মধ্য থেকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য প্রার্থীদের নিয়ে সারাদেশে ৩০০ আসনের প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। তারপর সমমনা দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা হলে কিছু আসন ছেড়ে দেবে। আর তা না হলে সব আসনেই এককভাবে নির্বাচন করবে।
আর এ জন্যই আপাতত ৩০০ আসনেই দলীয় সম্ভাব্য প্রার্থীদের গণসংযোগ চালিয়ে যেতে কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে। সম্প্রতি লন্ডনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে ঐকমত্য হয়। এ ঘোষণার পর সারাদেশের ৩০০ সংসদীয় আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রস্তুতি আরও জোরদার করে। এলাকায় গণসংযোগের পাশাপাশি দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করতে বিএনপি হাইকমান্ডের আশীর্বাদ পেতে বিভিন্ন কৌশলে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন দৈনিক জনকণ্ঠকে জানান, একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির রাজনৈতিক প্রস্তুতি সবসময়ই থাকে। তবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে প্রস্তুতি আরও জোরদার হবে। এবারের নির্বাচনে জনগণ গণমুখী রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষে রায় দেবে।
বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য পুরোদমে প্রস্তুত। দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা সারাদেশের সকল সংসদীয় আসনেই নির্বাচনের প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে। আমরা কেউ বসে নেই, সবাই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করছে। বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি। তাই ভোটারদের মধ্যেও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। বিএনপি এবার ত্যাগী এবং অধিকতর গ্রহণযোগ্য জনপ্রিয় নেতাদের প্রার্থী দেবে। তাই সর্বজন গ্রহণযোগ্য প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে অধিকতর যাচাই-বাছাই করা হবে।
বিএনপি প্রতিটি সংসদীয় আসন থেকে ৩ জন করে নাম ঠিক করে ৩০০ আসনের জন্য ৯০০ জনের নামের একটি তালিকা ঠিক করে রাখে। সেই তালিকা দলীয় হাইকমান্ডের হাতে রয়েছে। তবে বর্তমানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ওই তালিকায় সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম আরও সংযোজন-বিয়োজন হবে।
এদিকে সারাদেশের ৩০০ আসনের পাশাপাশি সংরক্ষিত নারী আসনে যাদের দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে এমন সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কেও খোঁজখবর রাখছেন বিএনপি হাইকমান্ড। জানা যায়, আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন এবং জনপ্রিয়তা আছে এমন নারী নেত্রীদের এবার সংসদীয় সংরক্ষিত আসনগুলোতে মনোনয়ন দেবে বিএনপি। সূত্র মতে, হাইকমান্ডের নির্দেশে বিএনপির ক’জন সিনিয়র নেতা সারাদেশের সকল সংসদীয় আসনের জন্য খসড়া প্রার্থী তালিকা তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
সরাসরি এলাকায় খোঁজখবরের পাশাপাশি তারা এ বিষয়ে ফাইল ওয়ার্কও করছেন। এছাড়া বিভিন্ন মাধ্যমে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কে খোঁজখবর রাখছেন। তবে এ কাজটি তারা করছেন ধীর গতিতে। এ ছাড়া লন্ডন থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিটি সংসদীয় এলাকার সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কে খোঁজখবর রাখছেন।
বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র নেতারা আরও ক’মাস পর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সম্ভাব্য প্রার্থীদের একটি খসড়া তালিকা তৈরি করে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে দেবেন। তিনি আবার এই তালিকায় থাকা নেতাদের সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজখবর নেবেন। এর পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর যারা দলের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করবেন তাদের সবার স্বাক্ষাৎকার নেবেন। সর্বশেষ দলীয় সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফেরামে আলোচনা করে এবং চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মতামত নিয়ে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করবেন।
বিএনপি হাইকমান্ড সারাদেশে নির্বাচনী প্রস্তুতি এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় দলীয় প্রার্থী করার বিষয়ে বেশ ক’টি শর্ত দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে যারা বিগত দেড় দশকের আন্দোলন সংগ্রামে মাঠে সক্রিয় ছিলেন তাদের প্রার্থী করার বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এ ছাড়া প্রার্থী হতে হবে সুশিক্ষিত ও ক্লিন ইমেজের। যাদের নামে সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে তাদের প্রার্থী করা হবে না।
বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর যারা দখল-দুর্নীতিতে জড়িত হয়েছে তাদের প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না। এ ছাড়াও ভদ্র, ও মার্জিত প্রার্থীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে এলাকায় জনপ্রিয়তার বিষয়টিকেও প্রাধান্য দেওয়া হবে। তবে ১০০ তরুণ নেতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। সবকিছু মিলিয়ে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য প্রার্থীকেই এবার মনোনয়ন দেওয়া হবে বিএনপির পক্ষ থেকে এমন পূর্বাভাস আগেই দেওয়া হয়েছে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের অংশ হিসেবে লন্ডন থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিয়মিত সিনিয়র নেতাদের পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায়ের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করছেন। এ সময় তিনি তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের কাছ থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন। এ জন্য তিনি তৃণমূল নেতাদের কাছে কিছু তথ্যও জেনে নিচ্ছেন। যে তথ্যগুলো তিনি বেশি জানতে চাচ্ছেন তার মধ্যে রয়েছে- প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় এবার বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থী কে কে মাঠে সক্রিয়। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় কে?
বিএনপির দুর্দিনে কার ভূমিকা কি? এলাকায় অতীত রাজনীতি ও সামাজিক কর্মকা-ে কার কি অবদান এবং কাকে প্রার্থী করলে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে? এ ছাড়া অন্যান্য দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা কেমন? ২০২৬ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে এখনো প্রায় সাড়ে ৭ মাস সময় বাকি। তবে বিএনপি যে ধারায় নির্বাচনের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে তাতে ডিসেম্বরের মধ্যেই তা শেষ পর্যায়ে চলে যাবে। বিএনপি নেতাদের মতে, দীর্ঘ ১৫ বছর রাজপথের আন্দোলনও দলের নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ। কারণ, রাজপথে শক্তি প্রদর্শন করতে না পারলে নির্বাচনে অংশ নিয়েও তেমন সুবিধা আদায় করা যায় না।
তাই নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ও নিরপেক্ষ ইসির দাবিতে সমমনা দলগুলোকে নিয়ে রাজপথে যুগপৎ আন্দোলন ক্রমান্বয়ে জোরদার করেছে বিএনপি। পরে গতবছর জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বিএনপি ওই আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করে। তারই ফলশ্রুতি হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন। আর আওয়ামী লীগের পতন হওয়ায় বিএনপি এখন দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে বিএনপি ভালো করবে। কারণ, দেশে এখন রাজনৈতিকভাবে আধিপত্য রয়েছে বিএনপির। এ পরিস্থিতিতে ভালো প্রার্থী দিতে পারলে বিএনপি এবার অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে নির্বাচনে ভালো করবে।