ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের প্রতিক্রিয়া

নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে শঙ্কা বিএনপির ॥ ইতিবাচক জামায়াত-এনসিপি

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০০:১০, ১১ জুন ২০২৫

নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে শঙ্কা বিএনপির ॥ ইতিবাচক জামায়াত-এনসিপি

নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে শঙ্কা বিএনপি, জামায়াত-এনসিপি

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী বছরের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধের যে কোনো দিন অনুষ্ঠিত হবে। ঈদুল আজহার আগেরদিন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ ঘোষণার পর নড়েচড়ে বসেছে রাজনৈতিক দলগুলো। এপ্রিলে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট ঘোষণা আসায় নির্বাচনমুখী দলগুলোর মধ্যে একদিকে যেমন স্বস্তি এসেছে, অন্যদিকে নানা হিসাব-নিকাশ করে এপ্রিলে আদৌ নির্বাচন সম্ভব হবে কি না- এ নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছে অনেক দল। যে যাই-ই বলুক, এতদিন নির্বাচন নিয়ে যে ঘোলাটে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার পর সেই কালো মেঘ পুরোটাই কেটে গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত শুক্রবার (৬ জুন) সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন সংক্রান্ত চলমান সংস্কার কার্যক্রম পর্যালোচনা করে আমি আজ দেশবাসীর কাছে ঘোষণা করছি যে, আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথামর্ধের যে কোনো একটি দিনে অনুষ্ঠিত হবে। এই ঘোষণার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন উপযুক্ত সময়ে আপনাদের কাছে নির্বাচনের বিস্তারিত রোডম্যাপ প্রদান করবে।’
প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে বলেন, ‘আমি জানি, আগামী জাতীয় নির্বাচন কখন হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানার জন্য রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যে বিপুল আগ্রহ রয়েছে। আমি বারবার বলেছি, এই নির্বাচন ডিসেম্বর থেকে আগামীবছরের জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। এই সময়ের মধ্যে দেশে নির্বাচন উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যা যা করা দরকার, সরকার তাই করছে।’
এদিকে, নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণার পর কিছু দল স্বস্তি প্রকাশ করলেও অন্যতম বৃহৎ দল বিএনপিসহ আরও কিছু রাজনৈতিক দল এপ্রিলে নির্বাচন আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে অটল রয়েছে। তবে জামায়াতে ইসলামী ও নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। 
এ বিষয়ে বিএনপির বক্তব্যে হচ্ছে- এপ্রিল, মে ও জুন- এই সময়ে এসএসসি, এইচএসসি ও মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা থাকায় নির্বাচন আয়োজনের জন্য সময়টি মোটেও উপযুক্ত নয়। সবকিছু বিবেচনায় এপ্রিল মাসে নির্বাচন করাটা সুখকর বা যুক্তিযুক্ত নয়। এ বিষয়ে আরও চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। 
ঈদের দিন এক অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ‘এপ্রিল মাস কোনোভাবেই উপযোগী নয়’ মন্তব্য করে বলেছেন, যে সময়টি (এপ্রিল মাস) নির্ধারণ করা হয়েছে সেই সময়টি বাংলাদেশে নির্বাচনের জন্য সঠিক সময় নয়। এখানে (এপ্রিল মাস) আপনার প্রচ- গরম, ঝড়-বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। ওই সময়টি রোজার পরে পরেই, পাবলিক পরীক্ষা থাকে। সময়টা খুব চিন্তা করে দেওয়া হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।’
তিনি বলেন, ‘এছাড়া নির্বাচনী প্রচার চালাতে হবে রোজার মাসে যেটা ডিফিকাল্ট হবে। আমাদের যে রিমার্কস সেটা আমাদের স্ট্যান্ডিং কমিটি গত শুক্রবার রাতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা মতামত জানিয়েছেন। আমরা মনে করি যে, ডিসেম্বরেই নির্বাচন হওয়া সম্ভব এবং সেটাই জাতির জন্য উপযোগী হবে।’
এদিকে গত শনিবার মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা ইউনিয়নের নিজ গ্রামে তুলাপুর পাঁচগাঁও ঈদগাহে নামাজ আদায়ের পর সাংবাদিকদের জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, জাতি কোনো যেনতেন নির্বাচন চায় না। তিনি বলেন, সুষ্ঠুু বিচার, নির্বাচন কমিশনের সংস্কার, একটি ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ এবং ভোটের একটি সমতল মাঠ বা সমান সুযোগ নিশ্চিত করা গেলে ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্বাচন সম্ভব হবে। দেশের মানুষ পরপর তিনবার ভোট দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এবার নতুুন ভোটার এবং যুব সমাজকে ভোট প্রদানের সুযোগ করে দিতে হবে। যদি প্রধান উপদেষ্টা কোনো সহযোগিতা চান, জামায়াতে ইসলামী তা দিতে প্রস্তুত। তবে দেশের বর্তমান সংকট নিরসন হওয়া অত্যন্ত জরুরি।’
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পর একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘জুলাই সনদ, ঘোষণাপত্র ও বিচার শেষ হলে এপ্রিলে নির্বাচন করা যেতে পারে। তাছাড়াও আমরা চেয়েছিলাম সংস্কারের রূপ রেখাটি আগে হোক।’
নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা প্রথম থেকেই বলেছিলাম ‘বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন’ এই সরকারের তিনটি প্রধান কর্তব্য। প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্য শুধু রোডম্যাপ না, এই তিনটি বিষয় সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন যে, আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন। বিচারের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।’
জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা যা বলেন ॥ জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বর্তমান সরকারের বড় দায়িত্ব হলো একটি পরিচ্ছন্ন, উৎসবমুখর, শান্তিপূর্ণ, বিপুলভাবে অংশগ্রহণের পরিবেশে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। এমন একটি নির্বাচন আয়োজন করা যাতে করে দেশ ভবিষ্যতে নতুন সংকটে না পড়ে। এজন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। যেই প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাচনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত সেগুলোতে যদি সুশাসন নিশ্চিত করা না যায় তাহলে ছাত্র-জনতার সকল আত্মত্যাগ বিফলে যাবে।’
‘সংস্কার’, ‘বিচার’ ও ‘নির্বাচন’ এই তিনটি ম্যান্ডেটের ভিত্তিতে এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘সে বিবেচনায় আগামী রোজার ঈদের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে আমরা একটি গ্রহণযোগ্য জায়গায় পৌঁছাতে পারব বলে বিশ্বাস করি। বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, যা কিনা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের প্রতি আমাদের সম্মিলিত দায় সে বিষয়ে আমরা দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে পারব।’
এই সময়ের মধ্যে সরকার এসব ম্যান্ডেটের ন্যূনতম হলেও বাস্তবায়ন করে যেতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রধান উপদেষ্টা। সে বিবেচনায় ও ইতিহাসে সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য সব পক্ষের সঙ্গে সরকার আলোচনা করেছে বলেও জানান তিনি। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা এমন নির্বাচন চাই, যা দেখে অভ্যুত্থানের শহীদদের আত্মা তৃপ্তি পাবে, তাদের আত্মা শান্তি পাবে। আমরা চাই আগামী নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোটার, সবচেয়ে বেশি প্রর্থী ও দল অংশ নিক। এটা সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে জাতির কাছে স্মরণীয় থাকুক।’
তিনি বলেন, ‘দেড় যুগ পরে দেশে সত্যিকারের একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল সংসদ গঠিত হবে। বিপুল তরুণ গোষ্ঠী এবার জীবনে প্রথম ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবে। এসব লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আমরা জাতির কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ।’
দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনারা সব রাজনৈতিক দল এবং আপনাদের এলাকার প্রার্থীদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার আদায় করে নেবেন, যেন আগামী সংসদের প্রথম অধিবেশনেই যেসব সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য অর্জিত হয়েছে তা কোনো প্রকার কাটাছেঁড়া ছাড়াই যেন তারা অনুমোদন করেন। আপনারা ওয়াদা আদায় করে নেবেন যে, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও জাতীয় মর্যাদার প্রশ্নে কখনো কোনো প্রকার আপস করবেন না এবং দেশের বাইরের কোনো শক্তির কাছে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেবেন না।’
আগামী নির্বাচনে প্রার্থীদের কাছে ‘জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদা ক্ষুণœœ করবেন না’- মর্মেও প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিতে দেশবাসীকে অনুরোধ জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা তাদের কাছে অঙ্গীকার আদায় করে নেবেন যে, তারা সম্পূর্ণ সততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করবেন এবং সকল প্রকার দুর্নীতি, দলীয়করণ, টেন্ডারবাজি, সিন্ডিকেটবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ইত্যাদি গণবিরোধী কাজ থেকে নিজেদের সম্পূর্ণভাবে মুক্ত রাখবেন।’  
দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এবারের নির্বাচন শুধু শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করার বিষয় নয়। এটা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার নির্বাচন। এই নির্বাচনে পরিচিত দলগুলোই থাকবে। তাদের পরিচিত মার্কাগুলোই থাকবে। কিন্তু ভোটারকে বের করে আনতে হবে যে, এই মার্কার পেছনে আপনার কাছে ভোটপ্রার্থীরা কে কতটুকু ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার জন্য প্রস্তুত। কে কতটা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’
এই নির্বাচনে যারা ভোটার হবেন, তারা অত্যন্ত ‘সৌভাগ্যবান এবং সৌভাগ্যবতী’ উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা একটা অনন্য ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের সুযোগ ও দায়িত্ব পাচ্ছি। আমরা জাতির নতুন যাত্রাপথ তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব পাচ্ছি। আমাদের সুচিন্তিত ভোটের মাধ্যমেই নতুন বাংলাদেশ নির্মিত হবে। শহীদদের রক্তদান সার্থক হবে। আশা করি, বিষয়টা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেই সবাই ভোটকেন্দ্রে যাব এবং দৃঢ় প্রত্যয়ে ভোট দেব। এখন থেকে ভাবনা চিন্তা শুরু করুন। আলোচনা শুরু করুন। এখন থেকে আপনাদের ভোটের গুরুত্বটা বুঝে নিন। আপনার এবারের ভোটের গুরুত্ব ঐতিহাসিক মানদণ্ডে দেখা হবে।’
মিয়ানমারের রাখাইনের জন্য ‘বাংলাদেশ করিডর দিয়ে দিয়েছে’ বলে একটা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি সুস্পষ্টভাবে বলছি, এটি সর্বৈব মিথ্যা। এটা চিলে কান নিয়ে যাওয়ার গল্প। যারা অসত্য কল্পকাহিনী বানিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে ক্রমাগত বিভ্রান্ত করে অশান্তি সৃষ্টিতে নিয়োজিত, এটা তাদেরই শিল্পকর্ম।’
এ বিষয়ে দেশবাসীকে সতর্ক করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনারা এ বিষয়ে হুঁশিয়ার থাকবেন। কোনোভাবেই বিভ্রান্ত হবেন না। এসব ‘অপপ্রচার’ সত্ত্বেও আমরা লক্ষ্যচ্যুত হবো না। এই জটিল সমস্যা সমাধানে আমাদের কাজ চালিয়ে যাব।’
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ও আমাদের সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মিয়ানমারের সরকারসহ সেখানকার বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে বলেও জানান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘আমরা যত দেশেই সফর করেছি সব দেশে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় নেতা ও সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেছি, তাদের সহযোগিতা চেয়েছি। তারাও ইতিবাচকভাবে আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন।’

×