ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৪ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২

জুনেই ১৩০ কোটি ডলার ছাড়

অবশেষে আইএমএফের ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৩:৪২, ১৩ মে ২০২৫

অবশেষে আইএমএফের ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ

আইএমএফের ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ

নানা নাটকীয়তা শেষে বাংলাদেশকে ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ১৩০ কোটি ডলার দিতে রাজি হয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ঋণ ছাড়করণের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে শীঘ্রই কর্মকর্তা পর্যায়ের চুক্তি স্বাক্ষর করবে সংস্থাটি। এরপর জুনের শেষে আইএমএফের পর্ষদ সভায় ঋণ ছাড়ের প্রস্তাব উত্থাপিত হবে। ওই সভায় প্রস্তাব অনুমোদন হলে জুনের মধ্যেই ঋণের দুই কিস্তির অর্থ পেতে পারে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেছে। গভর্নর এখন দুবাই সফরে আছেন। সেখানে থেকেই তিনি ভার্চ্যুয়ালি আলোচনা করবেন। সংবাদ সম্মেলনে আইএমএফের ঋণ ছাড়ের বিষয়টি জানানো হতে পারে।  
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, আইএমএফের সঙ্গে আমাদের চলমান আলোচনা শেষ হয়েছে এবং সংস্থাটি ঋণের কিস্তি ছাড় করতে রাজি হয়েছে। এর আগে ডলারের বিনিময় হার নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে বাংলাদেশ ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারায় ঋণের কিস্তি পাওয়ার বিষয়টি ঝুলে গিয়েছিল। ডলারের বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে বলেছিল আইএমএফ। কিন্তু এতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকায় এই শর্তে দ্বিমত পোষণ করে আসছিল বাংলাদেশ। 
রিজার্ভ কমে যাওয়ায় বৈদেশিক দেনার চাপ সামাল দিতে ২০২২ সালে আইএমএফের দ্বারস্থ হয় বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফের পরিচালনা পর্ষদ। ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাত কিস্তিতে এই ঋণ দেওয়ার কথা। যথাসময়ে প্রথম তিন কিস্তির ২৩১ কোটি ডলার ঋণ পায় বাংলাদেশ।
সর্বশেষ কিস্তি পায় ২০২৪ সালের জুনে। চতুর্থ কিস্তি পাওয়ার কথা ছিল ডিসেম্বরে। কিন্তু নানা শর্তে সেই ঋণ আটকে যায়। পরে আইএমএফের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশ শর্ত পূরণ করলে চলতি বছরের মার্চে ঋণের চতুর্থ কিস্তি পাবে। কিন্তু আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ায় ঘোষণা আসে, চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি একত্রে চলতি বছরের জুনে দেওয়া হবে।
এ নিয়ে আলোচনার জন্য গতমাসে বাংলাদেশে আসে আইএমএফ মিশন। ওই সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ায়, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বসন্তকালীন বৈঠকের অবসরে আবারও আলোচনা হওয়ার ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ ছাড়ে সংস্থাটির প্রতিনিধি দল। ২১ থেকে ২৬ এপ্রিল ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বৈঠকের অবসরে আইএমএফ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুই দফায় আলোচনার টেবিলে বসেন অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নরসহ উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল।
ওই আলোচনায় দুই পক্ষ ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারায় বাংলাদেশে ফিরে পৃথক বক্তব্যে অর্থ উপদেষ্ট ও গভর্নর বলেছেন, শর্ত মেনে আইএমএফের ঋণ নিতেই হবে এমন অবস্থানে নেই বাংলাদেশের অর্থনীতি। এই পরিস্থিতিতে আইএমএফের আগ্রহে গত ৫ ও ৬ মে দুই দিন ভার্চুয়াল মিটিংয়ে বসে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা। আন্তর্জাতিক ঋণ দাতা সংস্থা আইএমএফ এর সঙ্গে চলমান ঋণের কিস্তি ছাড়ের আগে পর্যালোচনা সভা শেষ করেছে ঢাকা সফররত সংস্থাটির প্রতিনিধি দল। সেখানে কোনোরকম সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয় সফর।
ঋণের প্রতিটি কিস্তি ছাড় করতে আইএমএফ তার আগের কিস্তির অর্থের ব্যবহার পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়। প্রয়োজনে শর্ত সংযোজন-বিয়োজন করে সংস্থাটি। তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের সময়ে রিজার্ভ লক্ষ্যমাত্রার শর্ত শিথিল করেছিল আইএমএফ। আর্থিক সংকট সামাল দিতে ২০২২ সাল থেকে কয়েক দফা আলোচনা শেষে পরের বছরের প্রথম দিকে আইএমএফের সঙ্গে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি করে বাংলাদেশ।
আইএমএফের সঙ্গে ঋণ কর্মসূচি শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। সে বছর ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে পাওয়া গেছে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার। ২০২৪ সালের জুনে পাওয়া যায় তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার। 
তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার। তবে মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা, বিদেশী মুদ্রার নিট সঞ্চিতি বা রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ ও রাজস্ব ব্যবস্থায় সংস্থার ঠিক করে দেওয়া শর্ত পরিপালন না করায় ঋণের চতুর্থ কিস্তি ছাড় করেনি আইএমএফ।   
২০২২ সাল থেকে বাংলাদেশে ডলারের দাম বেড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ডলারের দাম কৃত্রিমভাবে ধরে রাখায় ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে হঠাৎ করে ডলারের দাম বাড়তে থাকে। আড়াই বছরে মার্কিন এই মুদ্রার দাম এই সময়ে ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে ১২০ টাকায় উঠেছে।
স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৩ বার আইএমএফের কাছ থেকে ছোট-বড় ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১২ সালে সর্বশেষ নেওয়া বর্ধিত ঋণসহায়তার (ইসিএফ) ১০০ কোটি ডলার পেয়েছিল বাংলাদেশ। সব কিস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এর আগে কোনো ঋণ কর্মসূচিই পুরোপুরি শেষ করা সম্ভব হয়নি।

সর্বশেষ ২০০৩ সালে দারিদ্র্য বিমোচন ও প্রবৃদ্ধি সহায়তা (পিআরজিএফ) কর্মসূচিতে ৪৯ কোটি ডলার পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাক্সিক্ষত সংস্কার না হওয়ায় তিন কিস্তি পাওয়ার পর বাকি তিন কিস্তি স্থগিত করেছিল আইএমএফ।
এ ছাড়া ১৯৯১ সালে আরেকটি ঋণ কর্মসূচির শর্ত হিসেবে অর্থনৈতিক সংস্কারে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় মাঝপথে স্থগিত হয়। পরের ১০ বছর আইএমএফের সঙ্গে কোনো ঋণ কর্মসূচিতে যায়নি বাংলাদেশ। ১৯৭৩ সালে আইএমএফের কাছে প্রথম প্রায় চার কোটি ডলার ঋণ নেয় বাংলাদেশ।

×