
জাপান-বাংলাদেশ
দুই দিনের নাটকের পর অবশেষে বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদার জাপানের সঙ্গে ষষ্ঠ ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) অনুষ্ঠিত হচ্ছে। চলতি মাসে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাপান সফরের প্রাক্কালে এফওসির বৈঠকই খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ। দুই দেশই গত কয়েক দিনে এফওসি নিয়ে যাবতীয় প্রস্তুতির কাজ প্রায় শেষ করে এনেছিল।
কিন্তু হঠাৎ করেই সোমবার পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন এফওসি হচ্ছে না বলে জাপানকে কূটনীতিক পত্র (নোট ভারবাল) দেওয়ার পর অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। তাৎক্ষণিকভাবে প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয় বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ায় বিকল্প উপায় হিসেবে সচিব (পূর্ব) নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে এফওসির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার হাই প্রোফাইল এমন সফরের আগে সচিব পর্যায়ের বৈঠকটি দুই পক্ষের কাছেই বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাপানের প্রস্তাবিত বিগ-বি প্রকল্প নয়াদিল্লির সঙ্গে বাংলাদেশের দূরত্ব সত্ত্বেও অগ্রগতির বিষয়ে আহ্বান জানাবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সহযোগিতা, রোহিঙ্গা সংকট সমাধান, প্রতিরক্ষা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও মানুষে মানুষে যোগাযোগের ওপর গুরুত্ব দেবে।
অন্যদিকে জাপানের পক্ষ থেকে মাতারবাড়িকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে দেশটির বিগ-বির বাস্তবায়নসহ আঞ্চলিক নিরাপত্তা, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সম্পর্ক এবং প্রতিরক্ষা খাতের সহযোগিতা সংক্রান্ত বিষয়গুলো উত্থাপন করবে বলে দুই দেশের কূটনীতিক সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।
পররাষ্ট্র সূত্র জানা গেছে, ১৫ মে জাপানের টোকিওতে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের নিয়মিত আলোচনা ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) বৈঠকের নির্ধারিত সময় ছিল। ইতোমধ্যে গত সপ্তাহে পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিনের নেতৃত্বে প্রস্তুতি সভাও করেছে এই সংক্রান্ত কমিটি। প্রাথমিকভাবে সবকিছু নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূতের বাসায় এই সংক্রান্ত আলোচনাও করেন পররাষ্ট্র সচিব।
সবকিছু ঠিক থাকার পর গত ১২ মে সোমবার শেষ মুহূর্তে জাপানকে কূটনৈতিকপত্র দিয়ে এফওসি স্থগিত করার অনুরোধ করেন পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন। এটি নিয়েই দুই দেশের কূটনীতিক পর্যায়ের হতাশা ভর করে। তখন এগিয়ে খোদ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। রাতারাতি ফলও মিলেছে। ফলে টোকিওতে নির্ধারিত সময়েই এফওসি বৈঠকে বসছে বাংলাদেশ-জাপান। বৈঠকে ঢাকার পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) ড. মো. নজরুল ইসলাম।
ঢাকার একটি কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, এফওসিতে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিনের। কিন্তু অজানা একটি কারণে পররাষ্ট্র সচিব সোমবার নোট ভার্বালের মাধ্যমে জাপান কর্তৃপক্ষকে জানায়, এই মুহূর্তে বৈঠকটি স্থগিত করার জন্য। বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় জানতে পেরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়, পররাষ্ট্র সচিবের অনুপস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশেষ সহকারী লুৎফে সিদ্দিকী বৈঠকে নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু লুৎফে সিদ্দিকী বৈঠকের নেতৃত্ব দিতে গেলে সেটি আর পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক থাকে না। তখন সেটি হবে প্রস্তুতিমূলক সভা। সেই কারণে অবশেষে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, চলতি মাসের শেষের দিকে জাপান সফরে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সরকারপ্রধানের সফর নিয়ে আলোচনা করার জন্য হলেও আসন্ন পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকটি বেশ গুরত্বপূর্ণ। সেই কারণে এটি না করার উপায় নেই।
অন্যদিকে এফওসির বিষয়টি নিয়ে বড় কোনো পরিবর্তন আসলে জাপানের মতো অংশীদার দেশ ভালোভাবে নেবে না। সেই কারণে প্রধান উপদেষ্টার টোকিও সফর ও জাপানের সঙ্গে বন্ধুত্ব বিবেচনায় সরকার পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকটি করার বিষয়ে ফের জাপানকে জানিয়েছে। আর সিদ্ধান্ত হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) ড. মো. নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন।
ঢাকাস্থ কূটনীতিকরা জানিয়েছেন, জাপানের মতো বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে সবকিছু আলোচনার পর শেষ মুহূর্তে এসে বৈঠক স্থগিত করার বিষয়টি ভালোভাবে নাও নিতে পারে দেশটি। কেননা দেশটি যে কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বরাবরই অনড় অবস্থানে থাকে। সে জন্য বৈঠকটি যেন হয় তার বিষয়ে জোরালো উদ্যোগ নেন জাপানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. দাউদ আলী।
এক কূটনীতিক জানান, চলতি মাসে জাপান সফর করবেন প্রধান উপদেষ্টা। প্রধান উপদেষ্টার সফরকে কেন্দ্র করে এবারের এফওসি বেশ গুরত্বপূর্ণ। আশার কথা হচ্ছে, নির্ধারিত সময়ে বৈঠকটি হচ্ছে।
কূটনীতিকরা জানিয়েছেন, টোকিওর পক্ষে দেশটির সিনিয়র ডেপুটি ফরেন মিনিস্টার আকাহরি তাকিশি নেতৃত্ব দেবেন। আলোচনায় দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সামগ্রিক বিষয় থাকবে। এক্ষেত্রে আলোচনার টেবিলে আসতে পারে, প্রধান উপদেষ্টার জাপান সফর, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যু, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা সমস্যা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা, মানুষে মানুষে যোগাযোগের মতো বিষয়গুলো।
ইতোমধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন সফর, ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল, দুই দেশের মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়ানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। এফওসিতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিষয়ে এগিয়ে আসতে জাপানকে বলবে। জাপানের পক্ষ থেকে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির বিষয়টিতে জোর দেওয়া হতে পারে নির্ভরশীল সূত্রের দাবি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র দাবি করেছে, ১৫ তারিখের বৈঠক দুটি অংশে অনুষ্ঠিত হবে। শুরুতে দুই দেশ দ্বিপক্ষীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করবে। পরবর্তী অংশে আঞ্চলিক ভূরাজনীতি ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা হবে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিস্থিতি তুলে ধরবে। জাপানের পক্ষ থেকে চীনসহ তাদের আঞ্চলিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হবে। বৈঠক সূত্র জানায়, আঞ্চলিক বিষয়াদিতে জাপানের বিগ-বি নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হবে।
এ সময় ঢাকার পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের বাস্তবতা তুলে ধরা হবে। সেই সঙ্গে এ প্রকল্প সামনে এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টিও বলা হবে। পরবর্তী সময়ে ভারত যদি এর সঙ্গে যুক্ত হতে চায়, তার ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হবে। ২০২৩ সালে ভারতে এক সফরে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে জাপান কাজ করবে- এমন আশা ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা।
এই সহযোগিতার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য বঙ্গোপসাগরীয় এলাকার সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে গোটা অঞ্চলকে স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধিশালী করে তোলা। বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা, যা ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি রূপায়ণে সহায়ক হয়ে উঠবে বলেও মন্তব্য করেন ফুমিও কিশিদা।
ঢাকায় জাপানের সদ্যবিদায়ী রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি গত ডিসেম্বরে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, জাপানের অবাধ ও মুক্ত ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিকল্পনার জন্য বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে কানেক্টিভিটি জরুরি। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে তা শুধু দ্বিপক্ষীয় ব্যবহারের জন্য নয়, বরং বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় যুক্ত করার জন্য। অঞ্চলিক কানেক্টিভিটির মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আস্থা ও বোঝাপড়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
এসব বাস্তবতা মাথায় রেখে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বলেন, জাপানের অবাধ ও মুক্ত ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য বিগ-বিতে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দিল্লির সঙ্গে বাস্তবতা ভিন্ন। সম্প্রতি চীন সফরে আঞ্চলিক কানেক্টিভিটির কথা বলে ভারতের তির্যক দৃষ্টিতে পড়েন প্রধান উপদেষ্টা। এই বাস্তবতায় ভারতকে এ প্রকল্পের সঙ্গে নিয়ে কতটুকু এগোনো সম্ভব, তা ভবিষ্যৎ বলবে।
মূলত ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এলাকায় শিল্পায়নকে সামনে রেখে এই বিগ-বি উদ্যোগটির পরিকল্পনা করা হয়। বিগ-বিকে তিনটি স্তম্ভের মধ্যে ভাগ করেছে জাপান। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সমৃদ্ধিতে অংশগ্রহণ করতে শুরুতে বাংলাদেশ থাকলেও পরে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে যুক্ত করে টোকিও।
বিগ-বির প্রথম স্তম্ভটি হলো শিল্প ও বাণিজ্য। দ্বিতীয় স্তম্ভ জ্বালানি। আর তৃতীয় স্তম্ভ পরিবহন ব্যবস্থা। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগর ঘিরে ক্রমেই চীনের উপস্থিতির কারণে পশ্চিমা শক্তির অস্বস্তি বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে চীনকে ঠেকাতে পরাশক্তিগুলো ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরে নিজ বলয় সৃষ্টি করছে। তারই একটি প্রয়াস জাপানের বিগ-বি প্রকল্প।
এর উদ্দেশ্য বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ অঞ্চলের পাশাপাশি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জাপানের বিনিয়োগের মাধ্যমে শিল্পায়ন সৃষ্টি। এরপর এ অঞ্চলের কানেকটিভিটি বা যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যবহার করে পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে আসা। সেখান থেকে বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন। এ প্রকল্পের মধ্যে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নও একটি অংশ। মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিদ্যুৎকেন্দ্র এ প্রকল্পের অংশ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, অঞ্চলে বলয় শক্ত করতে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সম্পর্ক বাড়াতে চায় জাপান। এ বিষয়ে গত বছর পঞ্চম এফওসিতে একমত হয়েছে বাংলাদেশও। এবারের এফওসিতে দুই দেশের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।
সেই সঙ্গে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল (আইপিএস), প্রতিরক্ষা, মেরিটাইম সিকিউরিটি, বাণিজ্য, বিনিয়াগ, কৃষি, কানেক্টিভিটি ও অবকাঠামোগত সহযোগিতার মতো বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা হবে। এ ছাড়া মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ও রোহিঙ্গা সংকটও আলোচনায় স্থান পেতে পারে। বৈঠকে সাম্প্রতিক বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যকার যে চুক্তিগুলো হয়েছিল, সেগুলোর হালনাগাদ নিয়ে আলোচনা হবে।