ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৮ মে ২০২৫, ২৫ বৈশাখ ১৪৩২

দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য ও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ

বিআরটিএ’র ৩৫ অফিসে দুদকের অভিযান

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:২৪, ৭ মে ২০২৫

বিআরটিএ’র ৩৫ অফিসে দুদকের অভিযান

বিআরটিএ’র ৩৫ অফিসে দুদকের অভিযান

ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির ফিটনেস সনদ প্রদানের ক্ষেত্রে ঘুষ লেনদেন, দালাল চক্রের দৌরাত্ম্যসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে রাজধানীর উত্তরা ও কেরানীগঞ্জ, চট্টগ্রাম, বরিশালসহ দেশের ৩৫টি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) অফিসে অভিযান পরিচালনা করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

বুধবার দুদকের ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা কার্যালয় থেকে একযোগে সংস্থাটির এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেক বিআরটিএ অফিসে অভিযান চালিয়ে দালালের উপস্থিতিসহ বিভিন্ন অনিয়ম হাতেনাতে শনাক্ত করা হয়েছে।
দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা সহকারী পরিচালক তানজির আহমেদ জানান, বুধবার সকাল থেকে সারা দেশের ৩৫ বিআরটিএর অফিসে একযোগে অভিযান পরিচালনা করা হয়। 
অবৈধভাবে ঘুষের বিনিময়ে ফিটনেসবিহীন গাড়িকে ফিটনেস দেওয়ার অভিযোগে বিআরটিএ, দিয়াবাড়ি, উত্তরাতে দুর্নীতি দমন কমিশন, সমন্বিত জেলা কার্যালয়, ঢাকা-১ থেকে একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযান পরিচালনাকালে বিআরটিএ অফিসের আশপাশে দালালদের দৌরাত্ম্য লক্ষ্য করা যায়। মোটরযান পরিদর্শক লাভলু শিকদার এর হোয়াটসঅ্যাপ এ বিকাশ লেনদেন সংক্রান্ত কথোপকথন পাওয়া যায়। এছাড়া যেসব গাড়িকে ফিটনেস দেওয়া হয়েছে সেগুলোর রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়। পরে রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা সাপেক্ষে বিস্তারিত প্রতিবেদন কমিশন বরাবর দাখিল করা হবে।
আমাদের স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতারা জানান, বুধবার বেলা ১১টা  থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত দিনাজপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয় চত্বরে বিআরটিএর অফিস ও আশপাশের কয়েকটি কম্পিউটার দোকানে অভিযান চালায় দুদক দিনাজপুর জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ইসমাইল হোসেন নেতৃত্ব এনফোর্সমেন্ট টিম।
অভিযানকালে ২টি কম্পিউটারের দোকান দুই স্বত্বাধিকারীকে ৪ দিন করে কারাদ- দিয়েছেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অভ্র জ্যোতি বড়াল। দ-প্রাপ্তরা হচ্ছেন, ফাতেমা কম্পিউটারের স্বত্বাধিকারী আবেদিন হাসান ও ফারুক কম্পিউটারের স্বত্বাধিকারী মুন্না ইসলাম। 
একই দুদকের বরিশাল সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রাজ কুমার সাহার নেতৃত্বে একটি টিম বরিশাল বিআরটিএ অফিসে অভিযান চালিয়ে সঞ্জীব কুমার দাস (৪৪) নামে এক দালালকে আটক করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পরে আটককৃতকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এক মাসের কারাদ- এবং দুইশ’ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
অপরদিকে দুদক খুলনার সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান শুভ্রর নেতৃত্বে একটি টিম খুলনার বিআরটিএ কার্যালয় অভিযান চালিয়ে আব্বাস আলী নামে এক দালালকে ১৫ দিনের কারাদ- দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত তারা এই অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় জব্দ করা হয়েছে বিভিন্ন নথিপত্র। 
অন্যদিকে চট্টগ্রাম জেলা অফিস ও বিভাগীয় অফিসে দুদক চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মো. এমরান হোসেনের নেতৃত্বে এনফোর্সমেন্ট টিম টানা কয়েক ঘণ্টা মহানগরীর বিআরটিএর মেট্রো-২ সার্কেল অভিযান চালায়। ছদ্মবেশে দুদক  টিম গ্রাহকসেবায় নিয়োজিত বিভিন্ন কাউন্টারের যাবতীয় কার্যক্রম নজরদারি করা হয় এবং সেবাগ্রহীতাদের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়।
চট্টগ্রাম দুদকের উপ-পরিচালক সোবেল আহমদ জানান, অভিযানে বিভাগীয় পরিচালক দাপ্তরিক কাজ অফিসের বাইরে থাকায় মেট্রো সার্কেল-২ এর উপ-পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) সৈয়দ আইনুল হুদা চৌধুরী কাছে অভিযোগ বিষয়ে রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান, গাড়ির ফিটনেস সনদ ইস্যু, রোড পারমিট প্রদানে সংস্থাটির কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী দালালদের যোগসাজশে দুর্নীতি ও গ্রাহক হয়রানির বিষয়ে রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়। 
দুদকের অভিযানকারী টিম জানায়, একটি অ্যাম্বুলেন্স বর্তমানে মাইক্রোবাস হিসেবে ব্যবহারের দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়। ওই মোটরযানের মালিক তানহা আক্তার মিলির পক্ষে তার স্বামী দ্বীন মোহাম্মদ দিনারকে জিজ্ঞাসাবাদে সে অনুমোদন না দিয়ে গাড়ির ধরন পরিবর্তনের কথা স্বীকার করে। উল্লেখ্য, দ্বীন মোহাম্মদ দিনার সিএমপির উত্তর বিভাগের সাজেন্ট।
অপরদিকে একই সময় দুদুকের পিরোজপুর সমন্বিত কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আরিফ হোসেন নেতৃত্বে ঝালকাঠি বিআরটিএ কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন অনিয়ম খুঁজে পান। এ সময় অভিযানের টের পেয়ে দালালরা পালিয়ে যায়। দুদক কর্মকর্তারা বিভিন্ন নথিপত্র তল্লাশি করেন। তারা আবেদনকারীদের প্রস্তুতকৃত ড্রাইভিং লাইসেন্স তিন দিনের মধ্যে ঘুষ ছাড়াই প্রদান করার নির্দেশ দেন।

অন্যথায় এ কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানায় দুদক। অভিযানকালে বিআরটিএ ঝালকাঠি কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক এসএম মাহফুজুর রহমান অফিসে ছিলেন না। তিনি পিরোজপুরেরও দায়িত্বে থাকায়, সেখানে ছিলেন বলে জানিয়েছেন। 
এদিকে দুদক রংপুর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাবদারুল ইসলাম নেতৃত্বে একটি টিম বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) নীলফামারী সার্কেল কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে সাজ্জাদ ইসলাম ও হোসেন আলী নামে দুই যুবকের ১ হাজার করে দুই হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে তারা জরিমানার টাকা পরিশোধ করেন।
অপরদিকে যশোর বিআরটিএ অফিসে অভিযান চালায় দুদকের টিম।  অভিযানকালে তিনজন দালাল হাতেনাতে আটক হয়। পরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের পরিচালিত মোবাইল কোর্টে দুই ১ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং অপর একজনকে একই পরিমাণ অর্থদণ্ডসহ তিন দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
একই সময় শেরপুরে বিআরটিএ দুদক টিম ছদ্মবেশে সেবাগ্রহীতা সেজে অভিযান চালানো হলে অফিসের কিছু স্টাফের সঙ্গে দালাল ও অফিসসংলগ্ন কম্পিউটার দোকানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। 
এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।
এছাড়া দুদক টিম বাগেরহাট বিআরটিএ অভিযানকালে আউটসোর্সিং কর্মীদের মোবাইল ফোনে অস্বাভাবিক লেনদেন ও টাকা আদান প্রদানের বার্তা পাওয়া যায়। পরীক্ষা খাতা পর্যালোচনায় দেখা যায়, অনেকে ফেল করলেও অনৈতিক সুবিধার মাধ্যমে পাস করানো হয়েছে।
অপরদিকে টাঙ্গাইল বিআরটিএ অফিস অভিযান চালায় দুদক টিম। অভিযানকালে সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে কথা বলার সময়, অভিযানের ভিডিওতে দেখা এক ব্যক্তির পরিচয় জানতে চাইলে মোটরযান পরিদর্শক জানান তিনি অফিসের কেউ নন। টিম মৌখিকভাবে নির্দেশনা দেয়, ওই ব্যক্তি কীভাবে হেল্প ডেস্কে বসেছেন তা যাচাই করার জন্য।
এদিকে একই সময় দুদক টিম গোপালগঞ্জ বিআরটিএ কার্যালয়ে অভিযানকালে লাইসেন্স ও ফিটনেস সনদ ইস্যুতে ঘুষ লেনদেন, রেজিস্টার খাতায় সিরিয়াল নম্বর ফাঁকা রেখে দুর্নীতির সুযোগ রাখা, দালালের মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, দীর্ঘদিন একই কর্মস্থলে থেকে কর্মকর্তাদের অনিয়মে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। 
ঠাকুরগাঁও বিআরটিএ কার্যালয়ে অভিযানকালে দালালদের দৌরাত্ম্য ও অনিয়ম স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। ২ জন দালালের মোবাইল নম্বর শনাক্ত করা হয়। 
এ ছাড়াও বিআরটিএ এর বগুড়া, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রাজবাড়ী, মৌলভীবাজার, চুয়াডাঙ্গা, খুলনা, কিশোরগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, মেহেরপুর, মাদারীপুর, নেত্রকোনা, নোয়াখালী, জয়পুরহাট, পাবনা, চঁাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিলেট, রাঙামাটিসহ মোট ৩৫টি কার্যালয়ে যুগপৎভাবে এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযান থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পরবর্তী ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রতিটি এনফোর্সমেন্ট টিম কমিশনের নিকট পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করবে এবং কমিশনের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে দুদক জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম জানান।

×