ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৬ মে ২০২৫, ২৩ বৈশাখ ১৪৩২

স্ক্যাবিস: নীরব এক মহামারি, বাংলাদেশে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে যে সংক্রমণ

প্রকাশিত: ১৩:১৬, ৬ মে ২০২৫

স্ক্যাবিস: নীরব এক মহামারি, বাংলাদেশে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে যে সংক্রমণ

ছবি: প্রতীকী

সম্প্রতি বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য খাতের জন্য নতুন এক উদ্বেগের নাম হয়ে উঠেছে 'স্ক্যাবিস'। চুলকানির এক সংক্রামক রোগ হলেও এর প্রভাব শুধু শারীরিক অস্বস্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্বাস্থ্যসেবার চাপ, কর্মক্ষমতার হ্রাস এবং সামাজিক দুর্ভোগ।

স্ক্যাবিস কী?

স্ক্যাবিস একটি ত্বকজনিত সংক্রামক রোগ, যার কারণ এক ধরনের ক্ষুদ্র পরজীবী কীট – সারকপটিস স্ক্যাবিই হোমিনিস। এই জীবাণুটি মানব ত্বকের নিচে ঢুকে পড়ে এবং সেখানে ডিম পাড়ে। ফলে তীব্র চুলকানি এবং লালচে ফুসকুড়ি দেখা দেয়।

এই রোগটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে এবং সাধারণত আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এটি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে, স্কুলে, ছাত্রাবাসে বা কর্মস্থলে দ্রুত ছড়াতে পারে।

বাংলাদেশে স্ক্যাবিসের বর্তমান পরিস্থিতি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষ দিকে থেকে ২০২৫ সালের শুরু পর্যন্ত স্ক্যাবিস সংক্রমণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরে দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় ২০ লাখের বেশি মানুষ স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হয়েছে, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় প্রায় তিনগুণ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শীতকালে স্ক্যাবিসের প্রকোপ বাড়ে, কারণ এই সময় মানুষ কম গোসল করে এবং শারীরিক সংস্পর্শও বেশি ঘটে। সেই সঙ্গে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাস্থ্যবিধির অভাব ও চিকিৎসার সীমিত সুযোগ স্ক্যাবিসের বিস্তারে ভূমিকা রাখছে।

স্ক্যাবিসের লক্ষণ

  • তীব্র চুলকানি (বিশেষ করে রাতে বেড়ে যায়)
  • লাল ফুসকুড়ি, ছোট ফোঁড়া বা ফাটল
  • হাতের আঙুলের ফাঁকে, কবজি, কোমর, বগল, স্তনের নিচে, যৌনাঙ্গ ও নাভির চারপাশে বেশি দেখা যায়
  • শিশুদের ক্ষেত্রে মাথা, মুখ ও পায়ের পাতাতেও সংক্রমণ হতে পারে

কারা বেশি ঝুঁকিতে?

  • একসাথে বসবাসকারী পরিবার
  • স্কুলগামী শিশু ও শিক্ষার্থীরা
  • ছাত্রাবাসে থাকা শিক্ষার্থীরা
  • পোশাক কারখানার শ্রমিক
  • দরিদ্র ও জনাকীর্ণ পরিবেশে বসবাসকারী মানুষ

প্রতিকার ও চিকিৎসা
স্ক্যাবিস সম্পূর্ণরূপে নিরাময়যোগ্য রোগ, তবে এর জন্য সঠিক চিকিৎসা ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা জরুরি। চিকিৎসার জন্য যা করা উচিত:

১. ঔষধ ব্যবহার

প্রধান ওষুধ হলো ‘পারমেথ্রিন ৫%’ মলম। এটি পুরো শরীরে মাখিয়ে ৮–১৪ ঘণ্টা রেখে ধুয়ে ফেলতে হয়।

বিকল্প হিসেবে বেনজাইল বেঞ্জোয়েট লোশন বা আইভারমেকটিন ট্যাবলেট ব্যবহার করা হয় (চিকিৎসকের পরামর্শে)।

২. পরিবারের সবাইকে চিকিৎসা দেওয়া

একজন আক্রান্ত হলে পরিবারের সবাইকেই চিকিৎসা নিতে হবে, যাতে রোগটি আবার না ছড়ায়।

৩. জিনিসপত্র জীবাণুমুক্ত করা

ব্যবহৃত জামাকাপড়, বিছানার চাদর, তোয়ালে ইত্যাদি গরম পানিতে ধুয়ে রোদে শুকাতে হবে।

কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়?

  • ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা
  • আক্রান্ত ব্যক্তির জামা-কাপড়, তোয়ালে বা বিছানার চাদর ব্যবহার না করা
  • বেশি মানুষ একসাথে শোয়া বা থাকলে সতর্কতা অবলম্বন
  • শিশুকে নিয়মিত গোসল করানো ও পরিষ্কার পোশাক পরানো
  • স্কুল বা ছাত্রাবাসে সচেতনতা বৃদ্ধি করা

সরকারের ভূমিকা ও করণীয়
বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর স্ক্যাবিস নিয়ন্ত্রণে জাতীয় পর্যায়ে সচেতনতা কর্মসূচি চালু করেছে। তবে মাঠপর্যায়ে চিকিৎসা সহজলভ্য করা, দরিদ্র এলাকায় বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিচালনা, এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্য সচেতনতা পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, স্ক্যাবিসকে ‘সাধারণ চুলকানি’ বলে অবহেলা না করে এটিকে একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা দরকার। কারণ, অল্প সময়ের মধ্যে চিকিৎসা না করলে এটি মারাত্মক চর্মরোগে রূপ নিতে পারে।

স্ক্যাবিস প্রাণঘাতী না হলেও এর প্রভাব সর্বব্যাপী। রোগটিকে অবহেলা না করে সচেতনতা এবং সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগ মিলেই এই নীরব মহামারিকে রোধ করা সম্ভব।

নুসরাত

×