
একটি স্বস্তিদায়ক বাজেট দেওয়ার প্রস্তুতি
জুলাই আন্দোলনের চেতনাকে সামনে রেখে নিজস্ব অর্থায়নে দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য একটি স্বস্তিদায়ক বাজেট দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো থেকে বিভিন্ন শর্ত মেনে বাজেট সহায়তা হিসেবে যে ঋণ নেওয়া হতো সেই নিয়মের মধ্য থেকেও বেরিয়ে আসতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। এ লক্ষ্যে নিজস্ব অর্থায়নে বাজেট করা এবং তা বাস্তবায়নে এবার সর্বোচ্চ জোর দেওয়া হচ্ছে।
আর তাই, ঢাউস আকারের বাজেট না করে বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট করা হবে। সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে কমানো হবে দ্রব্যমূল্য, সরকারের আয় বাড়াতে করের আওতা বাড়ানো হবে এবং যারা নিয়মিত কর দেন তাদের অহেতুক হয়রানি করা হবে না। তবে যারা ভ্যাট ও করফাঁকি দেন তাদের জন্য দুঃসংবাদ রয়েছে। এবার তারা করজালে আবদ্ধ হবেন। পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে বেশকিছু পদক্ষেপ থাকবে। আর বাজেটে এসবই করা হবে ছাত্র-জনতার জুলাই আন্দোলনের চেতনা ধারণ করে।
জানা গেছে, ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে বাজেট দেওয়ার পথে হাঁটছে অন্তর্বর্তী সরকার। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিদেশী ঋণে যেসব মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে সেই ধরনের নতুন কোনো উদ্যোগ থাকছে না এবারের বাজেটে। সরকার মনে করে, মেগা প্রকল্প মানে মেগা চুরি।
এ ছাড়া সংশ্লিষ্টদের মতে, বাজেট সহায়তা হিসেবে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার কাছ থেকে এতদিন যেভাবে ঋণ নেওয়া হচ্ছিল তাতে বিদেশী ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়ছে দেশের আর্থিক খাত। এই ঋণ নির্ভরতা থেকেও পর্যায়ক্রমে বেরিয়ে আসতে চায় সরকার। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বৈঠকে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে আভাস দিয়েছেন।
এ ছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই আয়োজিত এনবিআরের পরামর্শক কমিটির ৪৫তম সভায় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে কি ধরনের উদ্যোগ থাকছে সে বিষয়টি মোটামুটি স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
ওই বৈঠকে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে তার পরও সাধারণ মানুষকে স্বস্তিতে রাখতে সরকার চেষ্টা করছে। এ জন্য ব্যবসায়ীদের সহনশীল হতে হবে, আমরা সহনশীল থাকব। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে। জুলাই আন্দোলনের চেতনাকে সামনে রেখে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট দেব। আমরা বাজেটে প্রত্যাশার ফুলঝুড়ি দেব না।
আগে বড় বড় বাজেট অনুমোদন করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা যে বাজেট দেব, তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করব।’ সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত পালটা শুল্ক (রেসিপ্রকাল ট্যারিফ) নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করতে প্রয়োজনে আরও সময় চাওয়া হবে। ইতোমধ্যে ট্রাম্প প্রশাসন তিন মাস সময় দিয়েছে। আমরা দরকার হলে আরও সময় চাইব। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের যৌক্তিক দাবি আগামী বাজেটে প্রতিফলনে চেষ্টা করা হবে।
ভ্যাটও কর ফাঁকি রোধ হলে নিজস্ব অর্থায়নে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব॥ ভ্যাট ও কর ফাঁকি রোধ হলে ঋণ করে নয়, বরং নিজস্ব অর্থায়নে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য আগামী বাজেট বাস্তবায়নে রাজস্ব আহরণের ওপর জোর দেওয়া হবে। বিশেষ করে কর হার না বাড়িয়ে আওতা বাড়ানোর পথে সব ধরনের উদ্যোগ নেবে সরকার।
সম্প্রতি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে-২০২৩ সালে কর ফাঁকিতে দেশের রাজস্ব ক্ষতি ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। সিপিডির গবেষণা বলছে, এর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ হারিয়েছে করপোরেট কর ফাঁকির কারণে। ২০২৩ সালে করপোরেট কর ফাঁকির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় এক লাখ ১৩ হাজার ১১৮ কোটি টাকা।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১১ সাল থেকে কর ফাঁকির পরিমাণ বেড়েছে, ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৬ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা এবং ২০১৫ সালে তা এক লাখ ৩৩ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকায় পৌঁছায়। সিপিডির গবেষণায় বাংলাদেশের ক্রমাগত কর ফাঁকির পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ উঠে এসেছে।
এর মধ্যে আছে উচ্চ কর হার, প্রশাসনিক দুর্বলতা, জটিল আইনি কাঠামো এবং কর ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক দুর্নীতি। সিপিডির গবেষণা প্রতিবেদনে বলছে, কর ফাঁকির উচ্চ হার সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করে এবং যারা আইন মেনে চলে তাদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করে।
এদিকে, অর্থনীতির খারাপ সময়ের মধ্যেও রাজস্ব আদায় বাড়ছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান। তিনি বলেছেন, এত খারাপের মধ্যে রাজস্ব গ্রোথ ভালো আছে। এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ অনেক কম। যেটা সভ্য দেশের লক্ষ্য নয়। আমাদের সভ্য হতে হলে প্রত্যক্ষ কর আদায় বাড়াতে হবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, এখন থেকে প্রত্যক্ষ কর বাড়িয়ে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো হবে। আমাদের ১ কোটি ১৫ লাখের মতো টিআইএনধারী আছেন। তাদের মধ্যে রিটার্ন দাখিল করেন মাত্র ৪০ লাখ। বাকি প্রায় ৭৬ লাখ কিন্তু রিটার্ন দেন না। এখন যেসব টিআইএনধারী ট্যাক্স দেন না তাদের কাছে নোটিস পাঠনো হচ্ছে। অর্থ উপদেষ্টা জানিয়েছেন, কর আদায় বাড়ানো গেলে বাজেট বাস্তবায়ন অনেক সহজ হয়ে যাবে। রাজস্ব আদায় বাড়লে উন্নয়ন সংস্থার তেমন মুখাপেক্ষী হতে হবে না।
সম্প্রতি আইএমএফের বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা জোর দিয়ে বলেন, দেশের অর্থনীতি এখন বেশ শক্তিশালী। বাংলাদেশ এখন আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল নয়। শর্ত মেনে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হবে না। এদিকে, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে করের চাপ কমানোর দাবি জানিয়েছেন দেশের ব্যবসায়ী নেতারা। তাঁরা বলছেন, করজাল বৃদ্ধি না পাওয়ায় যারা কর দেন, তাদের ওপরই করের চাপ দেওয়া হচ্ছে।
এ ছাড়া পণ্য আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে রাজস্ব কর্মকর্তারা ব্যবসায়ীদের যে হয়রানি করেন, তা বন্ধ করতে হবে। সম্প্রতি এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান সাধারণ করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সের করদাতাদের জন্য এই সীমা পাঁচ লাখ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি ও ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনায় করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো জরুরি।
উল্লেখ্য, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। আগামী ২ জুন নতুন অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। সম্প্রতি কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল ও বাজেট ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সভায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ায় এবার আর সংসদে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করা হচ্ছে না।
অর্থ উপদেষ্টা বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবেন। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এ বাজেট ঘোষণা করা হবে। ঈদুল আজহার ছুটি শুরু হওয়ার আগেই বাজেট দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ কারণে ২ জুন সোমবার বাজেট ঘোষণার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সাধারণত আগের অর্থবছরগুলোতে জুনের প্রথম বৃহস্পতিবার বাজেট দেওয়া হতো। বাজেট ঘোষণার পর আগের রীতি অনুযায়ী অর্থ উপদেষ্টা বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেবেন।
নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা হবে। গত কয়েক বছর ধরেই দেশে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে অবস্থান করছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরও মূল্যস্ফীতির তেজিভাব লক্ষ্য করা গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি কমাতে আমদানি বাড়ানো ও নিত্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক মওকুফের মতো বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়ায় এবার রমজানে দ্রব্যমূল্য কমে আসে। ওই সময় ভোক্তারা বাজারে স্বস্তি পেয়েছেন।
কিন্তু এখন আবার একটু একটু করে বাড়তে শুরু করেছে নিত্যপণ্যের দাম। বিশেষ করে চাল ও ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে গেছে। সামনে বর্ষা মৌসুম শুরু হলে শাক-সবজির দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কোরবানি ঈদ সামনে রেখে মসলা জাতীয় পণ্য নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের তৎপরতা বাড়তে পারে। এ অবস্থায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। অন্যদিকে দেশে এখনো উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, যা ৯-১০ শতাংশের ঘরে থাকছে। তবে নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেবেন অর্থ উপদেষ্টা।