ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৫ ভাদ্র ১৪৩১

"বাংলাদেশে নিষিদ্ধ উপকরণ ভারতে ব্যবহারের সুযোগ থাকায় তাদের পোল্ট্রি ফিডের দাম কম"

পোল্ট্রি ফিড শিল্পে সিন্ডিকেট নেই

মাইনুদ্দীন আহমেদ

প্রকাশিত: ১২:০৫, ৮ আগস্ট ২০২৪

পোল্ট্রি ফিড শিল্পে সিন্ডিকেট নেই

পোল্ট্রি ফিড শিল্প। ছবি: সংগৃহীত

পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় স্থানীয় বাজারে মুরগির মাংস এবং ডিমের দাম বেশির জন্য মহল বিশেষের ‘সিন্ডিক্টে বা কারসাজি’ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন দেশের পোল্ট্রি শিল্পদ্যোক্তারা। একই সাথে তারা স্থানীয় শিল্পে উৎপাদিত ফিড, মুরগির মাংস এবং ডিমের তুলনামূলক বাড়তি দরের সুনির্দিষ্ট তথ্যসহ যুক্তি তুলে ধরেছেন।

বাংলাদেশে অনুমোদন না থাকা উপকরণ ভারতের পোল্ট্রি শিল্পে ব্যবহারের কারণে সে দেশের ফিডের দাম কমার অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছেন স্থানীয় পোল্ট্রি শিল্প সংশ্লিষ্ট সরকারী-বেসরকারী বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও উদ্যাক্তারা। তারা জানান, প্রথমতঃ ভারতের পোল্ট্রি ফিডে সস্তা প্রোটিন হিসেবে কসাইখানার শুকনো বর্জ্য (মানুষের খাওয়ার অযোগ্য মাংস, অন্ত্র, মাথা) এবং হারের গুড়া (এমবিএম) ব্যবহার করা হয়ে থাকে। দ্বিতীয়তঃ প্রাণীর রোগ প্রতিরোধের জন্য ফিডের সাথে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রোথ প্রমোটার (এজিপি) মিশিয়ে দেওয়া। ফলে খাদ্যে কম প্রোটিন থাকলেও তা বৃদ্ধি ও উৎপাদনে সহায়তা করে।

যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পশুখাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে মানব স্বাস্থ্যের ক্ষতি সম্পর্কে অগ্রীম সতর্কতা জারি করে বলেছে যে, প্রাণীর খাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করলে খামারের ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে উঠতে পারে। যার পরিণতিতে মানব দেহে মারাত্মক অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণ হতে পারে।

“অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের বিস্তার রোধ করতে সুস্থ্য প্রাণীর মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার বন্ধ করুণ” শিরোনামে ২০১৭ সালে প্রচারিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশনায় বলা হয়েছে যে, “কিছু দেশ চিকিৎসাগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মোট অ্যান্টিবায়োটিকের প্রায় ৮০ শতাংশই ব্যয় করে পশু বড় ও মোটাতাজাকরণ খাতে। ওই প্রকাশনায় রোগ নির্ণয় ছাড়া খাদ্য উৎপাদনকারী প্রাণীর দেহে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার সামগ্রীকভাবে কমিয়ে আনার সুপারিশও করা হয়।

এ প্রসঙ্গে দেশের শীর্ষস্থানীয় ফিড উৎপাদনকারী একটি প্রতিষ্ঠানের পুষ্টিবিদ নজরুল ইসলাম জানান, আন্তর্জাতিক সংস্থার সতর্কতা সত্তে¡ও ভারতীয় খামারে মুরগির রোগ হওয়ার আগেই এজিপি মিশ্রিত ফিড খাওয়ানো হয় এতে মুরগি মৃত্যুর হার কমায়। উপযুক্ত মাত্রায় প্রোটিন ও ক্যালোরির মিশ্রণ বিহীন সস্তা ওই খাবারের মুরগির দ্রæত ওজনসহ আকার বাড়ায়। ফলে মুরগি ও ডিমের উৎপাদন ব্যয় কমে যায়। বাংলাদেশে পশু খাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের অনুমোদন নেই ফলে খাদ্যে বেশী প্রোটিন ও এনার্জি ব্যবহার করতে হয়, অন্যথায় উৎপাদন ব্যহত হয়।

পক্ষান্তরে দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশের আলোকে পশু খাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করে। ফলে জনস্বাস্থ্য সচেতনতার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে পোল্ট্রি শিল্পে এজিপি ব্যবহারে পরিবর্তে খামারের মুরগির কাঙ্খীত বৃদ্ধির জন্য উৎপাদিত ফিডে উচ্চ মাত্রার পুষ্টি নিশ্চিত করতে বাড়তি ব্যয় করে। ফলে ফিডের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়।

একইভাবে ভারতের ফিড মিলে যেখানে ক্ষতিকারক ও ব্যয় সাশ্রয়ী এমবিএম ব্যবহার হয় সেখানে দেশীয় ফিডে প্রোটিন বাড়াতে আমদানি নির্ভর ও ক্রমেই ব্যয়বহুল হয়ে ওঠা সয়াবিন উপজাত ব্যবহার করে। আর এ উপজাত পুরোটাই আসে আমদানি নির্ভর সয়াবিন থেকে। মার্কিন ডলারের উচ্চ বিনিময় হারের কারণে সয়াবিন আমদানি ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধির ফলে সয়াবিন মিলের দামে অস্বাভাবিক প্রভাব ফেলেছে।

পোল্ট্রি ফিডের উৎপাদন প্রক্রিয়া জানতে সম্প্রতি রাজধানীর অদূরে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় অবস্থিত দেশের অন্যতম প্রধান কৃষিখাত সম্পৃক্ত কোম্পানী কাজী ফার্মসের ফিড মিল সরেজমিনে দেখেছেন এই প্রতিবেদক।

এ সময় আলাপচারিতায় মিলের সহকারী মহাব্যবস্থাপক আক্তার হোসেন জানান, দেশীয় পোল্ট্রি ফিডের অন্যতম প্রধান উপকরণ ভুট্টা। স্থানীয় উৎপাদনের পাশাপাশি অধিকাংশ ভুট্টার চাহিদাই আমদানি করে মেটাতে হয়। অথচ ভারত নিজস্ব চাহিদার অতিরিক্ত উৎপাদন করায় সে দেশের মিলগুলো কমদামে ভুট্টা ব্যবহার করতে পারে। আক্তার হোসেন জানান, স্থানীয় চাষিরাও আন্তর্জাতিক বাজার দরে ভুট্টা বিক্রি করায় কখনো কখনো তা ভারতের বাজার দামের চেয়েও বেশি হয়ে থাকে। এতে ফিড উৎপাদন খরচ ভারতের তুলনায় বেশি হয়।

দেশে ফিড মিল মালিকদের সংগঠন ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ফিয়াব) সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, উচ্চ আমদানি ব্যয়ে পাকিস্তান থেকে কোনো পোল্ট্রি পণ্য এনে স্থানীয় বাজারের দর নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। আর ভারতের সাথে বাংলাদেশের পোল্ট্রি পণ্যের উৎপাদন খরচের তুলনা করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জনাব নজরুল জানান, এ খাতের শতভাগ কাচামাল ওই দেশেই উৎপাদিত হয়। এর বাইরেও অসংখ্য বিকল্প উপাদন রয়েছে তাদের।

পক্ষান্তরে আমাদের ৬৮ শতাংশ পণ্যই আমদানি নির্ভর। গত দু’বছরে ডলার সঙ্কট ও ডলারের উচ্চ বিনিময় হারের কারণে উপকরণ আমদানিতে ডলার প্রতি খরচ বেড়েছে অন্তত ৩৭ টাকা। তিনি বলেন, ভারত, চীন, থাইল্যান্ডের বিশ্বখ্যাত ৯টি কোম্পানী শতশত কোটি টাকা ব্যয় করে বাংলাদেশে ফিড মিল স্থাপন করছে। যদি তাদের দেশ থেকে রপ্তানী করে আমাদের দেশে কম দামে বিক্রি করে আমাদের ফিডের বাজার তাদের আয়ত্বে নিতে পারত তাহলে তারা এই দেশে ফিড মিল স্থাপন করত না।

আলাপকালে কাজী ফার্মসের পরিচালক কাজী জাহিন হাসান বলেন, হালাল ইস্যুতে ভারতের ভোক্তারা যেহেতু উদ্বিগ্ন নয় তাই সেখানকার ফিডে অত্যন্ত সস্তা প্রোটিন এমবিএম (উচ্ছিষ্ট মাংস ও হারের গুড়া) ব্যবহার করা হয়। পক্ষান্তরে এমবিএম’এ শূকরের প্রটিন থাকতে পারে এবং মুসলিম ভোক্তারা ঐ ফিড খাওয়া মুরগি কিনবেন না আশঙ্কায় স্থানীয় ফিডের জন্য নিষিদ্ধ রয়েছে।

তিনি জানান, পোল্ট্রি ফিডের মেয়াদ থাকে উৎপাদন থেকে মাত্র ৪৫ দিন। এর পর এটির খাদ্যের গুনাগুণ হারিয়ে ফেলে। ফলে আমদানি করা ফিড খামারি পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় কেউ সাধারণত ফিড আমদানি করেন না। জনসংখ্যা বৃদ্ধিও সাথে সাথে পোল্ট্রি পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও বিভিন্ন কারণে এ খাতে গত কয়েক বছরের বিনিয়োগ স্থবির হয়ে রয়েছে বলেও জানান এই উদ্যোক্তা।

প্রশ্নোত্তরে কাজী জাহিন বলেন, সরকারের একাধিক সংস্থার ঢালাও মূল্য কারসাজির ভিত্তিহীন অভিযোগ, মামলা দায়ের আর কয়েকটি কোম্পানীকে হয়রানিমূলক, বড় ধরনের জরিমানার ঘটনায় এ খাতে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছে। এতে করে অদূর ভবিষ্যতে এ খাতে বড় ধরনের পণ্য ঘাটতির আশঙ্কাও ব্যক্ত করেন তিনি।

কাজী জাহিন হাসান বলেন, ডিম ও মুরগির ব্যবসার সাথে প্রতিদিন হাজার হাজার খামারি ও ব্যবসায়ি সরাসরি সম্পৃক্ত থাকেন। ফলে বহুপাক্ষিক ব্যবসাঘন প্রতিযোগিতাম‚লক বাজারে কারো পক্ষে সিন্ডিকেট বা কারসাজি করে দর বাড়ানো সম্পূর্ণ অসম্ভব। এ খাতে ব্যবসায়িক সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিৎ করার পাশপাশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে পোল্ট্রি কোম্পোনীগুলোর বিরুদ্ধে দায়ের করা ভিত্তিহীন সব মামলা প্রত্যাহার করা উচিৎ বলেও মনে করেন এই উদ্যোক্তা। 
 

টুম্পা

×