ডেঙ্গুর ভরা মৌসুম চলছে
ডেঙ্গুর ভরা মৌসুম চলছে। এ সময়টায় দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। আর এই বৃষ্টির জমে থাকা পানিতে প্রতিদিনই বাড়ছে এডিস মশার প্রজনন। ডেঙ্গুর সংক্রমণ ও মৃত্যুতে গতবছরের মতো চলতি বছরও রেকর্ড ছাড়ানোর আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। চলতি বছরের শুরু থেকে গত রবিবার পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৫৮ জনের। আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৬ হাজার ৯৬২ জনে।
এমন পরিস্থিতিতে এখনি এডিস মশার প্রজনন রোধে পদক্ষেপ না নিলে চলতি মাসের শেষে এবং সেপ্টেম্বরের শুরুতে সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত প্রায় এক সপ্তাহ দেশজুড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাত হয়েছে। কোথাও কোথাও টানা বৃষ্টিপাত হলেও বেশিরভাগ এলাকাতেই থেমে থেমে হচ্ছে বৃষ্টি। অতিবৃষ্টি এডিস মশার ঘনত্ব কমালেও থেমে থেমে বৃষ্টি ঘনত্বকে বাড়ায়। সাম্প্রতিক এই বৃষ্টি পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেড়েছে এডিস মশার ঘনত্ব।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রবিবার পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের মোট সংখ্যা ৬ হাজার ৯৬২ জন। এর মধ্যে ৬১ দশমিক শূন্য শতাংশ পুরুষ এবং ৩৯ দশমিক শূন্য শতাংশ নারী। এ সময়টায় মৃত্যু হয়েছে ৫৮ জনের।
ডেঙ্গুর এই ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিবৃষ্টির কারণে এডিস মশার ঘনত্ব কমলেও থেমে থেমে বৃষ্টি মশার ঘনত্বকে বাড়ায়।
আর তাই সাম্প্রতিক বৃষ্টি এডিস মশার প্রজননে খুবই উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছে উল্লেখ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্র্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার জনকণ্ঠকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেশের বিভিন্ন জায়গা জরিপ করে দেখেছি কিউলেক্স মশার তুলনায় এডিস মশার ঘনত্ব বেড়েছে কয়েকগুণ। ফলে বাড়ছে ডেঙ্গুও। মশার প্রজননের জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা হচ্ছে ২৫-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তাপমাত্রা যদি ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে হয় তখন যে কোনো মশার প্রজনন কমে যায়। তাপপ্রবাহে মশার প্রজনন কমলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে বর্ষাকালীন বৃষ্টি হওয়ায় আবারও উপযুক্ত আবহাওয়া পেয়েছে এডিস মশা। আমাদের দেশে সাধারণত জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হলেও চলতি বছর এর আগেই এর দৌরাত্ম্য শুরু হয়ে গিয়েছিল। আগস্টের শেষ এবং সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে তা নিয়ে আমরা আতঙ্কিত।
আমরা ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, চাঁদপুর, বরিশালসহ কয়েকটি জেলায় মশার ঘনত্ব পরীক্ষা করেছি। এসব জেলায় মশার ঘনত্ব অত্যাধিক। এখনি মশা নিধনে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। কার্যকর ব্যবস্থা বলতে শুধু সিটি করপোরেশন একা নয় সরকারের সবগুলো সংস্থার সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে মশা নিধনে পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এবং অতি অবশ্যই এতে জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার আওতাধীন জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অধীনে গত ১৭ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত চালানো প্রাক-বর্ষা জরিপে বলা হয়, রাজধানীর প্রায় ১৫ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। ঢাকা উত্তরের ১৪.৩০ শতাংশ এবং ঢাকা দক্ষিণের ১৪.৯৮ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে।
দুই সিটির ৯৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৮টিতে ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর বেশি। এর অর্থ হচ্ছে, এসব এলাকার ১০০টির মধ্যে ২০টির বেশি পাত্রে মশা বা লার্ভা পাওয়া গেছে। এই এলাকাগুলো ডেঙ্গুর বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। বর্ষার শেষ দিকে এ পরিস্থিতি কি হবে তা ভাবতে পারছেন না খোদ বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, গত কয়দিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টি হয়েছে।
বৃষ্টির পানি জমে থাকায় এডিসের প্রজননের সম্ভাবনা বেশি। এডিস মশার জীবনচক্র ডিম পাড়ার পরবর্তী সময় থেকে চারটি ধাপে ডিম, লাভা পিউপা এবং পূর্ণাঙ্গ অবস্থা সম্পন্ন হয়। তার জন্য এক সপ্তাহ বা কয়েক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। স্ত্রী এই মশাগুলো বন্যার সময় জলাধার যেমন, গাছের গর্ত বা উদ্ভিদ অক্ষের এর কাছাকাছি কালো রঙের ডিম জমা করে। ডিম পাড়ার জন্য সবচেয়ে উপযোগী জায়গা হচ্ছে মানুষের তৈরি জিনিসপত্র যেমন মাঠির পাত্র, প্লাস্টিকের বোতল এবং গাড়ির চাকা।
পানিতে নিমজ্জনের পর ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার এই প্রক্রিয়াটি কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগে। সেই হিসেবে আগামী দুই সপ্তাহ একটু বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এ সময়টায় নিজেকে মশার কামড় থেকে রক্ষার পাশাপাশি বাড়ির আঙিনায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। না হলে মাসের শেষে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হয় মূলত বর্ষাকালে। আগস্ট থেকে বাড়তে থাকে এর ভয়াবহতা। কিন্তু চলতি বছর মার্চের মাঝামাঝি থেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টি শুরু হয়। এতে এডিস মশারা তাদের প্রজননে উপযুক্ত আবহাওয়া পেয়ে গেছে বর্ষার আগেই। এখনো এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। আর এর অন্যতম কারণ হিসেবে ডেঙ্গুর প্রজননস্থল ধ্বংসে ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন তারা।
একইসঙ্গে আবহাওয়ার তারতম্যও সমানভাবে দায়ী উল্লেখ করে তারা বলছেন, এখনি এডিসের জীবাণুবাহী মশার প্রজননস্থল ধ্বংস না করতে পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। বছরের প্রথম ৭ মাসের আক্রান্ত ও মৃত্যুর এ পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে বৃষ্টি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বৃদ্ধি পাবে উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, এ বছর ডেঙ্গুর মৌসুমে বিশেষ করে আগস্টের শেষ এবং সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগাম পদক্ষেপ হিসেবে এডিস মশার প্রজননস্থল অপসারণ বা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। বিশেষ করে রাজধানী বা রাজধানীর বাইরে যেসব হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীরা চিকিৎসাধীন রয়েছেন তাদের বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করে ওইসব বাড়িতে ক্রাশ প্র্রোগ্রাম চালাতে হবে। একই সঙ্গে করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ রুখতে স্বাস্থ্যবিধি মানারও তাগিদ দিয়েছেন তারা।