ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

মন্ত্রণালয়ের বিভ্রান্তিকর ঘোষণার সুযোগ পুরো কাজে লাগিয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা

চামড়ার বাজারে নৈরাজ্য ॥ কারসাজি লবণে

এম শাহজাহান

প্রকাশিত: ২৩:৩৫, ২০ জুন ২০২৪

চামড়ার বাজারে নৈরাজ্য ॥ কারসাজি লবণে

চট্টগ্রামের অক্সিজেন এলাকার একটি আড়তে কোরবানির পশুর চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে

লবণ কারসাজিতে এবার চামড়ার বাজারে ধস নেমেছে। চামড়ার দাম নির্ধারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিভ্রান্তিমূলক ঘোষণার পূর্ণ সুযোগ কাজে লাগিয়েছে বেপারি, আড়তদার ও ট্যানারি মালিকরা। ফলে দেশের কোথাও মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্ধারিত সর্বনি¤œ মূল্য কার্যকর হয়নি। কাঁচা চামড়ার বাজারে বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। এতে করে ন্যায্য দাম না পেয়ে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় চামড়া ফেলে দেওয়া হয়েছে। একইভাবে ঢাকা ও পার্শ¦বর্তী জেলার মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লোকসান করেছেন।

সরকার নির্ধারিত মূল্য কার্যকর না হওয়ায় চামড়ার হকদার অসহায়, এতিম এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোও ঠকেছে। এ খাতে বিরাজ করছে অস্থিরতা। ন্যায্য দাম কার্যকর না হওয়ায় চামড়া পাচারের আশঙ্কা রয়েছে। একই সঙ্গে বিপুল পরিমাণ চামড়া নষ্ট করে দেওয়া হতে পারে। নেতিবাচক ধারণা পাচ্ছে চামড়ার বিদেশী ক্রেতারা। এ কারণে চামড়ার প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ এবং  তা কার্যকরে জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তথ্য মতে, কোরবানির কয়েকদিন আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবার লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়। দাম নির্ধারণের ওই বৈঠকে চামড়া খাতের ব্যবসায়ীরাও উপস্থিতি ছিলেন। এমনকি সাংবাদিক সম্মেলনের আগে চামড়া ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু। এর পরই শুধু লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। কিন্তু গত কয়েক দশকের রেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঢাকার কাঁচা চামড়ায় লবণ দেওয়ার কাজটি করে পোস্তার আড়তদার, বেপারি, পাইকার এবং সাভারের ট্যানারি মালিকরা।

সাধারণত মৌসুমি ব্যবসায়ীরা মাঠ পর্যায় থেকে লবণ ছাড়া চামড়া কিনে সেই চামড়া কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আড়তে নিয়ে আসেন। আড়তদাররা মৌসুমি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চামড়া কিনে লবণ দেওয়ার কাজটি করে থাকেন। কিন্তু এবার মন্ত্রণালয়ের ঘোষণায় লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। এর ফলে লবণ ছাড়া চামড়া বিক্রি হয়েছে নামমাত্র দামে। 
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ঈদের প্রথম দিন থেকে শুরু করে বুধবার পর্যন্ত যত চামড়া পোস্তা, হাজারীবাগ এবং সাভারের ট্যানারিতে এসেছে তা সবই লবণ ছাড়া। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে চামড়া বেচাকেনা হয়ে আসছে। সাধারণত কোরবানির পর ঢাকার বাইরের জেলাগুলো থেকে শুধু আড়তদাররা লবণযুক্ত চামড়া নিয়ে ট্যানারিতে বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন। একইভাবে পোস্তা ও হাজারীবাগের আড়ত মালিকরা লবণযুক্ত চামড়া সরবরাহ করেন ট্যানারিতে।

কিন্তু কোরবানিদাতা কিংবা মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়ায় লবণ দেওয়ার কাজটি করেন না। কিন্তু সরকারি ঘোষণা থাকায় এবার এ খাতের অসাধু ব্যবসায়ীরা আরও বেশি সুযোগ নিয়েছেন। লবণছাড়া চামড়া কিনে নিয়েছেন পানির দরে। কোথাও অর্ধেক দামেও চামড়া বিক্রি হয়নি। ছাগলের চামড়া নেওয়া হয়েছে বিনামূল্যে। ঢাকার মুগদাপাড়ার মৌসুমি ব্যবসায়ী হালিম তালুকদার জানান, কোরবানি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোরবানিদাতারা সেই চামড়া মৌসুমি ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি কিংবা এতিমখানায় দান করে থাকেন।

ঢাকায় মাঠ পর্যায়ে চামড়ায় লবণ দেওয়ার কোনো রেওয়াজ নেই। আমরা (মৌসুমি ব্যবসায়ী) কোরবানিদাতা কিংবা মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে চামড়া কিনে সেই চামড়া ঈদের দিনই পিকআপে পোস্তা, হাজারীবাগ কিংবা সাভারে নিয়ে যাই। এই সময়ের মধ্যে কখনই লবণ দেওয়ার কাজটি করা হয় না। লবণ যা দেওয়ার তা আড়ত কিংবা ট্যানারিতে করা হয়। কিন্তু এবার সরকারি ঘোষণা থাকায় আড়তদার, বেপারি ও ট্যানারি মালিকরা সুযোগ নিয়ে চামড়ার দাম কমিয়ে দিয়েছে।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, লবণ দেওয়া একটি জটিল বিষয়। চামড়ার আড়তদার ব্যবসায়ীরা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমিক দিয়ে এই কাজটি করিয়ে থাকেন। ফলে লবণযুক্ত চামড়ার বিষয়টি একটি অজুহাত মাত্র। এদিকে, আড়তদার ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার এবার লবণযুক্ত চামড়া বেচাকেনার ঘোষণা দিয়েছে। তাই যারা লবণ ছাড়া চামড়া এনেছে তারা দাম কম পেয়েছেন। 
উল্লেখ্য, প্রতিটি চামড়ায়  ১৫০-২০০ টাকার লবণ প্রয়োজন পড়ে। লবণযুক্ত করার পর প্রতিটি চামড়া কমপক্ষে ১ হাজার টাকায় কেনার জন্য দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এবার কোরবানির পশুর লবণযুক্ত চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুটে ৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ঢাকার  ভেতর গরুর চামড়ার দাম ধরা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ৬০ টাকা। যা গত বছর নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। আর ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০-৫৫ টাকা।

যা গত বছর ছিল ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা। লবণযুক্ত ভালোমানের চামড়া সরকার নির্ধারিত দামে কেনার প্রতিশ্রুতি দিলেও লবণ ছাড়া কাঁচা চামড়ার দামের নিশ্চয়তা দিতে পারেননি বাংলাদেশ ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ। তিনি জানান, এবার  কোরবানির পশুর ১০ লাখ পিস লবণ ছাড়া চামড়া কেনার টার্গেট ছিল তাদের। এর মধ্যে প্রায় ৮ লাখ পিস সংগ্রহ হয়ে গেছে। লবণযুক্ত চামড়া নির্ধারিত দামেই বেচাকেনা হবে। কিন্তু লবণছাড়া চামড়া কম দামে বিক্রি হয়েছে। মফঃস্বলে চামড়ার ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, সময়মতো লবণ ব্যবহার না করায় গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে চামড়ার দাম কোথাও কোথাও কমে গেছে। 
জানা গেছে, ঢাকা ও আশপাশের জেলায় কোরবানির চামড়া বিক্রি হয়েছে অর্ধেকেরও কম দামে। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট লবণছাড়া চামড়া পানির দরে কিনে নিয়েছেন। কোরবানির দিন ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারাদেশে কয়েক হাজার কোটি টাকার লবণছাড়া চামড়া নামমাত্র মূল্যে বিক্রি হয়েছে। এতে করে অসহায়, এতিম এবং মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ঠকলেও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের পকেট ভারি হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, কোরবানির চামড়া নিয়ে সরকারের নীতিগত সহায়তা খুব দুর্বল। আর এই দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। ফলে চামড়ার ন্যায্য দাম কখনোই কার্যকর হচ্ছে না।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহর, জেলা ও উপজেলা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, লাখ টাকার ওপর বড় গরুর চামড়ার দাম ২০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। অপরদিকে ছোট ও মাঝারি আকারের গরুর চামড়া ২০০ থেকে ৩০০ টাকা উঠলেও ছাগলের চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কোরবানিদাতারা। গরুর চামড়ার সঙ্গে ছাগলের চামড়া ফ্রি দেওয়া হয়েছে। আবার কোথাও প্রতিপিছ ছাগলের চামড়া ৫-১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আবার ভালো দাম না পেয়ে রাগে-ক্ষোভে কেউ কেউ চামড়া ফেলে দিয়েছেন বলেও জানিয়েছেন স্থানীয় রিপোর্টাররা। 
এদিকে, দুই দশক আগেও সারাদেশের চামড়ার মূল ক্রেতা ছিলেন পুরান ঢাকার পোস্তার ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে সারাদেশের ২৫ শতাংশ কাঁচা চামড়া পোস্তায় বেচাকেনা হয়ে থাকে। তবে লবণযুক্ত সব চামড়াই ট্যানারি মালিকদের কাছে যায়। ট্যানারি মালিকদের কাছে চামড়া বিক্রির আগে লবণ দেওয়ার কাজটি করেন পোস্তা, হাজারীবাগ, আমিনবাজারের আড়তদার ব্যবসায়ীরা। এছাড়া নাটোরসহ সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার হাট বসে।

এ প্রসঙ্গে কাঁচা চামড়ার আড়তদারদের সংগঠন হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিএইচএসএমএ)-এর সভাপতি আফতাব খাঁ জনকণ্ঠকে বলেন, এ বছর আমরা ১ লাখ পিসের বেশি পশুর চামড়া কেনার লক্ষ্য নিয়েছিলাম। এর মধ্যে ঈদের দিন ৮০ শতাংশ চামড়া সংগ্রহ হয়েছে। এখন চামড়ায় লবণ দেওয়ার কাজ চলছে। তিনি বলেন, ঢাকায় আড়তে যেসব চামড়া আনা হয় তা বেশিরভাগই লবণছাড়া। এ কারণে দাম কিছুটা কমেছে। তবে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে লবণযুক্ত  যেসব চামড়া আনা হবে সেগুলোর ভালো দাম মিলবে বলে আশা করছি।

লবণ লাগানোর কাজে নিয়োজিত শ্রমিকের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কাঁচা চামড়ার দাম বাড়ানোর সুযোগ থাকে না বলে জানান এ আড়তদার। আর লবণ লাগানোর পর ট্যানারি মালিকরা সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া না কিনলে তাদের লোকসানের মুখে পড়তে হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও জানিয়েছেন, আড়তের ইশারায় তাদের অনেক কম মূল্যে চামড়া কিনতে হয়েছে। এর ফলে অনেক বিক্রেতাই চামড়া বিক্রির আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন, কেউ কেউ মাটিতে পুঁতে ফেলেছেন আবার কেউ পুড়িয়ে দিচ্ছেন।

এর ফলে, একদিকে যেমন চামড়া শিল্পের সম্পদ অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে গরিবরা বঞ্চিত হচ্ছেন। দেশের বাজারে চামড়ার মূল্য কম থাকায় চামড়া পাচারেরও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গরুর মূল্য কম হলেও চামড়ার মূল্য বেশি। বিশ্বে চামড়া আহরণযোগ্য মোট পশুসম্পদের মধ্যে ২ শতাংশের আবাসভূমি হলো বাংলাদেশে আর কোরবানির ঈদ এই চামড়া আহরণের সবচেয়ে বড় সুযোগ নিয়ে আসে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সমন্বয় ও পরিকল্পনার অভাবে এই সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। দেশে চামড়া শিল্পে কমপ্লায়েন্সে ঘাটতি থাকায় পোশাকের মতো এদেশের চামড়া ইউরোপ ও মার্কিন বাজারে রপ্তানি করা যাচ্ছে না।

×