ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৯ মে ২০২৫, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

রোজায় লাফিয়ে বেড়েছে ওমরাহর খরচ

​​​​​​​আজাদ সুলায়মান

প্রকাশিত: ২৩:১৮, ১৫ মার্চ ২০২৪

রোজায় লাফিয়ে বেড়েছে  ওমরাহর  খরচ

.

 রমজান এলে কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ীদের মতোই ওমরাহ ব্যবসায়ীরাও দিশাহারা হয়ে পড়ে। ৭শটাকার গরুর মাংস যেভাবে ৮শটাকা হয়ে পড়ে, পাঁচশটাকার খেজুর যেভাবে ৯শটাকায় ওঠে, ৪০ টাকার শসা যেভাবে ১০০ টাকায় পৌঁছে, ৪০ টাকার লেবু যেভাবে ১০০ টাকা হয়, ঠিক একই কায়দায় ৯০ হাজার টাকার ওমরাহ প্যাকেজ লাখ ৩০ হাজার টাকা হয়ে যায়। রোজার আগে সবচেয়ে কম খরচে ওমরাহ করা যেত মাত্র ৯০ হাজার থেকে এক লাখ টাকায়। সেই একই প্যাকেজে এখন বাড়তি গুনতে হচ্ছে আরও অন্তত ৩০-৫০ হাজার টাকা। এজেন্সিগুলো যেন কসাইয়ের মতোই হাজিদের পকেট কাটার নেশায় থাকে।

সারা বছরের ব্যবসা তারা এই এক মাসেই পুষিয়ে নিতে চায়। এমন মানসিকতা নিয়েই মাঠে নামে হজ এজেন্সিগুলো। তারা এয়ারলাইন্সের দোহাই দিয়ে ওমরাহ প্যাকেজের দাম বাড়ায় অন্তত ২০-৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত। ওমরাহ ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, তাদের কোনো দোষ নেই, সব দোষ এয়ারলাইন্সের আর মক্কা মদিনায় বাড়ির মালিকরদের ওপর। অন্যদিকে এয়ারলাইন্সগুলো জানিয়েছেÑ ওমরাহ বা রমজান উপলক্ষে উড়োজাহাজ ভাড়া বাড়ানো হয়নি। টিকিটের চাহিদা বাড়ায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভাড়া বেড়েছে। অর্থাৎ যাত্রী চাহিদা বাড়লে এমনিতেই উড়োজাহাজে ভাড়া বেড়ে যায়।

এহেন সমস্যা নিরসনে রমজানে ওমরাহ যাত্রীদের ভাড়া স্বাভাবিক সময়ের মতো রাখতে ঢাকায় দেশ-বিদেশের এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) নেতারা। তারা বলছেন, হজের খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেশের অনেক মানুষ কম খরচে ওমরাহ করার সিদ্ধান্ত নেন। উপযুক্ত সময় হিসেবে রমজানকে বেছে নেন। সুযোগে দেশ থেকে সৌদি আরবের বিভিন্ন গন্তব্যে ফ্লাইট না বাড়িয়ে টিকিটের কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে এয়ারলাইন্সগুলো। প্রক্রিয়াটি তারা খুবই চাতুটের সঙ্গে করে। বিষয়টি সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। কেননা আগে হজের প্যাকেজ খরচ নাগালে ছিল। যাদের আর্থিক সচ্ছলতা ছিল, তারা হজে যেতে পারতেন। এক বছর আগে হঠাৎ হজের খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তাই ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা ওমরাহ পালনে যথেষ্ট আগ্রহী হয়ে উঠেন।

এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে-হাব সভাপতি শাহাদত হোসাইন তসলিম বলেন, রমজানে তো সব জিনিসেরই দাম বাড়ে। এর স্বাভাবিক যৌক্তিকতা তো শীর্ষ অর্থনীতিবিদরাও জানেন। ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাইয়ের যে ক্যারেক্টার, সেটাই দায়ী। এখানে তো কৃত্রিম সংকট তৈরি করে জিম্মি করছে না। একইভাবে ওমরাহ পালনকারীরাও কিছুটা বাড়তি অর্থ গুনেন। এর প্রধান কারণ কিন্তু শুধু টিকিট নয়। যেটা আমরা সবাই ঢালাওভাবে দায়ী করি। রমজানে ওমরাহ প্যাকেজের দাম বাড়ার প্রধান কারণ কিন্তু মক্কা মদিনায় অস্বাভাবিক দাম বাড়ানো। রমজানের আগে হেরেম শরীফের আশপাশের তারকা খচিত হোটেলগুলোতে যেই রুমের ভাড়া পাওয়া যায় মাত্র ২০ হাজার টাকায় সেটা রমজানে হয়ে যায় গুণ বেশি  অর্থাৎ কমপক্ষে ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকায়। দুনিয়ার সব ওমরাহ পালনকারীরা রমজানকেই বেশি প্রাধান্য দেয়, সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ এই সুযোগটাকে কাজে লাগায়। বাড়ি ভাড়া হোটেল ভাড়ার পর রয়েছে ওমরাহ হজের বিভিন্ন চার্জ। সেটাও বৃৃদ্ধি করা হয়। তারপরের প্রশ্ন হচ্ছে টিকিটের প্রসঙ্গ। আমাদের দেশে টিকিটের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সবার আগে থাকে সাউদিয়া বিমান। দুটো শীর্ষ এয়ারলাইন্স যদি, বিশেষ করে বিমান টিকিটের দাম কমাত, তাহলে অন্যরাও কমাতে বাধ্য হতো।

তিনি বলেন, সৌদি আরবের অপর এয়ারলাইন্স নাস এয়ার ঢাকা থেকে ফ্লাইট চালু করার পর থেকেই টিকিটের দাম অনেক কমিয়েছে। কিন্তু নাসের ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি সপ্তাহে মাত্র ৩টি। যদি প্রতিদিন ফ্লাইট থাকত তাহলে টিকিট নিয়ে এত নৈরাজ্য দেখা দিতো না।

অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ বলেন, এটা এখন স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে রমজানে ওমরাহ টিকেটের দাম বাড়া। সারাবিশ্ব থেকেই মুসলমানরা সৌদ আরবে ওমরাহ করতে যান। সময় ভাড়া অনেকটা বেড়ে যায়। তবে এয়ারলাইন্সগুলো ফ্রিকোয়েন্সি বাড়িয়ে প্রবণতায় লাঘাম টানতে পারত।

এদিকে মাঠ পর্যায়ের ওমরাহ পালনকারীরা জানিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবের জেদ্দা মদিনায় সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সাউদিয়া। রুটে স্বাভাবিক সময়ে বিমানের রিটার্ন (যাওয়া-আসা) টিকিটের মূল্য ৭০-৭৫ হাজার টাকার মধ্যে ওঠানামা করে। এর কাছাকাছি ভাড়া থাকে সাউদিয়ারও। তবে এখন রমজানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জেদ্দা রুটের ভাড়া লাখ টাকার কমবেশি। সাউদিয়ার ভাড়া এক লাখ ২০ হাজার টাকার ওপরে ওঠানামা করছে। অর্থাৎ বিমান সাউদিয়ার টিকিটে জনপ্রতি ৪০-৪৫ হাজার টাকা বেশি ভাড়া বেড়েছে। ছাড়া এয়ার অ্যারাবিয়া, এমিরেটস, ফ্লাই দুবাই, গালফ এয়ার, জাজিরা এয়ারওয়েজ, কুয়েত এয়ারওয়েজ, কাতার এয়ারওয়েজ, এয়ার ইন্ডিয়া, ভিসতারা এয়ারলাইন্স, ওমান এয়ার এবং সালাম এয়ার নিজ দেশে ট্রানজিট দিয়ে ঢাকা থেকে সৌদি আরবে যাত্রী পৌঁছে দেয়। ট্রানজিট যাত্রার লম্বা সময়ের কারণে এসব ফ্লাইটে আগে ভাড়া তুলনামূলক কম ছিল। তবে রমজান মাস কেন্দ্র করে তারাও ভাড়া বাড়িয়েছে।

হঠাৎ দুবছর ধরে হজ ওমরাহ পালনের ব্যয় বাড়া প্রসঙ্গে হাব জানিয়েছে, এটা শুধু বাংলাদেশের নয়, এটা বৈশ্বিক। করোনার কারণে ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে হজযাত্রী পরিবহন বন্ধ ছিল। একইভাবে ওমরাহ যাত্রীরাও সৌদিতে যেতে পারেননি। পরের বছর সীমিত পরিসরে বাংলাদেশ থেকে হজযাত্রীরা সৌদি আরব গেছেন। পরে ২০২২ সালে হজ এবং ওমরাহ করার পরিবেশ স্বাভাবিক হয়। কিন্তু ২০২৩ সালে মূল হজের প্যাকেজ খরচ বেড়ে যায়। তখন থেকে অনেকে হজ করার সিদ্ধান্ত বাতিল করে কম খরচে ওমরাহ করার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য রমজানে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে ওমরাহ অফিসগুলোতে। আর সেটার সুযোগ নেয় এয়ারলাইন্সগুলোও।

মাসুদ নামের এক ওমরাহ পালনকারী বলেন, রমজান মাসের অপেক্ষায় থাকে সারাবছর না খেয়ে থাকা ওমরাহ এজেন্সিগুলো। নইলে গত মাসে ঢাকা থেকে সাউদিয়ার মাধ্যমে স্বাভাবিক ভাড়া ৭০ হাজার টাকার স্থলে এখন লাগছে লাখের ওপরে। একই অবস্থা কুয়েত এয়ারের। স্বাভাবিক সময়ে ৫৫-৬০ হাজার টাকায় যাত্রী বহন করত কুয়েত এয়ার। এখন তাদের ওয়েবসাইটে কুয়েতে ট্রানজিট দিয়ে ঢাকা-জেদ্দা টিকিট ৯৫ হাজার টাকা করে দেখাচ্ছে। এয়ার ইন্ডিয়া ভারতে ট্রানজিট দিয়ে ভাড়া দেখাচ্ছে ৯০ হাজার টাকা, ওমান এয়ার ৯৭ হাজার টাকা। একইভাবে অন্য এয়ারলাইন্সে ট্রানজিট দিয়ে ভাড়া গড়ে ৩০ হাজার টাকা বেশি দেখাচ্ছে।

বিষয়ে হাব সভাপতি শাহাদত হোসাইন তসলিম বলেন, মক্কা মদিনার বাড়ি ভাড়ার বিষয়টি তো আমাদের হাতে কিংবা বাংলাদেশের কাছে নয়। তবে শুধু এয়ার টিকিটের দাম কমানো গেলেই হজ ওমরাহের ব্যয় সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকত।

×