.
রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি আন্দোলন করে এক দফা দাবিও আদায় করতে পারেনি। তা ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও যাচ্ছে না। তাই বিএনপি এখন কোন পথে এগোবে সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। মহাসচিবসহ দলের অনেক নেতা কারাগারে, গ্রেপ্তার আতঙ্কে আত্মগোপনে আছেন কেউ কেউ। ধারাবাহিক অবরোধ কর্মসূচির ডাক দিলেও তা পালন করতে মাঠে নামছেন না নেতাকর্মীরা। এ অবস্থায় সামনে কী করণীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না দলের নেতারা। নির্বাচন কমিশন (ইসি) ঘোষিত তফসিল অনুসারে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিল শেষ হয়ে গেছে। ইসিতে নিবন্ধিত ৪৪ রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৩২টি দল ও স্বতন্ত্রসহ সারাদেশের ৩০০ আসনে দুই হাজার ৭১৩ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল শেষে এখন নিজ নিজ এলাকায় গণসংযোগে ব্যস্ত। বিএনপিসহ ইসিতে নিবন্ধিত ১২টি দল না গেলেও নির্বাচনের ট্রেন থেমে নেই। তবে বিএনপির প্রায় তিন ডজন কেন্দ্রীয় নেতা দল ছেড়ে বিভিন্ন দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর কেটে গেছে ১৬ দিন। পুনঃতফসিল হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তাই ভোটের আর মাত্র ৩৫ দিন বাকি। দেখতে দেখতে চলে আসবে কাক্সিক্ষত ৭ জানুয়ারি। যেদিন উৎসবমুখর পরিবেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলও এ নির্বাচনের দিকে চোখ রেখেছে।
বিএনপি না গেলেও দল থেকে বেরিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন বেশ ক’জন কেন্দ্রীয় নেতা। যারা আগে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কথা বলতেন এবং রাজপথে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তারা এখন আওয়ামী লীগসহ তাদের সমমনা দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করছেন। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে।
এদিকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, সরকারের পদত্যাগ ও খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ এক দফার নামে একগুচ্ছ দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করে সফল হতে পারেনি বিএনপি। উপরন্তু দলের বেশ ক’জন কেন্দ্রীয় নেতা বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দলে চলে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এ ছাড়া একদিকে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কারাবন্দি এবং অপরদিকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে রয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি এখন সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে।
ইসি থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা নিয়ে ঝালকাঠি-১ আসনে প্রার্থী হয়েছেন বিএনপির প্রভাবশালী নেতা সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী ও চারবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর। তিনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন তিনি পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এ ছাড়া বিএনপির আরেক সাবেক প্রভাবশালী ভাইস চেয়ারম্যান সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ কুমিল্লা-৫ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। বিএনপির আরেক সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও এক সময়ের দলীয় কূটনৈতিক সেলের প্রধান শমসের মবিন চৌধুরী তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়ে দলটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণের পাশাপাশি তিনি সিলেট-৬ আসনে নির্বাচনে সোনালি আঁশ প্রতীকে নির্বাচন করছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা তৈমূর আলম খন্দকার সম্প্রতি তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়ে দলটির মহাসচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এবার তিনি তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন নারায়ণগঞ্জ-১ আসন থেকে। বিএনপি চেয়ারপারসনের আরেক উপদেষ্টা সৈয়দ একে একরামুজ্জামান স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন বি.বাড়িয়া-১ আসন থেকে।
বিএনপি থেকে বেরিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল বিএনএম-এ যোগ দিয়ে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন শাহ মোহাম্মদ আবুজাফর। তিনি ফরিদপুর-১ আসনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। এ আসন থেকে ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগের, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির এবং ২০০৫ সালের উপ-নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আবু জাফর। আরেক প্রভাবশালী নেতা ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য বিএনপি নেতা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান (কিশোরগঞ্জ-২) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। দলে বড় কোনো পদ না থাকলেও বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বগুড়ার রাজনীতিতে পরিচিত মুখ সাবেক চারবারের সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মোল্লা বগুড়া-৪ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য খন্দকার আহসান হাবিব (টাঙ্গাইল-৫), দেলয়ার হোসেন খান দুুলু ময়মনসিংহ-৪ আসনে, দেলদুয়ার উপজেলা বিএনপির সদস্য খন্দকার ওয়াহিদ মুরাদ (টাঙ্গাইল-৬), সরকার বাদল বগুড়া-৭ আসনে, ডা. আসমা শহীদ ফরিদপুর-২ আসনে, সিদ্দিকুল আলম সিদ্দিক নীলফামারী-৪, মাওলানা মতিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনে, বিউটি বেগম বগুড়া-২ আসনে, ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম ঝালকাঠি-২ আসনে, শাহ শহীদ সারোয়ার ময়মনসিংহ-২ আসনে এবং মো. শুকরানা বগুড়া-১ আসনে নির্বাচন করছেন। আর তৃণমূল বিএনপি থেকে গাজীপুর-১ আসনে জব্বার সরকার, ঠাকুরগাঁও-২ আসনে মোজাফ্ফর আহমেদ এবং চাঁদপুর-৪ আসনে আব্দুল কাদের তালুকদার সোনালি আঁশ প্রতীকে নির্বাচন করছেন।
এ ছাড়াও গাজীপুর মহানগর বিএনপি নেতা ও বাসন থানা বিএনপির সহসভাপতি জব্বার সরকার, সাবেক ছাত্রনেতা ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি মোজাফফর আহমেদ ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সহসভাপতি আব্দুল কাদির তালুকদার তৃণমূল বিএনপি থেকে প্রার্থী হয়েছেন। এর বাইরেও বিএনপির আরও বেশ ক’জন নেতা জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে তাদের সবাইকে আগে-পরে বহিষ্কার করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্যমতে, নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে ৩২টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। আর নির্বাচনে অংশ নেয়নি ১২টি রাজনৈতিক দল। এবারের নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছে দুই হাজার ৭১৩ জন। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থী এক হাজার ৯৬৬ জন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী ৭৪৭ জন। শুধু আওয়ামী লীগ থেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন ৪৪২ জন। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় ৩৯টি দল। ওই নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিল করে তিন হাজার ৬৫ জন।
ইসির তথ্য অনুযায়ী আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে যে ৩২টি দল মনোনয়নপত্র দাখিল করছে সেগুলো হচ্ছে- আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাকের পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বিকল্প ধারা, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), বাংলাদেশ কংগ্রেস, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ (মশাল), বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফোরাম (বিএনএফ), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম), বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন (বিটিএফ), ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামিক ফ্রন্ট, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফ্রন্ট, জাতীয় পার্টি (জেপি), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (কাঁঠাল), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, গণতন্ত্রী পার্টি, গণফোরাম, সাম্যবাদী দল, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (পাঞ্জা), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (হারিকেন), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিস এবং বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল।
আর নির্বাচনে অংশ নেয়নি যে ১২টি দল সেগুলো হচ্ছে, বিএনপি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি, ইসলামী আন্দোলন, সিপিবি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, খেলাফত মজলিস (একাংশ), জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ইনসানীয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (মোটরগাড়ি), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ)।
এদিকে সম্প্রতি ৩৯টি রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করে যুগপৎ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। এর মধ্যে অধিকাংশ দলই নামসর্বস্ব দল। তাই এসব দল নিয়ে বিএনপি আন্দোলন কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে আন্দোলনে কতটুকু এগিয়ে যেতে পারবে তা নিয়ে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে।