ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

​​​​​​​নাগরিক দুর্ভোগ

রক্ষণাবেক্ষণের নামে বন্ধ থাকছে গ্যাস সরবরাহ

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:৪১, ২৪ মার্চ ২০২৩

রক্ষণাবেক্ষণের নামে বন্ধ থাকছে গ্যাস সরবরাহ

.

শীতকাল চলে গেলেও এখনো মাঝে মাঝেই চুলায় গ্যাসের সরবরাহ পাচ্ছেন না রাজধানীর একটি বড় অংশের মানুষ।পাইপলাইনের জরুরি রক্ষণাবেক্ষণের নামে মাসে অন্তত তিন থেকে চারবার রাজধানীসহ নারায়ণগঞ্জ-আড়াইহাজারের আশপাশের এলাকায় বন্ধ রাখা হয় গ্যাসের সরবরাহ। এতে করে গ্যাস সংকটে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় এসব এলাকার বাসিন্দাদের। বিতরণ সংস্থা তিতাস বলছে, রমজান মাসেও যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে রকম জরুরি শাটডাউন করতেই হবে। এতে করে রমজান মাসেও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। এর ওপর আবার পেট্রোবাংলা এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেই দিয়েছে, রমজানে বিদ্যুৎ এবং শিল্পকে অগ্রাধিকার দিয়ে আবাসিক শ্রেণিতে গ্যাস সরবরাহ সীমিত রাখা হবে। এতে করে আবাসিক খাতের গ্রাহকদের দুর্ভোগ বাড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে জরুরি প্রয়োজনে শাটডাউন করলেও যেন ইফতার এবং সেহরি বানানোর সময়টায় সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা হয়, এমন দাবি জানিয়েছেন সাধারণ গ্রাহকরা।

গত বুধবার পেট্রোবাংলার রমজান, সেচ মৌসুম গ্রীষ্মকালে গ্যাস উৎপাদন, আরএলএনজি সরবরাহ এবং গ্রাহক শ্রেণিভিত্তিক গ্যাস বরাদ্দ/ব্যবহারবিষয়ক এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশীয় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা এবং দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে বিদ্যুৎ চাহিদার পিক মৌসুমে সার শ্রেণিতে গ্যাস সরবরাহ সীমিত রাখা হবে। একইভাবে বিদ্যুৎ চাহিদার পিক সময়ে সিএনজি স্টেশন, আবাসিক শ্রেণিতেও গ্যাস সরবরাহ সীমিত রাখা হবে। এর বিপরীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং শিল্পগুলোতে গ্যাস সরবরাহে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

এই বিজ্ঞপ্তির মধ্যে এটা স্পষ্ট যে, রমজানে আবাসিকের গ্রাহকদের গ্যাসের সরবরাহ নিয়ে দুর্ভোগ পোহাতেই হবে। কিন্তু এর বাইরেও পাইপলাইনের জরুরি রক্ষণাবেক্ষণ টাই-ইনের নামে চলতি মার্চ মাসেই অন্তত তিনবার রাজধানীর নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকায় টানা আট থেকে নয় ঘণ্টা গ্যাসের সরবরাহ সীমিত করে রাখা হয়। গত মার্চ রাজধানীর মিন্টো রোড, ইস্কাটন, পরীবাগ, হাবিবুল্লাহ সড়ক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, বারডেম, ঢাকা ক্লাব, হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল এলাকা, কাওরানবাজার, পুরাতন এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ বুয়েট এলাকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আট ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখে তিতাস। এর ১৪ দিন পর গত ১৬ মার্চ আবারও এসব এলাকায় আট ঘণ্টার জন্য বন্ধ রাখা হয় গ্যাসের সরবরাহ। এদিন সকাল ১০টা থেকে প্রায় সারাদিন মিন্টো রোড, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল এলাকা, বারডেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা গ্যাস পানৎনি। ফলে বাসিন্দাদের পোহাতে হয় দুর্ভোগ।

একইভাগে গত ২১ মার্চও তিতাস থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ২২ মার্চ জরুরি পাইপলাইনের কাজের কথা বলে রাজধানীসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। যদিও পরে তা বাস্তবায়ন করা হয় নি দাবি করে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশিদ মোল্লাহ্ জনকণ্ঠকে বলেন, জরুরি প্রয়োজনে তো সরবরাহ বন্ধ রাখতেই হবে। পাইপলাইনের ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা না হলে পরে কোনো একটা ত্রুটি হলে তার দায়ভার কে নেবে? প্রয়োজনে অবশ্যই শাটডাউন করা হবে। যদি রমজানেও প্রয়োজন হয়, তাহলে রমজানেও জরুরি শাটডাউন করা হবে। এই শাটডাউন কি তাহলে পিক সময় ছাড়া করা যায় না? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, না করা যায় না। গ্যাসের পাইপলাইনের কাজ খুবই সূক্ষ্ম আর জটিল। এর জন্য যে কারগরি সহযোগিতার প্রয়োজন তা রাতের বেলা কোথায় পাওয়া যাবে? আর রান্না-বান্নার জন্য তো নির্দিষ্ট কোনো পিক সময় নেই। কেউ যদি দিনে রান্না করে তো কেউ বা আবার রাতে রান্না করে। এর কী কোনো পিক সময় আছে?

তার এই প্রশ্নের উত্তর মিলল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকার বাসিন্দা সালমা আক্তারের বক্তব্যে। শীতের শুরু থেকেই দিনের বেলা চুলায় গ্যাসের চাপ কম থাকে অভিযোগ করে কর্মজীবী এই নারী বলেন, সকালে অফিসে যাওয়ার ঠিক আগের সময়টাতে চুলায় গ্যাসের চাপ থাকে না। এতে করে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই নাস্তা না করেই অফিসের উদ্দেশে চলে যেতে হয়। কিন্তু কষ্ট হয় বাচ্চাদের। শুকনা খাবার আর তাদের কত খাওয়ানো যায়? সরকারের এত এত উন্নয়ন কিন্তু গ্যাসের চাপ তো আর বাড়ে না!

শুধু আবাসিক নয়, পেট্রোল পাম্পসহ শিল্প-কারখানাগুলোতেও মিলছে না কাক্সিক্ষত গ্যাসের চাপ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে মহামারি করোনার প্রকোপ কমতেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এতে ধেয়ে আসে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট। সংকটে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে জ্বালানি খাদ্য খাতে। সারাবিশ্বে হু হু করে বাড়তে থাকে খাদ্যপণ্য জ্বালানি তেলের দাম। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ঊর্ধ্বমূল্যে স্পট মার্কেট থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনা বন্ধ থাকার কারণে এতদিন চাহিদার তুলনায় পাওয়া যায়নি প্রয়োজনীয় গ্যাস। সম্প্রতি এলএনজি পুনরায় কেনা শুরু হলেও গ্যাসের চাপের উন্নতি নেই বলেই অভিযোগ করছেন আবাসিক খাতসহ পেট্রোল পাম্প, শিল্প-কারখানাগুলোর সংশ্লিষ্ট সবাই।

সরেজমিনে রাজধানীর কয়েকটি সিএনজি ফিলিং স্টেশন ঘুরে দেখা যায়, সিএনজি চালিত অটোরিক্সা, প্রাইভেটকারগুলোর গ্যাস নিতে দীর্ঘ লাইন। রাজধানীর মগবাজারে আনুদীপ ফিলিং স্টেশনে গ্যাস নিতে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করে থাকা ব্যবসায়ী জাফর মিয়া বলেন, হলি ফ্যামিলির সামনে থেকে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করতে করতে শেষ পর্যন্ত ফিলিং স্টেশনের গেটে এসে পৌঁছেছি। কিন্তু এখন শুনতে পাচ্ছি গ্যাসের প্রয়োজনীয় চাপ নেই। কি আর করা। অন্য জায়গায় যেতে হবে। একই অবস্থা রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার প্রায় সব ফিলিং স্টেশনেরও। সিএনজি অটোরিক্সা চালক রহিম উদ্দিন ক্ষোভ নিয়ে বলেন, আগে দিনে একবার গ্যাস নিলে সারাদিন চলে যেত। এখন দিনে দুইবার গ্যাস নিয়েও সিলিন্ডার ভরছে না। ঢাকা শহরে সিএনজি চালিয়ে প্রতিদিন দুইবার লাইনে দাঁড়িয়ে গ্যাস নিলে তো আমাদের চলবে না। এখন তো সারাদিন চলে যায় গ্যাসের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে, গাড়িতে যাত্রী কখন উঠাব। একই অভিযোগ করেন রাজধানীর পরীবাগের মেঘনা পেট্রোলিয়ামের আওতাধীন ফিলিং স্টেশনে গ্যাস নিতে আসা অটোরিক্সা চালক আকবার আলী। তিনি বলেন, সিএনজি অটোরিক্সার সিলিন্ডারগুলো ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকার গ্যাসেই ভরে যায়। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে ১২০-১৫০ টাকার বেশি গ্যাস নেওয়া যাচ্ছে না। এখানকার কর্মীরা আমাদের বলে গ্যাসের চাপ কম। আগে যেখানে একবার গ্যাস নিলে সারাদিন চলে যেত, এখন সেখানে দিনে দুই-তিনবার নিতে হচ্ছে।

একই অবস্থা শিল্প-কারখানাগুলোতেও। গ্যাসের প্রয়োজনীয় চাপ না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। নিজের কারখানায় গ্যাসের প্রেসার প্রায় দিনই জিরো থাকে জানিয়ে বিকেএমইএর সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান জনকণ্ঠকে বলেন, আমার কারখানাটা পুরনো হওয়ায় মেশিনগুলোতে ফার্নেশ অয়েলের ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। জরুরি কাজ করি ফার্নেশ অয়েল কিনে এনে। কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে? ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ গাজীপুরের ৬৪টি কারখানায় গ্যাস সরবরাহ পোশাক উৎপাদন পরিস্থিতি জানতে একটি জরিপ করেছে নিট পোশাকশিল্প-মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ। তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, জরিপে উঠে এসেছে, গত বছরের শেষ থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত কারখানাগুলোতে গ্যাসের চাপ অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। গড়ে এক দশমিক আট পিএসআই করে গ্যাস পেয়েছে তারা। এতে কারখানার উৎপাদন ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে গেছে।

তবে সংকট শীঘ্রই কেটে যাবে বলে আশ্বস্ত করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, সাত মাস বন্ধ থাকার পর গত ফেব্রুয়ারি থেকে আবারও আমরা স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা শুরু করেছি। অর্থনীতিকে পুরোদমে সচল রাখতে শিল্প-কারাখানাগুলোতে জ্বালানি চাহিদা  মেটাতে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্র থেকেও এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত ক্রয়সংক্রান্ত কমিটির অনুমোদন পেয়েছে। দেশটি থেকে এক কার্গো বা ৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ এলএনজি আমদানি করা হবে। এতে করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের যে চাহিদা সেটি তো মিটবেই, আবাসিক এবং শিল্প খাতেও একটা বড় সাপোর্ট পাওয়া যাবে। গ্যাসের সংকট থাকবে না। তবে পাইপলাইনে কোনো ত্রুটি দেখা দিলে তা তো মেরামত করতেই হবে। এতে করে জনগণের সাময়িক কষ্ট স্বীকার না করে কোনো উপায় নেই।

জানা গেছে, দেশে দৈনিক প্রায় ৪০০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে বর্তমানে কম-বেশি ২৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৪০-৪২ কোটি ঘনফুট এলএনজি থেকে রূপান্তরিত গ্যাস। তবে দেশে দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি রূপান্তরের সক্ষমতা রয়েছে।

×