ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাগরিক দুর্ভোগ

বাতাসও এখন যমদূত

ইয়াহইয়া নকিব

প্রকাশিত: ২৩:১০, ২৩ মার্চ ২০২৩

বাতাসও এখন যমদূত

মানুষের নাগরিক জীবনের অন্যতম দুর্ভোগে পরিণত হয়েছে বায়ুদূষণ

মানুষের নাগরিক জীবনের অন্যতম দুর্ভোগে পরিণত হয়েছে বায়ুদূষণ। বেঁচে থাকার জন্য নির্মল বাতাস অপরিহার্য। তবে বায়ুতে দূষণের পরিমাণ বাড়তে থাকায় হোঁচট খাচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। ২০১৮ সাল থেকে প্রতিবছর বিশ্বের অন্যতম দূষিত নগরীর তালিকায় থাকছে ঢাকা। যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ায় দূষণের এ মাত্রা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। ফলে শ্বাসকষ্ট, এলার্জি, চোখের সমস্যাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।

প্রতিবছর মারা যাচ্ছে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। বিষাক্ত বাতাসে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছেন গর্ভবতী নারী, শিশু ও বয়স্করা। আর মানসিক সমস্যা বাড়ায় বিষণœতা এবং অল্পতেই মেজাজ হারাচ্ছে মানুষ। এছাড়াও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে দেশের অর্থনীতি। 
মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে মাগুরা থেকে ঢাকায় এসে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছেন লাবিবা রাইসা কান্তা। ঢাকায় আসার পরই তিনি কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে গেলে চিকিৎসক জানান, ঢাকায় আসার পর বায়ু পরিবর্তনের ফলে এমনটা হয়েছে।

ঢাকার বাতাসে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগবে। শুধু এই শিক্ষার্থী নয়, বেশ কয়েকজন তাদের একই অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন। গ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পর তাদের শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। রাস্তায় বের হলেই ধুলাবালির চিত্র দেখা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু এমনটা কেন হচ্ছে?
বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা-একিউআই মোট ৬টি শ্রেণিতে বায়ুমানকে ভাগ করে থাকে। তালিকায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থান হলো ‘বিপজ্জনক’। কোনো শহরের স্কোর ৩০১-এর বেশি হলে তাকে ‘বিপজ্জনক’ স্থানে রাখা হয়। এর পরের স্থানগুলো যথাক্রমে খুবই অস্বাস্থ্যকর (২০১-৩০০), অস্বাস্থ্যকর (১৫১-২০০), সতর্কতা (১০০-১৫০), সহনীয় (৫১-১০০) এবং ভালো বায়ু (০-৫০)।
গত সাত বছর ধরে ঢাকার বাতাসের মান নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাটমোসফেরিক পল্যুশন স্টাডিজ (ক্যাপস)। সংস্থাটি একিউআই ইনডেক্সের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করছে। যেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সংরক্ষণ এজেন্সির মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
ক্যাপস-এর তথ্যমতে, মার্চের প্রথম ২০ দিনের মধ্যে ঢাকায় একদিনও ভালো, মধ্যম কিংবা সতর্কতা মানের বায়ু ছিল না। ১০ দিন ছিল অস্বাস্থ্যকর এবং বাকি ১০ দিন ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর মানের। এমনকি গত ৮ বছরের মধ্যে ঢাকার মানুষ মার্চ মাসে ভালো বায়ু গ্রহণের সুযোগ পায়নি। আবার গত ৭ বছরের তুলনায় এবার শুধু মার্চে বায়ুদূষণ বেড়েছে ১২ শতাংশ পর্যন্ত।
আর গত ৭ বছরে বা ২৩৪৪ দিনে ঢাকায় ভালো বায়ু ছিল মাত্র ৩৯ দিন। অথচ একই সময়ে দুর্যোগপূর্ণ বায়ু ছিল ৪২ দিন। অস্বাস্থ্যকর ছিল ৫৬৪ দিন এবং খুবই অস্বাস্থ্যকর ছিল ৪৬২ দিন।
এ বছরের বায়ুমান ॥ গত জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার বাতাসের মান ১৩ দিন ছিল বিপজ্জনক স্তরে। যেটি গত সাত বছরে সর্বোচ্চ। এই ১৩ দিনের মধ্যে ১০ দিন ছিল জানুয়ারি মাসে, বাকি ৩ দিন ছিল ফেব্রুয়ারিতে। ১৩ জানুয়ারিতে রেকর্ড ৪০৪ স্কোর ছিল ঢাকায়। 
এর আগে বাতাসের মান বিপজ্জনক স্তরে ২০২২ সালে ছিল পাঁচ দিন, ২০২১ সালে ১২ দিন, ২০২০ সালে সাত দিন, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ছয় দিন এবং ২০১৭ সালে ছিল পাঁচ দিন। অন্যদিকে, ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ অবস্থায় ছিল ২০১৭ সালে ৬৪ দিন, ২০১৮ সালে ৭৯ দিন, ২০১৯ সালে ৬০ দিন, ২০২০ সালে ৬৯ দিন, ২০২১ সালে ৮৭ দিন এবং ২০২২ সালে ৭৭ দিন। ২০২৩ সালে কেবল জানুয়ারি মাসেই ২০ দিন ছিল ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’। ক্যাপস বলছে, ঢাকার বায়ুদূষণ বছরের প্রথম মাসেই গত বছরের তুলনায় ২৭ শতাংশ বেড়েছে। আর ফেব্রুয়ারিতে গত বছরের তুলনায় দূষণ বেড়েছিল পাঁচ শতাংশ। 
সবচেয়ে দূষিত মাস ॥ গত সাত বছরের বায়ুমান পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, জানুয়ারি মাসে সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশ দূষণ হয়। এরপরে ফেব্রুয়ারি মাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দূষণ ঘটে। আর পরের অবস্থানে রয়েছে ডিসেম্বর এবং মার্চ মাস। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পাঁচ মাসে ৫৭ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। আর বাকি সাত মাসে দূষণের মাত্রা দাঁড়ায় ৪৩ শতাংশ। বেসরকারি সংস্থা ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ কনসোর্টিয়ামের তথ্যমতে, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে শীতকালে ঢাকার বাতাস ১৬ গুণ বেশি দূষিত থাকে। 
দূষণের উৎস ॥ বিশ্বব্যাংক বলছে, দূষণের প্রধান উৎস হচ্ছে অবকাঠামো নির্মাণ কাজের ধুলোবালি। আর দ্বিতীয় অবস্থানে আছে যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ইটভাঁটি থেকে নির্গত ধোঁয়া। এ বিষয়ে ড. আহমদ কামরুজ্জামান বলেন, রাস্তার ধুলাবালি মূলত ভোগান্তি তৈরি করছে। আর ইটভাঁটির দূষণ পরোক্ষভাবে ক্ষতি করে থাকে। নির্মাণ কাজ আর যানজট বাড়তে থাকায় দূষণ বাড়ছে বলে মনে করছেন তিনি। বেশি সালফারযুক্ত ডিজেলের ব্যবহার বৃদ্ধিও আরেকটি কারণ হতে পারে বলেছেন এ গবেষক।

দূষণের ক্ষতি ॥ সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে দেশের বায়ুদূষণ ও স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে ‘ব্রিদিং হেভি’-প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছিল, দেশে উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণের কারণে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। একই সঙ্গে মোট দেশজ উৎপাদন-জিডিপির ক্ষতি হচ্ছে ৩ দশমিক ৯ থেকে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। বায়ুদূষণে উল্লেযোগ্যভাবে বাড়ছে শ্বাসকষ্ট, কাশি, নি¤œ শ্বাসনালীর সংক্রমণ এবং বিষণœতার ঝুঁকি। ২০১৯ সালে ঢাকায় দূষণের মাত্রা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার আদর্শ মানের চেয়ে ১৫০ শতাংশ বেশি খারাপ ছিল।
স্বাস্থ্যগত প্রভাব ॥ বিশ্বব্যাংক বলছে, বায়ুদূষণের ফলে শিশু ও বয়স্ক মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রায় ১৩ শতাংশ শ্বাস-প্রশ্বাস সমস্যা বৃদ্ধিসহ ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য রোগের সৃষ্টি করছে। ১৬ শতাংশ এলার্জি ও নয় শতাংশ চোখের সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে। মানমাত্রার চেয়ে এক শতাংশ বেশি দূষণ হলেও ২০ শতাংশের বেশি মানসিক সমস্যা বা হতাশার সৃষ্টি হয়।
এ বিষয়ে ডা. ফজলে রাব্বি বলেন, বাতাসে সিসা ও ক্যাডমিয়ামের মতো ভারি ধাতুর প্রভাবে গর্ভবতী নারীরা ক্ষতির মধ্যে পড়ছেন। হাঁপানি-শ্বাসকষ্ট বাড়ছে অনেকের। তাই তিনি দূষিত এ শহরে নিয়মিত মাস্ক পরিধানের অভ্যাস করার পরামর্শ দেন। 
দূষণরোধে করণীয় ॥ বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করা সংস্থা-ক্যাপস-এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, রাস্তার ধুলো মানুষের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। তাই সময় মতো রাস্তা সংস্কারের কাজ শেষ করতে হবে। নির্মাণ কাজের নিয়ম মেনে কাজ করতে হবে। আর এসব কাজের সমন্বয়ের মুখ্য দায়িত্ব নিতে হবে সিটি করপোরেশনকে। শুধু পানি ছিটিয়ে দূষণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না বলেও মনে করছেন তিনি। এটাকে প্রাথমিক পর্যায়ের নিয়মিত কাজ বলছেন তিনি। 
সরকারের পদক্ষেপ ॥ বায়ুদূষণ রোধে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে কথা বলেন পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপক মু. জিয়াউল হক। তিনি বলেন, গতবছর সরকার বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে আলাদাভাবে নীতিমালা করেছে। এটা বস্তবায়নের কাজ চলছে। এখানে বিভিন্ন সংস্থা জড়িত আছে। আর পরিবেশ অধিদপ্তর নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। যারা নিয়ম মেনে নির্মাণ সামগ্রী ঢেকে রাখছেন না-তাদেরকে জরিমানা করা হচ্ছে। যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং ইটভাঁটির বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। আর সিটি করপোরেশনকে পানি ছিটানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। 
এসব পদক্ষেপে দূষণ কিছুটা কমছে বলে মনে করছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের এ পরিচালক। আর বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে একটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। যার মাধ্যমে দূষণরোধে আরও কাজ করা হবে। 
উল্লেখ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, পৃথিবীব্যাপী প্রতিবছর ৭০ লাখ মানুষ বায়ুদূষণের ফলে স্ট্রোক, হৃদরোগ, ফুসফুস ক্যান্সার, ক্রোনিক পালমোনারি ডিজিজ এবং রেসপিরেটরি ইনফেকশনে মারা যায়।

×