![দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2023January/73-2303181750.jpg)
.
রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। নিত্যপণ্যের দাম যাতে আর না বাড়ে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে সরকার। প্রশাসনের কঠোর নজরদারির মধ্যে রয়েছে নিত্যপণ্যের বাজার। রমজানকে ঘিরে অতিরিক্ত মুনাফাখোর অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বন্ধে বাজারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হবে। অন্যদিকে রমজানের শুরুতেই ভোক্তাদের অতিরিক্ত পণ্য না কেনার বিষয়টির ওপর গুরুত্বারোপ করে জোরেশোরে প্রচার চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রমজানের সময় স্থানীয় পর্যায়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং পণ্যের ন্যায্য দামের বিষয়টি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করবেন জেলা প্রশাসকগণ। এর পাশাপাশি সরকারের আরও দুই সংস্থা নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর এবং জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বাজার মনিটরিং করা হবে। এ লক্ষ্যে আজ রবিবার দেশের আট বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করতে যাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া একই দিনে দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের আরেকটি বৈঠক করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে এ মুহূর্তে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। মূলত ওই নির্দেশনার পর সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়, দপ্তর এবং অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় ঘটাতে কৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্যমতে, এ বছর নিত্যপণ্যের আমদানি কিছুটা কম হলেও রমজানে সংকট হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। বরং আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও দেশে আটা, চিনি, ডাল, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ এবং আদা-রসুনের মতো পণ্যের বেশি দাম নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে চিনি ও ডাল দ্বিগুণ দামে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়গুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। আগামী বুধবার কিংবা বৃহস্পতিবার (চাঁদ দেখার পর) থেকে রোজা শুরু হতে যাচ্ছে। এ কারণে ইতোমধ্যে বাজারগুলোতে নিত্যপণ্যের কেনাকাটা করতে ভিড় করছেন সাধারণ মানুষ। কিনে আনছেন প্রয়োজনীয় চাল, ডাল, আটা, ভোজ্যতেল, চিনি, পেঁয়াজ, খেজুর, মুড়ি, বেসনসহ নানা ধরনের ভোগ্যপণ্য। এ ছাড়া রোজার ভিড় এড়াতে কয়েকদিন আগে বাজার থেকে মাছ-মাংস কিনে আনছেন ভোক্তারা। এ কারণে দেশের প্রতিটি ভোগ্যপণ্যের বাজার এখন সরগরম ও সাধ্যমতো ভোক্তাদের কেনাকাটায়।
জানা গেছে, রমজানের শুরু থেকে ঢাকাসহ সারাদেশে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে থাকবে সরকার। এজন্য বিভাগীয় কমিশনারদের এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দেওয়া হবে। আট বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে দেশের ৬৪টি জেলা, সকল উপজেলা ও পৌরসভার বাজার দরের বিষয়টি মনিটরিং করা হবে। জেলা পর্যায় থেকে জেলা প্রশাসকগণ এ ব্যাপারে প্রতিদিন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে রিপোর্টিং করবেন। এ ছাড়া উপজেলা ও পৌরসভা পর্যায়ে বাজার মনিটরিংয়ে জেলা প্রশাসকগণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা প্রদান করবেন। কোনো ব্যবসায়ী পণ্যের অতিরিক্ত মজুত কিংবা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানোর কারসাজি করছে কি না সে বিষয়টির দিকে নজর রাখবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ ছাড়া সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা, ডিজিএফআই ও এনএসআইসহ সংশ্লিষ্ট অন্য সংস্থাগুলোও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ জনকণ্ঠকে বলেন, রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এ কারণে আজ রবিবার গুরুত্বপূর্ণ দুটি পৃথক বৈঠক করা হবে। আমদানি ও পণ্যের উৎপাদনের চিত্র বলছে, রমজানে সংকট হওয়ার কথা নয়। তবে ব্যবসায়ীরা যাতে বিভিন্ন অজুহাতে কারসাজি করে পণ্যমূল্য বাড়াতে না পারে সে বিষয়ে কঠোর মনিটরিং করা হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন সার্বক্ষণিক মাঠে থাকবে। এ ছাড়া খাদ্যে ভেজাল রোধে কাজ করবে নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর এবং বাজার মনিটরিং করবে জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তর। তিনি বলেন, ঢাকায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি টিম নিয়মিত বাজার তদারকি করছে। তিনি বলেন, এর পাশাপাশি টিসিবি সারাদেশে কোটি পরিবারের হাতে ভর্তুকি মূল্যে খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে। এ থেকে উপকৃত হচ্ছে প্রায় ৫ কোটি মানুষ। পুরো রমজান মাস জুড়ে টিসিবির এই কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হবে।
আন্তর্জাতিক মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ দামে চিনি ও ডাল বিক্রি হচ্ছে ॥ আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ দামে দেশে চিনি ও মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে বলে মনে করে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। সম্প্রতি সংস্থাটি থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-প্রতি কেজি পরিশোধিত চিনির আন্তর্জাতিক বাজার দর প্রায় ৫৯ টাকা, কিন্তু দেশে প্রতি কেজি চিনি মানভেদে ১২০-১৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে খুচরা পর্যায়ে। বর্তমানে লাল চিনির প্যাকেট ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চিনির আমদানি ও এলসি খোলা নিষ্পত্তি সংক্রান্ত তথ্যে দেখা যায়-চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চিনি আমদানিতে এলসি খোলার পরিমাণ ১২ লাখ ৭০ হাজার টন এবং বিপরীতে এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ৯ লাখ ২৭ হাজার ৩৮৪ টনের। যদিও গত অর্থবছরের একই সময়ে দেশে ১৬ লাখ ৯৫ হাজার ৮৫৪ টন চিনি আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছিল। সেই সময় ১৪ লাখ ৪ হাজার ৪৮২ টন চিনির এলসি নিষ্পত্তি হয়েছিল বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র। একইভাবে ট্যারিফ অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের আরেক তথ্যে দেখা যায়, প্রতি কেজি মসুর ডালের আন্তর্জাতিক বাজার দর প্রায় ৫৩ টাকা। যা বর্তমান স্থানীয় বাজারে মসুর ডাল বড় দানা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০-১১০ টাকায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ২ লাখ ৭৮ হাজার ৫৮ টন মসুর ডালের এলসি খোলা হয়েছে। এরমধ্যে ২ লাখ ২৫ হাজার ৭১০ টন ডাল আমদানির এলসি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে ১ লাখ ৭৩ হাজার ১৮২ টন এলসি খোলা হয়েছিল এবং নিষ্পত্তি হয়েছিল ১ লাখ ৯৮ হাজার ৩১৩ টন ডালের।
অর্থাৎ গত বছরের চেয়ে এবার মসুর ডালের আমদানি বেশি হয়েছে। একইভাবে আটা, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ ও আদা-রসুনের দাম তুলনামূলক অনেক বেশি নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। সরকারের এই সংস্থাটি থেকে বলা হয়েছে- দাম নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা অব্যাহত রাখাসহ প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক বাজার দর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশেও ভোগ্যপণ্যের দাম নির্ধারণের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. খলীকুজ্জমান আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমদানিকৃত পণ্য নিয়েই ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি কারসাজি করে থাকে। রোজা সামনে রেখে এখন ডলার সংকট ও এলসি জটিলতার কথা বলে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে। অথচ বেশ কয়েকমাস আগে থেকে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ দেখা গেছে। সেই সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এলসি (ঋণপত্র) খোলা নিষ্পত্তির বিষয়গুলোতে জোর দিয়েছে। তিনি বলেন, রমজানে যাতে জিনিসপত্রের দাম নাগালের মধ্যে থাকে সেই প্রস্তুতিতে বেশি জোর দেওয়া প্রয়োজন। এটাই এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বাজারে বেশি দামে চিনি বিক্রি হচ্ছে। রোজা সামনে রেখে সংকট আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শুল্কমুক্ত সুবিধায় দ্রুত পরিশোধিত ও অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির তাগিদ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
দ্রব্যমূল্য নিয়ে আট বিভাগীয় কমিশনার ও টাস্কফোর্সের সভা ॥ দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে আট বিভাগীয় কমিশনার ঢাকা, চট্টগ্রাম খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে আজ রবিবার সকালে বৈঠক করা হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বাণিজ্য সচিবের সভাপতিত্বে ওই বৈঠকে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর, অধিদপ্তর এবং বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন। এ ছাড়া এরপরই দ্রব্যমূল্য সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সভা আহ্বান করা হয়েছে। ওই সভায় সভাপতিত্ব করবেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। মূলত রমজান সামনে রেখে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দুটি বৈঠকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে বাজার দর নিয়ন্ত্রণে রাখতে মাঠপ্রশাসনকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। বিভাগীয় কমিশনাররা জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) দিয়েছেন বিশেষ নির্দেশনা। আর সে অনুযায়ী জেলা ও উপজেলায় বাজার মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। রমজান সামনে রেখে নিত্যপণ্যের দাম যেন না বাড়ে এজন্য মাঠ প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ সচিব সারা দেশের জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে বাজার মনিটরিং নিয়ে বৈঠক করেছেন। একটি বৈঠকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বাজার নিয়ে কেউ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান সম্প্রতি দ্রব্যমূল্য সংক্রান্ত এক বৈঠকে জানান, পুরো রমজান মাসজুড়ে সারাদেশে ভোক্তা অধিকারের টিম মাঠে থাকবে। কারসাজি করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর সুযোগ থাকবে না।