
ফাতেমা নাসরিন
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে যৌতুকের দাবিতে ফাতেমা নাসরিন (৪৫) নামে এক গৃহবধূকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। তিনি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের ভাতিজি। এ ঘটনায় পুলিশ নিহতের স্বামী বিসিএস ক্যাডার মির্জা সাখাওয়াত হোসেনকে (৪৯) গ্রেপ্তার করেছে।
নিহতের বড় বোন আরজিনা বেগম জানান, গত ৮ মার্চ যৌতুকের দাবিতে ফাতেমা নাসরিনকে পিটিয়ে আহত করেন তার স্বামী মির্জা সাখাওয়াত হোসেন। পরে তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে রাজধানীর আগারগাঁও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ১০ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে শুক্রবার রাত ১টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
শনিবার (১৮ মার্চ) বিকেলে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। ফাতেমার মৃত্যুর সংবাদ শুনে মধ্যরাতে হাসপাতালে ছুটে যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম।
এর আগে শনিবার সকালে হাসপাতালে ছুটে আসেন বিচারপতি নজরুল ইসলামের স্ত্রী অ্যাডভোকেট শাহনাজ বাবলী। ন্যায়বিচার দাবি করে তিনি সাংবাদিকদের জানান, ফাতেমা ভাতিজি হলেও আমরা তাকে মেয়ে হিসেবে জানতাম। মেয়েটা অনেক গুণবতী ছিল। ১৯ বছরের সংসারে মায়ার কারণে শত অত্যাচার সহ্য করেও নীরব ছিল। আমাদের কাছে কখনো স্বামীর অত্যাচারের কথা মুখ ফুটে বলত না। নির্মম অত্যাচারে আমার মেয়েটা শেষ পর্যন্ত চলেই গেল। এখন তো ফিরে পাব না। আমরা আমাদের মেয়ে হত্যার ন্যায়বিচার চাই। এটাই আমাদের চাওয়া। আর কিছু চাওয়া নেই আমাদের। ফাতেমা হত্যার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে আমরা লড়ে যাব।
এ ব্যাপারে মোহাম্মদপুর থানার ওসি জনকণ্ঠকে জানান, রাজধানীর মোহাম্মদপুর হুমায়ুন রোডের একটি বাসায় একমাত্র মেয়েকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন ফাতেমা নাসরিন ও তার স্বামী মির্জা সাখাওয়াত। প্রায়ই নাসরিনকে যৌতুকের জন্য তার স্বামী মারধর করতেন। গত ৮ মার্চ তাকে আবারও মারধর করেন সাখাওয়াত এবং কাঠের বাটলা দিয়ে মাথায় আঘাত করে। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফাতেমার মৃত্যু হয়।
ওসি জানান, ঘটনার পরদিন ৯ মার্চ নিহতের বড় বোন মোহাম্মদপুর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে একটি মামলা করেন। সেই মামলা হত্যা মামলা হিসেবে পরিণত হবে। ওই মামলায় সাখাওয়াতকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। পরে আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠায়। বর্তমানে সাখাওয়াত হোসেন কারাগারে আছেন। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) তোফাজ্জল হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, শুক্রবার রাত ১টার দিকে নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে ফাতেমা নাসরিন নামে এক নারী চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে স্বামীর নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে। শনিবার দুপুরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পরে তার লাশ ঠাকুরগাঁওয়ে পৈতৃক বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জানাজা শেষে তার লাশ পৈতৃক কবরস্থানে দাফন করা হবে।
মামলার বাদী নিহতের বড় বোন আরজিনা বেগম বলেন, ১৯ বছর আগে ফাতেমা নাসরিন ও মির্জা সাখাওয়াত হোসেনের বিয়ে হয়ে। তাদের সংসারে ১৭ বছরের এইচএসসি পড়ুয়া এক মেয়ে রয়েছে। তিনি জানান, বিয়ের পর থেকে সাখাওয়াত বিভিন্ন সময় ফাতেমার কাছে যৌতুক দাবি করে আসছিল। আমাদের ঠাকুরগাঁওয়ে পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করে এক কোটি টাকা এনে দেওয়ার জন্য নাসরিনকে প্রায়ই চাপ দিত সে। কিন্তু বাড়িটিতে আরও অংশীদার থাকায় বিক্রি করা যাবে না বলে জানালে ক্ষিপ্ত হয়ে ফাতেমাকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন শুরু করে সাখাওয়াত। সন্তান ও সংসারের কথা চিন্তা করে মুখ বুজে সব সহ্য করে আসছিল ফাতেমা।
আরজিনা বেগম জানান, দিন দিন সাখাওয়াতের নির্যাতন বেড়ে যাওয়ায় সহ্য না করতে পেরে গত জানুয়ারিতে পঞ্চগড় সদর থানায় নারী নির্যাতন আইনে একটি মামলা করেন ফাতেমা। ওই মামলায় সাখাওয়াতকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে ঠিকভাবে সংসার করবে মর্মে জামিনে বেরিয়ে যৌতুকের টাকার জন্য ফের ফাতেমাকে চাপ দিতে থাকেন। সর্বশেষ গত ৮ মার্চ যৌতুকের টাকার জন্য সাখাওয়াত তার মোহাম্মদপুরের বাসায় ফাতেমাকে চাপ দিতে থাকেন। এতে প্রতিবাদ করলে সাখাওয়াত ধারালো বঁটি দিয়ে হত্যাচেষ্টা করে এবং মসলা বাটার কাঠের বাটলা দিয়ে ফাতেমার মাথা থেঁতলে দেয়। এ ছাড়া শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম করে। একপর্যায়ে সাখাওয়াত তার স্ত্রীকে দা দিয়ে জবাই করতে উদ্যত হয় তখন তাদের সন্তান এসে বাধা দেয়। পরে ফাতেমাকে দ্রুত উদ্ধার করে আগারগাঁও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে শুক্রবার রাত ১টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।