ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

হুমকির মুখে গার্মেন্টস

আজাদ সুলায়মান

প্রকাশিত: ২৩:০২, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

হুমকির মুখে গার্মেন্টস

কাভার্ডভ্যানের নাটবল্টু খুলে শিপমেন্টের কাপড় চুরি

অভিনব কৌশলে কাভার্ডভ্যানের নাটবল্টু খুলে বিদেশী শিপমেন্ট থেকে কাপড় চুরির ঘটনায় হুমকির মুখে পড়েছে গার্মেন্টস সেক্টর। দেশের সীমানা পেরিয়ে সুদূর ব্রাজিল পর্যন্ত এই চক্রের ছোবল পড়েছে। সম্প্রতি তৌহিদ নামের একজনকে গ্রেপ্তারের পর তার মুখ থেকেই বেরিয়ে আসে রাতের অন্ধকারে মহাসড়কে কাভার্ডভ্যান থেকে চুরি করার নিপুণ কৌশল। কার্টন না খুলে কিছু কাপড় বের করে সেটা আবার ঝুট দিয়ে ভরে রিপ্যাকিং করছে এই চক্রটি।

দেশের কোথাও ধরা না পড়লেও সুদূর ব্রাজিলে ফাঁস হয় দেশীয় চোরদের অপকর্ম। র‌্যাবের অভিযানে তৌহিদ ধরা পড়ার পর একে একে চিহ্নিত হচ্ছে চক্রের বাকি সদস্য। গত অক্টোবরে ধরা পড়ে চক্রের হোতা তৌহিদ নামের একজন। তার পরই র‌্যাবের বিশেষ টিম এখন মাঠে নেমেছে এ চক্রকে গুঁড়িয়ে দিতে। সর্বশেষ শুক্রবারও ধরা পড়েছে চার জন। পাশাপাশি র‌্যাব এখন চোরাই পণ্য বিক্রির স্থানগুলোতেও হানা দিচ্ছে। রাতের অন্ধকারে মহাসড়কে কাভার্ডভ্যান থামিয়ে চুরি করা দামি পোশাক ঢাকার কোথায় কোথায় বিক্রি করা হতো সেগুলোও চিহ্নিত করা হচ্ছে। যে কোনো সময় অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হতে পারে এসব পণ্য। 
র‌্যাব নিশ্চিত হয়েছে- এসব চোরাই পণ্যের ব্যবসার সঙ্গে রাজধানীর  উত্তরার বেশ ক’জন বায়িং হাউসের মালিকও জড়িত। তারা জেনেই কম দামে কিনে বিদেশে পাঠাত আকাশপথে। সজল নামের একজনকে ধরার পর তার কাছে থেকে তালিকা পাওয়া গেছে উত্তরার স্টকলট ব্যবসায়ীদের। সজল নিজেও স্টকলট ব্যবসায়ী। তার মাধ্যমে অন্যান্য বায়িং হাউস এ চক্রে সক্রিয় হয়ে কামিয়েছে কোটি কোটি টাকা।  
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন- সজল একাধারে স্টকলট ব্যবসায়ী আবার চোরেরও হোতা। তার মতো আরও ৪০ জন রয়েছে, যারা তার কাছ থেকে চোরাই পণ্য কিনে আবার বিদেশে পাঠাত। ফলে তাদেরকে সন্দেহ করাটাও কঠিন। একজন বায়িং হাউজের মালিক ঢাকায় বসে বিদেশে পণ্য পাঠালে কারোর তো সন্দেহ হওয়ার নয়। তার পরও তাদের ওপর চলছে নজরদারি। যে কোনো সময় ধরা পড়বে তারাও। 
র‌্যাব জানিয়েছে, কয়েক বছর ধরে কয়েকটি চক্র গার্মেন্টস পণ্য চুরি করে আসছিল। দীর্ঘদিন ধরে এভাবে গার্মেন্টস পণ্য চুরি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও চক্রের সদস্যরা ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। অবশেষে শেষ রক্ষা হয়নি। সম্প্রতি ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হন চক্রটির চার সদস্য। এরপর তাদের থেকে চুরির এসব তথ্য জানতে পারে র‌্যাব।

এ চক্রের হোতা তৌহিদ ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে। র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে সে অপকটে স্বীকার করেছে কিভাবে মহাসড়কে নিপুণ কৌশলে কাভার্ডভ্যান থেকে কার্টন কাটা হতো। সেই কার্টন আবার নিপুণতার সঙ্গে রিপ্যাকিং করে রাখা হতো। কাভার্ডভ্যানের মূল হুড না  খোলার দরুন মালিক পক্ষ টেরও পেত না এর ভেতরের মালামাল চুরি করে ঝুট দিয়ে ভরা হতো। 
এ সম্পর্কে জেরার মুখে তৌহিদ স্বীকার করেছে- ঢাকায় গার্মেন্টস পণ্য চুরির কাহিনী। সেটা গত বছরের অক্টোবরের ঘটনা। ২৯ অক্টোবর কারখানা থেকে কাভার্ডভ্যানে করে পোশাকের একটি চালান ব্রাজিলে রপ্তানির উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠায় গাজীপুরের কোনাবাড়ির একটি তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। পরদিন ৮৯৮ কার্টনভর্তি সোয়েটার চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়।

ক্রেতা-মনোনীত শিপিং প্রতিষ্ঠান ১ লাখ ২৫ হাজার ডলারেরও বেশি মূল্যের চালানটি গ্রহণ করে ব্রাজিলে পাঠায় এবং সেই মোতাবেক বন্দর থেকে চালানবহনকারী জাহাজটি রওনা দেওয়ার পর পরই ক্রেতা পুরো অর্থ পরিশোধ করে। তবে গত ৬ জানুয়ারি ব্রাজিলের ক্রেতার কাছ থেকে পাওয়া ভিডিও দেখে হতবাক হয়ে যান গার্মেন্টস মালিক পক্ষ। সেখানে দেখা যায়, কিছু কার্টন সম্পূর্ণ খালি এবং অনেকগুলো কার্টন থেকে প্রচুর পরিমাণ পণ্য খোয়া গেছে।

পরবর্তীতে চুরি হওয়া গার্মেন্টস পণ্যের সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা হিসেবে পরিশোধ করতে হয় মালিক পক্ষকে। এরই প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষ গত ২ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের গাছা থানায় ওই চুরির ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি করে। 
জানা গেছে- ওই জিডির সূত্র ধরে ছায়া তদন্তে নামে র‌্যাবও। তারপর ধরা পড়ে তৌহিদ। তারপর আরও দুজন ধরা পড়ে। সর্বশেষ শুক্রবার রাতেও ধরা হয় এ চক্রের চারজনকে। তাদের ধরতে মৌলভীবাজার, গোপালগঞ্জ ও ঢাকার আশপাশ এলাকায় পৃথক পৃথক অভিযান চালায় র‌্যাব। এ সময় দেশের গার্মেন্টস পণ্য চুরি কা-ের  হোতা শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা, মো. ইমারত হোসেন সজল, শাহজাহান ওরফে রাসেল ওরফে আরিফ ও মো. হৃদয়কে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ব্রাজিলে রপ্তানিকৃত চুরি যাওয়া পণ্যের পরিবহনে ব্যবহৃত একটি কাভার্ডভ্যান। ওই ঘটনার সঙ্গে গ্রেপ্তারকৃত চার জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়।
এ সম্পর্কে র‌্যাব জানিয়েছে- গ্রেপ্তারকৃত শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা এই গার্মেন্টস পণ্য চুরি জগতের মাস্টারমাইন্ড এবং এই চক্রের হোতা। মূলত তার ছত্রছায়ায় ও সম্মতিতে দেশের প্রায় অধিকাংশ গার্মেন্টস পণ্য চুরির ঘটনা সংঘটিত হয়ে থাকে। ৪০-৫০ জনের এই চক্রে রয়েছে অসাধু ড্রাইভার, হেলপার, গোডাউন মালিক, গোডাউন এলাকার আশ্রয়দাতা, অত্যন্ত দক্ষ কুলি সর্দারসহ একদল লেবার। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা ট্রান্সপোর্টে গার্মেন্টসের মালামাল বহন শুরু করে।

একপর্যায়ে তারা গার্মেন্টস পণ্য পরিবহনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কাভার্ডভ্যানের চালক ও সহকারীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে এবং অল্প সময়ে বেশি অর্থ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে গার্মেন্টস পণ্য চুরির কাজে উৎসাহিত করে। প্রত্যেকটি চুরির পূর্বে গাড়ি চালকদের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানিকৃত গার্মেন্টস পণ্যের স্যাম্পল নিয়ে চোরাইকৃত পণ্যের সম্ভাব্য বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করত। চুরির জন্য নির্ধারিত গার্মেন্টস পণ্যের আনুমানিক মূল্য ১২-১৫ লাখ টাকা হলেই তারা চুরি কার্যক্রম পরিচালিত করত।

তবে এই মূল্যের কম হলে তারা চুরি করত না। এই টাকা থেকে কাভার্ডভ্যানের চালক ৩০ হাজার, সহকারী ২০ হাজার, গোডাউনের মালিক ৫০ হাজার, গোডাউন এলাকার শেলটার পার্টি ৬০ হাজার, কার্টন প্যাকেজিং এক্সপার্ট ১০ হাজার, অন্যান্য লেবার প্রত্যেকে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা দেওয়া হতো। আর বাকি টাকা তাদের গ্রুপের মধ্যে অবস্থান অনুযায়ী বণ্টন করে নিত। 
চালক ও তার সহকারী পণ্যবাহী কাভার্ডভ্যানটি নির্দিষ্ট গোডাউনে নিয়ে গেলে চক্রের অন্য সদস্যরা কার্টন কেটে গার্মেন্টস পণ্যগুলো আলাদা করে রাখত। প্রথমত তারা ১০ পিসের কার্টন থেকে চার পিস এবং ২০ পিসের কার্টন থেকে ৬-৮ পিস গার্মেন্টস পণ্য সরিয়ে রেখে পুনরায় কার্টনগুলো প্যাকেজিং করে দ্রুত কাভার্ডভ্যানে লোড করে বন্দরের উদ্দেশে রওনা দিত। পরবর্তীতে চক্রের অন্য সদস্যরা চোরাই পণ্যগুলো তাদের নিজস্ব পিকআপ বা কাভার্ডভ্যানের করে অন্য একটি গোডাউনে এক থেকে দেড় মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করত। ট্রান্সপোর্টের মালামাল যখন বিভিন্ন দেশে রপ্তানির উদ্দেশ্যে বন্দর থেকে দেশের বাইরে চলে যেত তখন তারা চোরাই পণ্যগুলো রাজধানীর উত্তরাসহ বিভিন্ন অসাধু বায়িং হাউসের কাছে বিক্রি করে দিত।
জানা গেছে- ব্রাজিলে রপ্তানিকৃত পণ্য চুরির ঘটনাও শাহেদের নির্দেশে সংঘটিত হয়। গত বছর ২৯ অক্টোবর গাজীপুর থেকে গার্মেন্টস পণ্য কাভার্ডভ্যানে লোড করে সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করে। কাভার্ডভ্যানে পণ্য লোডের পর গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ চালক শাহজাহানের কাছে নমুনা হিসেবে কিছু সোয়েটার দেয়। চালক শাহজাহান নমুনা পাওয়ার পর ছবি তুলে মোবাইলের মাধ্যমে হোতা শাহেদের কাছে পাঠায়। শাহেদ নমুনা পেয়ে চুরির ঘটনা বাস্তবায়নকারী আসামি তাওহীদুল ওরফে কাওছার ওরফে বড় কাওছারের কাছে পাঠায়।

পণ্যের গুণগত মান ও বাজারমূল্য বিবেচনা করে এই চালানটিতে চুরির নির্দেশ দেয়। মাস্টারমাইন্ডের নির্দেশ মোতাবেক কাওছার চালকের সঙ্গে যোগাযোগ করে চুরির মূল  প্লট বাস্তবায়ন করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাওছারের নির্দেশে চালক ও তার সহকারী ২৯ অক্টোবর মধ্যরাতে ডেমরা থানাধীন মিরপাড়ার আয়েশা প্যাকেজিং ভবনের গোডাউনে কাভার্ডভ্যানটি দাঁড় করিয়ে চুরির ঘটনাটি ঘটায়। আগে থেকে আয়েশা প্যাকেজিং ভবনের গোডাউনে কুলি সর্দার নাজিম, স্থানীয়ভাবে শেল্টারদাতা মাসুম ওরফে মাসুদসহ অজ্ঞাতনামা ৫ থেকে ৭ জন শ্রমিককে নিয়ে  হোতা কাওছার অপেক্ষা করে।

এরপর প্রত্যেকটি কার্টন থেকে ৩০-৩৫ শতাংশ পণ্য সরিয়ে পুনরায় প্যাকেজিং করে কাভার্ডভ্যানটি বন্দরের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেয়। ওই ঘটনায় কার্টন প্যাকেজিংয়ে  অত্যন্ত দক্ষ কুলি সর্দার নাজিম অন্য লেবারদের নিয়ে কাভার্ডভ্যান থেকে কার্টন আনলোড থেকে শুরু করে কার্টন থেকে পণ্য সরিয়ে পুনরায় প্যাকেজিং এবং কাভার্ডভ্যানে কার্টন লোডের কাজটি করেছে।
র‌্যাব জানিয়েছে- গ্রেপ্তারকৃত শাহেদ চট্টগ্রামে থাকাকালে ১৯৯৬ সালে দুটি ট্রাক ক্রয় করে লোকাল ব্যবসা শুরু করে। ২০০৪ সালে ট্রাক দুটি বিক্রি করে চারটি কাভার্ডভ্যান কিনে গার্মেন্টস পণ্য পরিবহন শুরু করে। সে কাভার্ডভ্যানের চালক ও সহকারীদের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের সহায়তায় গার্মেন্টস পণ্য চুরির কার্যক্রমের জন্য একটি সংঘবদ্ধ চোর চক্র তৈরি করে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত সে নিজেই সশরীরে উপস্থিত থেকে চুরির কার্যক্রম চালিয়ে যায়। ২০১৮ সাল পরবর্তী সময়ে সে পর্দার আড়ালে থেকে চুরির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ শুরু করে এবং প্রত্যেকটি চুরির ঘটনায় আয়কৃত অর্থের সর্বোচ্চ অংশ পেত সে।
মৌলভীবাজার শহরে শাহেদের প্রায় ১৫-২০ কোটি টাকা মূল্যের একটি বাড়ি রয়েছে। মৌলভীবাজারের দুর্লভপুর প্রায় ২০ একর জমির ওপরে মাছের খামারসহ বিশাল দুটি হাঁস-মুরগির খামারও রয়েছে। বর্তমানে তার নিজস্ব চারটি কাভার্ডভ্যানসহ তার সহযোগীর আরও ১৫টি কাভার্ডভ্যান রয়েছে বলে জানায়। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১৭-১৮টি গার্মেন্টস পণ্য চুরির মামলা রয়েছে এবং যার অধিকাংশ মামলায় সে কারাভোগ করেছে বলে জানা যায়। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে আদালতে ছয়টি মামলার বিচারকার্য চলমান রয়েছে।
অপর আসামি ইমারত হোসেন সজল গত ২০১২ সাল থেকে ঢাকার উত্তরায় গার্মেন্টস পণ্যের স্টকলটের ব্যবসা শুরু করে। ব্যবসার সুবাদে গার্মেন্টস পণ্য চুরি জগতের গডফাদার শাহেদ, কাউছারসহ অন্য সদস্যদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। শাহেদের মাধ্যমে কম দামে চোরাইকৃত গার্মেন্টস পণ্য কিনে স্টক করে সুবিধাজনক সময়ে বেশি দামে স্থানীয় মার্কেটসহ বিভিন্নভাবে বিক্রি করত। গত দুই বছরে সে শাহেদের মাধ্যমে ১৫০ থেকে ২০০টি চুরির ঘটনায় চোরাইকৃত গার্মেন্টস পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করেছে।

তার এই চোরাইকৃত কিছু কিছু গার্মেন্টস পণ্য বিভিন্ন মাধ্যমে হাত বদল হয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয়েছে। সে অবৈধ পথে কোটি টাকার অধিক স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মালিক হয়েছে যার মধ্যে গ্রামে ৩০ লক্ষাধিক টাকার একটি বাড়ি ও বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে ৩০-৩৫ লাখ টাকার বিনিয়োগ রয়েছে।

গ্রেপ্তার শাহজাহান ওরফে রাসেল ওরফে আরিফ প্রথমে কাভার্ডভ্যানের চালকের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করে। পরবর্তীতে সাত বছর পূর্বে এই চোর চক্রের মাস্টারমাইন্ড শাহেদের নিজস্ব কাভার্ডভ্যানের চালক হিসেবে কাজ শুরু করে। সেই সুবাদে চালক শাহজাহান চক্রের অন্যতম সদস্য। সে ব্রাজিলে রপ্তানিকৃত চুরি হওয়া গার্মেন্টস পণ্য বহনকারী কাভার্ডভ্যানের চালক হিসেবে নিয়োজিত ছিল।

বিগত ৬ থেকে ৭ বছরে সে প্রায় শতাধিক চুরির সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে। তার বিরুদ্ধে গার্মেন্টস পণ্য চুরির দুটি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত হৃদয় চক্রের মাস্টারমাইন্ড শাহেদের নিজস্ব কাভার্ডভ্যান চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করত। সে ৬ থেকে ৭ বছর ধরে এই চুরি চক্রের সঙ্গে জড়িত। গার্মেন্টস পণ্য চুরির বহনকারী কাভার্ডভ্যানের চালকের সহকারীর দায়িত্ব পালন করতো সে। বিগত ৬-৭ বছরে প্রায় শতাধিক চুরির সঙ্গে জড়িত হৃদয়। তার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে একটি মামলা রয়েছে।
তৌহিদই গডফাদার ॥ এর আগে ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর ডেমরার মীরপাড়া এলাকার একটি পরিত্যক্ত কারখানায় অভিযান চালিয়ে চক্রের গডফাদার তৌহিদসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। চক্রটি এতই আত্মবিশ্বাসী ছিল যে চুরির আগেই রপ্তানি পণ্য অসাধু পোশাক ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিত। অসাধু পোশাক ব্যবসায়ীরা আবার সেই পণ্য বিদেশে পাঠাতেন। চোরদের কাছ থেকে পোশাক কিনে তা বিক্রি করতে করতে নিজেই হয়ে যান চোর। চক্র গড়ে শুরু করেন রপ্তানিমুখী কারখানার পোশাক চুরি।

সেই পোশাক বিক্রি করে কোটিপতি হয়েছেন, ঢাকায় বাড়ি করেছেন, কিনেছেন দামি গাড়ি। অথচ বছর দশেক আগে ফুটপাতে পাইকারি দরে পোশাক সরবরাহ করতেন। সেই পোশাক তিনি চোরদের কাছ থেকে কম দামে সংগ্রহ করতেন। বছর সাতেক আগে তিনি নামকাওয়াস্তে দুটি কারখানা খোলেন। সেখানে চোরাই পণ্য মজুত করে বিক্রি শুরু করেন। তিনি বলতেন, বিক্রি করা পোশাক তার নিজের কারখানায় তৈরি। তাওহীদুল একপর্যায়ে চুরির কৌশল শিখে নিজেই পণ্য চুরি করতে চক্র গঠন করেন। এই চক্র তিন বছর ধরে রপ্তানির পণ্য চুরি করছিল।

তার সঙ্গে ধৃত অন্য সহযোগীরা হলো- মো. নাজিম, মো. মাসুদ, মো. দুলাল, মিরাজ উদ্দিন, আবদুল আল মাসুদ ও সাইফুল ইসলাম। দুলাল ও নাজিম সহোদর। চক্রটির কাছ থেকে মোহাম্মদপুরের সেলিব্রেটি এক্সপোর্ট গার্মেন্টসের রপ্তানিযোগ্য ছয় কোটি টাকা মূল্যের পণ্য ও একটি কাভার্ডভ্যান উদ্ধার করা হয়। তাওহীদুল ছাড়া অন্যরা নিজেদের গাড়িচালক বলে পরিচয় দেন। সবার বাসা ডেমরা ও এর আশপাশে। এদের সবার বিরুদ্ধে চুরির মামলা রয়েছে। কারও কারও বিরুদ্ধে মামলা একাধিক। তাওহীদুলের বিরুদ্ধে গাজীপুর ও ঢাকায় চারটি পোশাক চুরির মামলা রয়েছে।
র‌্যব জানিয়েছে- চোর দলের সদস্যরা প্রথমে রপ্তানিমুখী পণ্য পরিবহনকারী যানবাহনের চালকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এরপর তাকে টাকার লোভ দেখিয়ে চুরির পরিকল্পনায় জড়ান। চালকের কাজ হলো, চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে পোশাকবাহী কাভার্ডভ্যানটিকে নির্ধারিত কোনো পরিত্যক্ত কারখানা বা বাড়িতে নিয়ে যাওয়া। কারখানা থেকে বন্দরের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার আগে কাভার্ডভ্যানে তালা লাগিয়ে সিলগালা করে দেওয়া হয়।

চোর চক্রের সদস্যরা তালা না ভেঙে কাভার্ডভ্যানের নাটবল্টু খুলে ফেলতেন। এতে কাভার্ডভ্যানের উপরিকাঠামোই খুলে যেত। এরপর মালামাল সরিয়ে নিতেন। এভাবে সিল ও তালা অক্ষতই থাকে। বন্দরে পণ্য নামানোর সময় চুরির বিষয়টি আর ধরা পড়ে না।
পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সূত্র জানায়- চুরির অভিযোগ তাদের কাছে মাঝেমধ্যে আসে। তবে ঠিক কতগুলো চুরির ঘটনা ঘটেছে, তার হিসাব নেই। ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ২০ থেকে ২৫টি ঘটনা ঘটেছে। মহাসড়কে চুরির ঘটনা বেড়ে গেলে ২০২১ সালের জুলাইয়ে শিল্প মালিকদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বৈঠক করেন। তখন চুরি ঠেকাতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এবং মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর কথাও বলা হয়। সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর কাজ শেষ হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন- র‌্যাবের কয়েকটি ইউনিট এ নিয়ে মাঠে সক্রিয় থাকার পর ধরা পড়েছে তারা। চক্রের আরও ৪০ জনকে চিহ্নিত করা গেছে। তারাও ধরা পড়ে যাবে। যাদের ধরা হয়েছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। এসব কাপড় চুরি করে কোথায় বিক্রি করত সেটাও চিহ্নিত করা হয়েছে।

×