ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শান্তি চুক্তির ২৫ বছর: সমস্যা ও উত্তরণের উপায়

মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আসহাব উদদীন

প্রকাশিত: ১২:৩১, ২ ডিসেম্বর ২০২২; আপডেট: ১২:৩৭, ২ ডিসেম্বর ২০২২

শান্তি চুক্তির ২৫ বছর: সমস্যা ও উত্তরণের উপায়

শান্তিচুক্তি

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির ২৫ বছর পূর্ণ হলো আজ। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক চুক্তিটি সই হয়। এই ২৫ বছরে বদলে গেছে পাহাড়ের জনজীবন।  

জানা গেছে, ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এমএন লারমা ও কতিপয় উপজাতীয় নেতা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) গঠন এবং জুম্মল্যান্ড নামে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি তুলে ধরেন। কিন্তু সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা ও জাতীয় সংহতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তৎকালীন সরকার তাদের ওইসব দাবি সঙ্গত কারণেই মেনে নেয়নি। এক পর্যায়ে সংগঠনটি প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি পিসিজেএসএসএর সামরিক শাখা শান্তি বাহিনী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সশস্ত্র কার্যক্রম শুরু করে। 

১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অমরপুর এলাকার কল্যাণপুর নামক স্থানে শান্তি বাহিনীর ক্যাম্পে প্রীতি গ্র“পের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষে পিসিজেএসএস এর সভাপতি এমএন লারমা নিহত হয়। পরবর্তীতে, সন্তু লারমা পিসিজেএসএস এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মূলত ১৯৭৬ সালের মাঝামাঝি থেকে শান্তি বাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত সংঘটিত হতে থাকে। এছাড়া ‘শান্তি বাহিনী’ কর্তৃক হত্যা, অপহরণ, গুম, জাতিগত দাঙ্গা সৃষ্টি এবং পুনর্বাসিত বাঙালিদের উপর নৃশংস হামলার ঘটনার পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। এসব কথা বলেন মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আসহাব উদদীন, এনডিসি, পিএসসি (অব.)।

তিনি বলেন, এই অবস্থা হতে উত্তোরণের জন্য ইন্সারজেন্সী অপারেশন পরিচালনার পাশাপাশি শান্তি বাহিনীর সাথে আলোচনা অব্যাহত থাকে। সর্বশেষ ১৯৯৭ সালের ০২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পাবর্ত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নামে পরিচিত। ১০ ফেব্র“য়ারি ১৯৯৮ তারিখে খাগড়াছড়ি জেলা স্টেডিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে জেএসএস নেতা সন্তু লারমা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্রসমর্পন করেন।

 সর্বমোট চার দফায় শান্তি বাহিনীর সদস্যরা মোট ৮৭৪টি অস্ত্র জমা দেয় এবং শান্তি বাহিনীর ১৯৪৬ জন সদস্য সরকারের নিকট আত্মসমর্পণ করে যাদের মধ্যে ৭১৫ জন সদস্যকে পুলিশ বাহিনীতে চাকুরী প্রদান করা হয়। পার্বত্য চুক্তি ছিল তৎকালীন সরকার এবং জনসংহতি সমিতি উভয় পক্ষেও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠার ফসল। এই চুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। পার্বত্য চুক্তির আলোকে ২৫ সদস্যের আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়েছে যার চেয়ারম্যান (প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন) হিসাবে অধিষ্ঠিত আছেন জেএসএস এর সভাপতি সন্তু লারমা। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়েছে এবং জনাব বীর বাহাদুর উশৈসিং, এমপি উক্ত মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। চুক্তি অনুযায়ী ৩৩টি বিভাগের মধ্যে ৩০টি বিভাগ ইতোমধ্যে জেলা পরিষদের নিকট    হস্তান্তর করা হয়েছে। পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ এবং ১৫টি আংশিক বাস্তবায়ন করা হয়েছে। 

এছাড়া ০৯টি ধারা বাস্তবায়নের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্সের মাধ্যমে ১২,২২৩টি উপজাতি পরিবারের ৬৪,৬১২ জন ভারত প্রত্যাগত উপজাতি শরণার্থীর পুনর্বাসন সম্পন্ন করা হয়েছে। পার্বত্য চুক্তির পর ৮১২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪০৪টি উচ্চ বিদ্যালয়, ২৫টি কলেজ, ১১টি পলিট্যাকনিক ইন্সষ্টিটিউট, ০১টি নার্সিং ইন্সষ্টিটিউট, ০৩টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ¡বিদ্যালয় এবং ০১টি মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়েছে। বান্দরবানের থানচি ও রুমা সেতু এবং খাগড়াছড়ি জেলার রামগড়ে বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী সেতু, সীমান্ত সড়ক নির্মাণসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। পার্বত্য চুক্তির পর ৩,৪৪০ কিঃমিঃ সড়ক, ৩২টি হাসপাতাল ও ২৭টি শিল্প/কলকারখানা স্থাপিত হয়েছে। চুক্তির শর্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এ পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীর একটি ব্রিগেড ও ২৪১টি ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ৬৯টি নয়নাভিরাম পর্যটন কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে।

পার্বত্য সমস্যা
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান ভূমি সমস্যা। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা নিরসনকল্পে পার্বত্য চুক্তির আলোকে ২০০১ সালে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে চেয়ারম্যান করে ৯ সদস্য বিশিষ্ট ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করা হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০০১ জারি করা হয়। কিন্তু এই ভূমি কমিশন উপজাতীয় নেতৃবৃন্দের বিরোধীতার কারণে একটিও ভূমি সমস্যার নিষ্পত্তি করতে পারেনি। অবশেষে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর পক্ষে অনেকটা ছাড় দিয়ে গত ০৮ আগষ্ট ২০১৬ তারিখে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০১৬’ পাশ করা হয়। পাহাড়ী জনগোষ্ঠী ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০১৬ এর ব্যাপাওে অত্যন্ত ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করলেও বাঙালি জনগোষ্ঠী ন্যায় বিচার পাওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট উৎকন্ঠার মধ্যে রয়েছে। সংশোধনীতে ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকার দাবীটি প্রতিষ্ঠিত করার আইনগত ভিত্তি পাওয়ায় এবং ভূমি কমিশনের ০৯ জন সদস্যের মধ্যে ০৭ জন সদস্যই উপজাতি হওয়াতে কমিশনের সকল সিদ্ধান্ত বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যেতে পারে বলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিরা মনে করে। যার প্রতিফলন আবেদনের মাধ্যমে পরিলক্ষিত হয়। উপজাতীয়রা সর্বমোট ২২,৯৭০টি আবেদনপত্র জমা দিলেও পক্ষান্তরে বাঙালিরা মাত্র ৫০০টি আবেদনপত্র জাম দেয় যা বাঙালিদের পক্ষ থেকে ভুমি কমিশনের উপর অনাস্থার বহিঃপ্রকাশ।

একাদিক আঞ্চলিক দলের সৃষ্টি এবং দলগুলোর সন্ত্রাসী কার্যকলাপ।    পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্যে দিয়ে শান্তি বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার কথা থাকলেও তাদের কিছু সদস্য অস্ত্র জমা না দিয়ে সশস্ত্র কর্মকান্ড অব্যাহত রাখে। পাশাপাশি পিসিজেএসএস হতে জেএসএস (সংস্কারপন্থী) এবং ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) হতে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) দলের সৃষ্টি হয়ে মোট ০৪টি আঞ্চলিক দলের আবির্ভাব হয়। বিশেষত জেএসএস (মূল) এবং ইউপিডিএফ (মূল) পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক প্রকৃতি নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা পালন করছে।

বর্তমানে জেএসএস (মূল) এবং ইউপিডিএফ (মূল) যৌথভাবে প্রতিপক্ষ জেএসএস (সংস্কাপন্থী) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এর অস্তিত্ব বিনাশে কিংবা তাদেও সমঝোতায় আনতে ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করছে। এছাড়া, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে মারমা ন্যাশনালিস্ট পার্টি (এমএনপি) ও কুবি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামক আরো দুটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী দলের আবির্ভাব হয়। বর্তমানে দলগুলো এলাকায় প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে চাঁদাবাজি, হত্যা, অপহরণসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জনা যায়।

স্বাধীন জুম্মল্যান্ডের স্বপ্ন
চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের মানচিত্র হতে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন জুম্মল্যান্ড গঠনের স্বপ্নে বিভোর উপজাতি স্বার্থানে¡ষী একটি মহল। স্বাধীন জুম্মল্যান্ড গঠনের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে তারা দেশে বিদেশে নানান ধরনের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বিশেষত ফেসবুকের মাধ্যমে তারা স্বাধীন জুম্মল্যান্ডের পক্ষে ব্যাপক প্রচারনা চালিয়ে উপজাতি তরুন প্রজন্মকে এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করছে। ইতোমধ্যে তারা স্বাধীন জুম্মল্যান্ডের পতাকা, মুদ্রা, মানচিত্র, পরিচয়পত্র, রেডিও চ্যানেল, জাতীয় সংগীত ইত্যাদি প্রকাশ করেছে। এমনকি জাতীয় শোক দিবস ১৫ আগস্টকে মান্য না করে তার ১০ নভেম্বর (এমএন লারমার মৃত্যু দিবস) জাতীয় শোক দিবস হিসাবে পালন করে আসছে।

সাম্প্রদায়িক উস্কানি
আঞ্চলিক দল ও উপজাতি স্বার্থানে¡ষী মহল সাম্প্রদায়িক উস্কানির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। মহালছড়ির জয়সেনপাড়া এলাকায় বাঙালিদের দখলীয় টিলায় স্থানীয় উপজাতিদের ঘর নির্মাণ করাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় উপজাতি ও বাঙালিদের মাঝে উত্তেজনা ও মারামারি, মহালছড়ির জয়সেন পাড়া এলাকায় কবুলিয়তনামা মূলে প্রাপ্ত বাঙালিদের জমিতে স্থানীয় কতিপয় উপজাতির রাতের অন্ধকারে বাঁশের খুটি ও ছন দিয়ে ঘর নির্মাণ করে এবং পরবর্তীতে উপজাতিরা নিজেদের ০৩টি ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে বাঙালিদের দোষারোপ করে, সিন্দুকছড়ির ঠান্ডাছড়ি এলাকায় উপজাতি কর্তৃক অবৈধভাবে জমি দখলের চেষ্টা, লাইফুকারবারীপাড়া এলাকায় ২০-২৫ জন বাঙালি শ্রমিক কচুক্ষেতে কাজ করার সময় ১২-১৫ জন অস্ত্রধারী উপজাতি সন্ত্রাসী বাঙালি শ্রমিকদের মারধর করতঃ ভীতি প্রদর্শনের লক্ষ্যে ১৫-২০ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুঁড়ার ঘটনা উলে­খযোগ্য।

স্বার্থান্বেষী মহলের অপপ্রচার    
আঞ্চলিক দল ও উপজাতি স্বার্থানে্বষী মহল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে নিরাপত্তা বাহিনী ও রাষ্ট্র বিরোধী অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় জেএসএস (মূল) দলের সহযোগি সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমার কথিত অপহরণ ও বিলাইছড়িতে মারমা তরুণীর কথিত ধর্ষণ ঘটনার সাথে সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে এবং লক্ষীছড়ি জোন এলাকায় ইউপিডিএফ (মূল) দলের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা বাঙালি নির্মাণ শ্রমিকদের হাতে অস্ত্র দিয়ে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়। এছাড়া, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের স্পর্শকাতর ইস্যুতে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও বুদ্ধিজীবী কর্তৃক উপজাতিদের পক্ষে বক্তব্য/বিবৃতি প্রদান কোন কোন ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলে।

আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা
আঞ্চলিক দলের সন্ত্রাসীরা সড়ক, সেতু, কালভার্ট নির্মাণসহ বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে চাঁদা দাবি, মারধর, হুমকি প্রদান প্রভৃতির মাধ্যমে যোগাযোগ/আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। চাঁদার দাবীতে বড়ইছড়ি-রাঙ্গামাটি সড়কের পাশ¡বর্তী দেয়াল নির্মাণের কাজ জেএসএস (মূল) দলের সন্ত্রাসী কর্তৃক বন্ধ করা, সিন্দুকছড়ি জোনের পঙ্খীমুড়া এলাকায় ০৩টি ট্রাক ভাংচুর, বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার প্রতিটি স্কুল হতে জেএসএস (মূল) দলের সন্ত্রাসী কর্তৃক মোবাইল ফোনের মাধ্যমে স্কুলপ্রতি ২,০০০ টাকা চাঁদা দাবি।

সীমান্ত সড়ক নির্মাণে বাধা    
২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিন পার্বত্য জেলায় সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের কাজ শুরুর পর হতে আঞ্চলিক দলের সন্ত্রাসী কর্তৃক চাঁদা দাবিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা করা হয়। এছাড়া, ২০১৬ সালে বিশ¡ ব্যাংকের অর্থায়নে থেগামুখ হতে চট্টগ্রাম সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য সরকার কর্তৃক জরিপ পরিচালনা করা হয় কিন্তু উক্ত সড়ক নির্মাণের ব্যাপারে বিশ্ব ব্যাংকের কাছে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেএসএস (মূল) দলের সভাপতি সন্তু লারমা আপত্তি জানানোর প্রেক্ষিতে বিশ্ব ব্যাংক প্রকল্পটি হতে নিজেদের সরিয়ে নেয়। উক্ত এলাকায় জেএসএস (মূল) দলের সশস্ত্র গ্র“পের চলাচল ও গোপন আস্তানা থাকায় সন্তু লারমা আপত্তি উত্থাপন করে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।

পর্যটন শিল্প বিকাশের বাধা    
আঞ্চলিক দলের সন্ত্রাসী ও উপজাতি স্বার্থান্বেষী মহল তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন শিল্প বিকাশে বাধা প্রদান অব্যাহত রেখেছে। উলে­খ্য, চন্দ্র পাহাড়ে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণের প্রতিবাদে গত ০৭ ফেব্র“যারি ২০২১ তারিখে বান্দরবানে লংমার্চ, ১৮ সেপ্টে¤¦র ২০২১ তারিখে বান্দরবান-রাঙ্গামাটি সড়কে পর্যটকবাহী গাড়িতে জেএসএস (মূল) দলের সন্ত্রাসীরা গুলিবর্ষণ, ২৪ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে খাগড়াছড়ি এলাকায় মাইক্রোবাসসহ ০৪ জন বাঙালি পর্যটক অপহরণের ঘটনাসহ পর্যটক হয়রানির ঘটনা ঘটে।

ধর্মান্তরকরণ কার্যক্রম    
র্পাবত্য চট্টগ্রামে কতিপয় এনজিও সংস্থার মাধ্যমে স্বার্থানে¡ষী মহল সাধারণ ও দরিদ্র উপজাতিদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ধর্মান্তরকরণের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। পার্বত্য চুক্তির পর হতে অদ্যাবধি খ্রিষ্টান ধর্মে ৪,৫৯১ জন, বৌদ্ধ ধর্মে ০২ জন, হিন্দু ধর্মে ৭৬ জন এবং ক্রামাহ ধর্মে ২৪৮ জন ধর্মান্তরিত হয়।

সমস্যা হতে উত্তরণ

কার্যকরী ভূমি কমিশন
ভূমি সমস্যা পার্বত্য চট্টগ্রামে মূল সমস্যাসমূহের মধ্যে অন্যতম। ভূমি সমস্যা দূরীকরণে ভূমি কমিশনকে নিরপেক্ষভাবে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া অতি দ্রুততার সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপের উদ্যোগ গ্রহণ করে ভূমির মালিকানা নির্ধারণ করা যেতে পারে যা ভূমি সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

আঞ্চলিক দলের সন্ত্রাসী কার্যক্রম রোধ
পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময়ে গড়ে উঠা ছয়টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী দলের হত্যা, চাঁদাবাজি, অপহরণ এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রম রোধের মাধ্যমে সকল সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখা যেতে পারে।

আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন     
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি স্বার্থানে্বষী মহল কর্তৃক পর্যটন খাতের বিকাশ ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। পর্যটন শিল্প, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধিত হলে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা আধুনিক জীবন যাপনের ছোঁয়া পেয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম থেকে সরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে বলে আশা করা যায়। তাই পর্যটন শিল্প এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দলসমূহকে এগিয়ে আসতে হবে।

নিরাপত্তা বাহিনীর সক্ষমতা 
আঞ্চলিক দলের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে সকল সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্র“প ও জঙ্গি সংগঠন নির্মূলে নিরাপত্তা বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

নিরাপত্তা বাহিনীর জনবল বৃদ্ধি
নিরাপত্তা বাহিনীর জনবল বৃদ্ধি আঞ্চলিক দলের সন্ত্রাসী কার্যকলাপসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে সকল সন্ত্রাসী গ্র“প নির্মূলে নিরাপত্তা বাহিনীর জনবল বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। ইতোমধ্যে, এপিবিএন এর একটি ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি থেকে জানা যায়। এছাড়াও, পার্বত্য চট্টগ্রামে র‌্যাব ও পুলিশ বাহিনীর জনবল বৃদ্ধি করা যেতে পারে। নিরাপত্তা বাহিনীর জনবল বৃদ্ধি করে স্থিতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতি বজায় রাখার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল উন্নয়ন কার্যক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

সমন্বিত  উদ্যোগ
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাটি একটি জাতীয় সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নয়নের জন্য সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা এবং দেশী-বিদেশী এনজিওসমূহকে সমনি¡ত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে এই জাতীয় সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।

উপজাতি আঞ্চলিক দল ও দেশী-বিদেশী স্বার্থানে্বষী মহলের ষড়যন্ত্র, উস্কানি এবং বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্তে¡ও পার্বত্যাঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনী নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীর এই প্রচেষ্টার পাশাপাশি পার্বত্যাঞ্চলের বিরাজমান সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সকলকে নির্বিশেষে একযোগে কাজ করে যেতে হবে।

এসআর

×