
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধ-অস্ত্রের প্রতিযোগিতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আমরা স্বজনহারা বেদনার কান্না শুনতে চাই না। আমরা যুদ্ধ চাই না, কোনো সংঘাত চাই না। যুদ্ধ চাই না, ধ্বংস চাই না, অস্ত্র প্রতিযোগিতা চাই না, আমরা শান্তিপূর্ণ বিশ্ব চাই, শান্তি চাই। আর শেখ রাসেলের মতো আর কোনো শিশুকে যেন জীবন দিতে না হয়। আমরা চাই প্রত্যেকের ভবিষ্যৎ সুন্দর হোক, উন্নত হোক।
মঙ্গলবার জাতির পিতার কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের ৫৯তম জন্মদিন উপলক্ষে ‘শেখ রাসেল দিবস-২০২২’-এর উদ্বোধন এবং ‘শেখ রাসেল পদক-২০২২’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজের বাবা-মা, স্বজন হত্যার বিচার চাইতে না পারার বেদনার কথা স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমরা কেউ বিচার চাইতে পারব না! এখানে আমার একটা প্রশ্ন-আজকে আন্তর্জাতিকভাবে কত কিছু হয় মানবাধিকারের কথা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদ কত কিছু হয়।
কিন্তু কই তখন কেউ তো আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি। আমার দল ও বাংলার জনগণ ছিল। কিন্তু যারা ঘাতকের সঙ্গে ছিল, ঘাতকদের সহযোগিতা করেছিল বা চক্রান্তের সঙ্গে ছিল বা ঘাতকদের পুরস্কৃত করেছে, বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়েছে- এই অন্যায়-অবিচারগুলো তো নিজ চোখে দেখেছি। আজ মানবতার কথা, মানবাধিকারের কথা-এত গালভরা কথা শুনি কেন? আমার এই প্রশ্নের জবাব কী কেউ দিতে পারবে?
প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক সম্পাদিত ‘দুরন্ত প্রাণবন্ত শেখ রাসেল’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্রের ট্রেলারও প্রদর্শিত হয়।
আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এমপির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন আইসিটি বিভাগের সিনিয়র সচিব এনএম জিয়াউল আলম, শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের মহাসচিব কে এম শহীদুল্লাহ ও শিশু বক্তা আফসা জাফর সৃজিতা। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক বিজয়ীদের মধ্যে ‘শেখ রাসেল পদক-২০২২’ বিতরণ করেন।
শেখ রাসেল দিবস-২০২২ উপলক্ষে দেশব্যাপী কুইজ, ক্রীড়া, শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের মাঝেও পুরস্কার বিতরণ করা হয়। অনুষ্ঠানে শেখ রাসেলের উপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি এবং আইসিটি বিভাগ কর্তৃক নির্মিত শেখ রাসেল দিবস-২০২২ উপলক্ষে একটি থিম সং পরিবেশিত হয়। পরে শিশুদের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনকারীদের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য যে এইসব লোক যারা হত্যাকারী, হত্যাকারীদের মদদদাতা, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের ব্যাপারে তখন কোনো কথা নেই। আমার অধিকার, আমার মানবাধিকার-আমার বাবা-মায়ের বিচার চাওয়ার অধিকার তো আমারই ছিল না। সেখান থেকে তো আমরা বঞ্চিত ছিলাম। যারা যে সকল বিচারক সেদিন বিব্রত হয়েছিলেন, তাঁরা এখন অনেকেই বড় বড় দার্শনিক হয়ে গেছেন। আমি তো সবই দেখি কিন্তু কিছু বলি না।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, সত্যকে মুছে ফেলার যে অপচেষ্টা এবং দেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি শুরু হয়েছিল জাতির পিতা হত্যাকা-ের বিচার হবার মাধ্যমে আজকে জাতি তার থেকে মুক্তি পেয়েছে। আর বারবার আঘাত আসার, হত্যা চেষ্টার পরও এই দিনটি দেখবেন বলেই হয়ত সৃষ্টিকর্তা মহান রাব্বুল আলামিন তাঁকে বাঁচিয়ে রাখেন। অনুষ্ঠানে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে রাসেলের জন্ম, দুরন্ত শৈশব এবং মৃত্যুকালীন ঘটনার মর্মন্তুদ স্মৃতি রোমন্থন করেন প্রধানমন্ত্রী।
আবেগজড়িত কণ্ঠে ১৫ আগস্টের বর্বরোচিত হত্যাকা-ের কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, এই যে শিশু হত্যা, নারী হত্যা, রাষ্ট্রপতিকে হত্যা- এই হত্যার বিচার না করার একটা আইন করে রাখা হয়। যে কেউ খুনিদের বিচার করতে পারবে না। ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়। অর্থাৎ আমি আমার মা-বাবা-ভাই যাদের হারিয়েছি তাদের বিচার চাইতে পারব না। মামলা করতে পারব না। আমি আর রেহানা (শেখ রেহানা) বিদেশে ছিলাম, আমাদের দেশে আসতে দেয়নি, ছয়টা বছর রিফিউজি হিসেবে বিদেশে থাকতে হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বকে শিশুদের জন্য সুন্দর ও বাসযোগ্য করতে যুদ্ধ ও অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়ে শান্তি ফিরে আসুক, এটাই তাঁর প্রত্যাশা। আমরা একটি শান্তিপূর্ণ পৃথিবী চাই। আমরা যুদ্ধ চাই না, ধ্বংসযজ্ঞ, অস্ত্র ব্যবসা, কোনো শিশুকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করা এবং কাউকে গুলি করে হত্যা করা হোক, আমরা তা চাই না। আজকে বিশ^ব্যাপী যুদ্ধ (রাশিয়া-ইউক্রেন)। কত শিশু আজকে এতিম হয়ে যাচ্ছে, কত শিশু কষ্ট পাচ্ছে। আমরা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি সেখানেও তো শিশুরা পরভূমে রিফিউজি হিসেবে মানুষ হচ্ছে। তাই আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৭৫ এর পর দেশে ১৯টি ক্যু হয়েছে, আমাদের ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে হাজারো অফিসার-সৈনিক হত্যা করা হয়েছে, স্বজনরা তাদের লাশও পায়নি, গুম করে ফেলা হয়েছে। আমাদের আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতা-কর্মী এদের হাতে নির্যাতিত হয়েছে, কারাভোগ করেছে, মৃত্যুবরণ করেছে। কাজেই আর আমরা এই স্বজনহারা বেদনা, কান্না শুনতে চাই না।
আমরা চাই প্রত্যেকের ভবিষ্যৎ সুন্দর হোক, উন্নত হোক। আমরা পাঁচ হাজার কম্পিউটার ল্যাব এবং ৩০০টি স্কুল অফ ফিউচার উদ্বোধন করলাম। এর আগে আরও আট হাজার করেছিলাম, প্রায় ১৩ হাজার ডিজিটাল ল্যাব করা হয়েছে।
সরকার প্রধান বলেন, সারা বাংলাদেশে আমাদের ছেলেমেয়েদের আধুনিক প্রযুক্তি শিক্ষা দেওয়া, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা এটাই আমাদের লক্ষ্য ছিল। শিশুদের যে মেধা সে মেধা বিকাশের যেন সুযোগ হয়, শিক্ষা-দীক্ষায় তারা উন্নত হবে, প্রগতির সঙ্গে এগিয়ে যাবে, প্রযুক্তি শিক্ষা নেবে, বিজ্ঞান শিক্ষা নেবে এবং দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
তিনি বলেন, আজকের শিশুরাই হবে আগামী দিনের কর্ণধার।
আজকের শিশুরাই এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে। কোনো মানবাধিকার যেন লঙ্ঘন না হয়, কোন শিশু যেন নির্যাতিত না হয়। প্রত্যেকেই যেন সুন্দর জীবন পায় সেটাই আমরা চাই। আর সেই লক্ষ্য নিয়েই আমাদের কাজ আমরা করে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চা, লেখাপড়া, আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তি শিক্ষা এবং বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা, প্রতিনিয়ত যেসব প্রযুক্তির পরিবর্তন হচ্ছে সেসব পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা- সেভাবেই বাংলাদেশ গড়ে উঠুক।
বাংলাদেশের সকল শিশুর মেধা বিকাশের সুযোগ হোক। আজকে রাসেল নেই, আমরা তো সবই হারিয়েছি কিন্তু বাংলাদেশটা যেন সামনের দিকে এগিয়ে যায়। এ লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি।
’৭৫ পরবর্তী রিফিউজি হিসেবে থাকার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৯১ সালে আমাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি করা হয় সকল রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে দেশে ফিরে আসি। কিন্তু দেশে ফিরে এসে আমি যখন মামলা করতে যাই বা তার আগেও চেষ্টা করেছি।
কিন্তু সেই মামলা করা যায়নি কারণ আইনে বাধা। আমার প্রশ্ন আজকেতো অনেক মানবাধিকারের কথা বলা হয়। কারও অস্বাভাবিক মৃত্যুতে বিচার চাওয়া হয় তাহলে ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট যারা আপনজন হারিয়েছি তারা কী অপরাধ করেছিলাম? কেউ বাবা-মা হারিয়েছে, সন্তান হারিয়েছে, ভাই হারিয়েছে, বোন হারিয়েছে তাদের অপরাধটা কোথায় ছিল?
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচার করতে পেরেছি তখনই, যখন অনেক ঘাত-প্রতিঘাত চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আমি সরকার গঠন করতে পেরেছি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছি তখনই।
সেই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করে সেই বিচার করতে হয়েছে। যে বাতিলের পথেও অনেক বাধা ছিল। তিনি বলেন, আমরা জানি এবং শুনি ‘বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে’ ঠিক সেটাই হয়েছিল আমাদের বেলায়।
উচ্চ আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্সের রায়ের শুনানিতে বিচারকদের কারও কারও ‘বিব্রত বোধ’ করার কথাও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ’৯৮ সালের ৮ নভেম্বর যখন জাতির পিতা হত্যা মামলার বিচারের রায় ঘোষণা করা হবে সেদিন বিএনপি হরতাল ডেকেছিল এবং এরপর যখন আমরা সরকারে ছিলাম না তখন বিচার প্রক্রিয়াটাকেই বন্ধ করে রাখা হয়।
সরকার প্রধান বলেন, ’৭৫ এর পর যারা ক্ষমতায় এসেছে সেনা শাসক জিয়াউর রহমান, জেনারেল এরশাদ বা খালেদা জিয়া-প্রত্যেকেই এই খুনিদেরকে মদদ দিয়েছে, পুরস্কৃত করেছে। এমনকি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন সেই খুনি পাশা এবং হুদাকে নিয়ে ‘প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি (প্রগশ)’ নামে রাজনৈতিক দলও করেছেন।
অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবেই তাদের পুনর্বাসিত করা। জেনারেল এরশাদ খুনি ফারুককে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করেছেন। আর খালেদা জিয়া রশিদ এবং হুদাকে জনগণের ভোট চুরি করে ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনে নির্বাচিত করে সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসায়। আর আজকে তারা ভোটের কথা বলে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার দুদিনের মাথায় জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে নেয়। সেনা প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই আবার নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে। আর এই খুনিদেরকে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স করে বিচারের হাত থেকে মুক্তি দিয়ে যায়। তাদের মুখেই আজকে গণতন্ত্রের কথা শুনতে হয়, ভোটের কথা, মানবাধিকারের কথা শুনতে হয়।