ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্ব শিশু দিবস আজ

অনলাইনে বন্দী থাকাই যেন নিয়তি

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২২:৪৯, ২ অক্টোবর ২০২২

অনলাইনে বন্দী থাকাই যেন নিয়তি

ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়ছে কোমলমতি শিশুরা

ব্যাংকার বাবা শিপন ইসলাম এবং স্কুলশিক্ষিকা শান্তার ছেলে শিমুল। সন্তান জন্মের সময় মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষ করেই বনানীর বাসিন্দা শান্তাকে স্কুলের চাকরিতে যোগ দিতে হয়। বরাবরের মতো শিপনকেও চালিয়ে যেতে হয় নিয়মিত অফিস। কর্মস্থলে থাকাকালে শিশুকে রাখার জন্য প্রথমে শিপনের মা এসে থাকেন কিছুদিন। নগরজীবনে হাঁপিয়ে উঠলে শান্তা তার গ্রামের বাড়ি থেকে নিয়ে আসেন দুঃসম্পর্কের এক চাচাত বোনকে। স্বামী-স্ত্রী অফিসে চলে গেলে ছোট্ট শিমুলের বেড়ে ওঠা সেই বোনের কাছেই। একটু স্বস্তিতে থাকার জন্য ওই বোন শিমুলের হাতে তুলে দেন স্মার্টফোন। মাত্র ১১ মাস বয়স থেকেই ইউটিউবে ভিডিও দেখে খাওয়ানোর অভ্যাস গড়ে ওঠে শিমুলের। আজ ৩ বছরে পা রাখলেও অভ্যাসে আসেনি একচুল পরিবর্তন। বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে স্মার্টফোনে ভিডিও আসক্তি। বিকেলে এক ঘণ্টার জন্য ছাদে যাওয়া ছাড়া ছোট্ট ফ্ল্যাটে অনলাইনে বন্দী জীবনই যেন নিয়তি তার।
তবে চাকরিজীবী না হয়েও মেয়েকে খাবার খাওয়ানোর জন্য ইউটিউবে কার্টুনের শরণাপন্ন হন প্রিয়াসা শর্মা। এর ফল যে কতটা ভয়াবহ তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন মেয়ে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। স্কুলে ভর্তি করলে ক্লাসে যেটুকু সময় থাকে সেটুকু সময় বন্ধুদের সঙ্গে মেতে থাকলেও ঘরে ফিরেই বাবার ডেস্কটপে কার্টুনে মগ্ন। যা এখন আসক্তি পর্যায়ে চলে গেছে জানিয়ে প্রিয়াসা বলেন, মেয়েকে এখন বাইরে বেড়াতে নিয়ে যেতে চাইলেও ডেস্কটপ ছেড়ে উঠতে চায় না। দিন দিন বাড়ছে স্থ’ূলতা। মাঝে মাঝে মনে হয় বুদ্ধির বিকাশও বুঝি হচ্ছে না স্বাভাবিক। সব দোষ আমাদেরই।
শুধু শান্তা বা প্রিয়াসা নন। এমন আক্ষেপ এখনকার সময়ের প্রায় সব বাবা-মায়েরই। ডিজিটাল সময়ের সুফলের সঙ্গে শিশুদের শৈশব বন্দী হয়ে যাচ্ছে অনলাইনে। নেই প্রয়োজনীয় খেলার মাঠও। যাতে করে ঘটতে পারে এসব শিশুর খেলাধুলার সুযোগ। এমন অবস্থায় আজ দেশে উদযাপিত হচ্ছে বিশ্ব শিশু দিবস।
বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার বিশ্ব শিশু দিবস পালন করে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় আজ সোমবার সারাদেশে পালিত হচ্ছে দিবসটি। একই সঙ্গে শিশুর অধিকার, সুরক্ষা এবং শিশুর উন্নয়ন ও বিকাশে সংশ্লিষ্ট সকলকে অধিকতর উদ্যোগী ও সচেতন করার লক্ষ্যে পালন করা হবে নানা কর্মসূচী। শুধু তাই নয় মঙ্গলবার থেকে ১১ অক্টোবর পর্যন্ত পালন করা হবে শিশু অধিকার সপ্তাহ।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিবছরের মতো এ বছরও দেশব্যাপী বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ উদযাপন করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। ‘গড়বে শিশু সোনার দেশ, ছড়িয়ে দিয়ে আলোর রেশ’ প্রতিপাদ্যে দিবসটি উপলক্ষে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা আজ সকালে শিশু একাডেমি মিলনায়তনে বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ ২০২২ এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেবেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ হাসানুজ্জামান কল্লোল।
দিবসটিকে সামনে রেখে ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা জনকণ্ঠকে বলেন, শিশুরাই জাতির ভবিষ্যত। তারাই আগামী দিনে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃত্ব দেবে। জ্ঞানচর্চা ও প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হয়ে গড়ে তুলবে সকলের জন্য কল্যাণকর নতুন বিশ্ব। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশুদের জন্য সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। জাতির পিতা ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করেন। জাতিসংঘ ১৯৮৯ সালে শিশু অধিকার সনদ ঘোষণার ১৫ বছর আগে ১৯৭৪ সালে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশুদের অধিকার সুরক্ষার জন্য শিশু আইন প্রণয়ন করেন। সদ্য স্বাধীন দেশে শিশুর শিক্ষা, সুরক্ষা ও উন্নয়নে কল্যাণকর বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশুদের শিক্ষা, পুষ্টি, সুরক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন আইন, নীতি ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও শিশু বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
কিন্তু সরকারের এ নিরলস কাজের পরেও দেশজুড়ে কমছে খেলার মাঠ। ফলে বেড়ে ওঠা শিশুদের বাড়ছে ইন্টারনেট আসক্তি।
২০২০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় জানানো হয়, বাংলাদেশের ৬৬ শতাংশ শিশু শরীরচর্চার পেছনে দৈনিক এক ঘণ্টা সময়ও ব্যয় করে না। অর্থাৎ প্রতি তিনজনের মধ্যে দুজন শিশু শরীরচর্চার পেছনে সময় ব্যয় করে না। শারীরিক অনুশীলনের অভাবে শিশুর স্বাস্থ্য তো বটেই, মস্তিষ্কের বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সামাজিক দক্ষতা। অতিরিক্ত মাত্রায় মোবাইল বা অন্যান্য ডিভাইস ব্যবহারের কারণে শিশুরা হারাচ্ছে চিন্তাশক্তি। একইসঙ্গে নিজের মতের সঙ্গে মিল না হওয়ার কারণে খুব দ্রুতই উত্তেজিত হয়ে আত্মহত্যার মতো ভাবনাও আসছে তাদের মাঝে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বে ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে চারজনেরই নেই পর্যাপ্ত শরীরচর্চার অভ্যাস। সেইসঙ্গে ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্তি কেড়ে নিচ্ছে শিশুর শৈশব। আর এ কারণে বিঘিœত হচ্ছে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ।
বেসরকারী সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন এক সমীক্ষায় জানায়, দেশে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে ৩৬৪ জন আত্মহত্যা করেছে। এর ৫৩ দশমিক ৩০ শতাংশ অর্থাৎ ১৯৪ জনই স্কুলগামী শিক্ষার্থী। গত আট মাসে কলেজ শিক্ষার্থীদের ৭৬ জন ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫০ জনের আত্মহননের তথ্য পাওয়া গেছে। এই সময়ে মোট আত্মহননকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীও ছিলেন ৪৪ জন। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৪৫ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
আঁচল ফাউন্ডেশনের সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ১৩ থেকে ২০ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি শতকরা হারে যা ৭৮ দশমিক ৬ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেন ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সীরা, যার সংখ্যা ১৬০। আর অতিমাত্রায় ইন্টারনেট আসক্তিই এমন পরিস্থিতি তৈরি করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।  
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের মনোরোগ চিকিৎসক ও সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের সমাজ বর্তমানে একটা ক্রান্তিকাল পার করছে। ইন্টারনেটের সুফলে আমরা যেমন আধুনিক জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়েছি তেমনি অতিমাত্রায় ইন্টারনেট আসক্তি আমাদের শিশুদের একটা বধির প্রজন্মে পরিণত করছে। বাড়ছে হতাশা। আর হতাশা থেকে বাড়ছে আত্মহত্যা। আত্মহত্যা প্রায় সকল বয়সসীমাতেই বাড়ছে। তবে শিশুদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ার জন্য দুটি বিষয় কাজ করছে। প্রথমত তাদের যে আবেগের বিকাশ সেটি ঠিকমতো না হতে পারা।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে গত কয়েক বছরে বিশেষ করে করোনাকালে যত ধরনের মানসিক অভিঘাত আমাদের ওপরে এসেছে তাতে পেশাজীবীদের বাইরে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষার্থীরা। একদিকে তাদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত হয়েছে, দুইটা বছর তাদের স্কুলিং নষ্ট হয়েছে অন্যদিকে তাদের পরীক্ষা, ক্যারিয়ারসহ নানা বিষয়ে চাপ বেড়েছে। একইসঙ্গে যোগ হয়েছে পারিবারিক চাপ। সব বিষয় তাদের ওপর একটা বাড়তি চাপ ফেলেছে। তাই প্রয়োজন তাদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠ। বাবা-মায়ের সঙ্গ। পরিবারের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনার পরিবেশ তৈরি করা। ইন্টারনেট যেহেতু উপেক্ষা করার উপায় নেই তাই এর সঠিক ব্যবহার যাতে করে সেই ব্যাপারে নজরদারি বাড়ানো। তাহলেই এই সঙ্কট থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ লেলিন চৌধুরী বলেন, খেলার মাঠ না থাকলে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই আসলে অনুমোদন দেয়া ঠিক হবে না। কারণ শুধুমাত্র পড়াশোনার ওপরে জোর দিয়ে শিশুদের মানসিকতা সুস্থ রাখার চেষ্টাটাও করা সম্ভব হবে না। মনে রাখতে হবে আজকে শিশু আগামীর সম্ভাবনা।
আর এই শিশুদের বিষয়ে সংবেদনশীল হওয়া, শিশুর বেড়ে ওঠার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ নানা সচেতনতামূলক কর্মসূচী এই শিশু দিবসসহ শিশু অধিকার সপ্তাহে পালন করা হবে জানিয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানায়, এই কর্মসূচীর সঙ্গে সমন্বয়ক্রমে মঙ্গলবার জাতীয় কন্যাশিশু দিবস উদযাপন করা হবে। এ বছর জাতীয় কন্যাশিশু দিবসের প্রতিপাদ্য : ‘সময়ের অঙ্গীকার, কন্যাশিশুর অধিকার।’ মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, জাতীয় কন্যাশিশু এ্যাডভোকেসি ফোরাম জাতীয় কন্যাশিশু দিবস ২০২২ উপলক্ষে আলোচনা, পুরস্কার বিতরণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্রোড়পত্র প্রকাশ, টক শো আয়োজন, পোস্টার মুদ্রণ, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, কন্যাশিশু জার্নাল মুদ্রণ এবং কন্যাশিশু বার্তা প্রকাশ, র‌্যালি, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করবে।

 

×