ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

উত্তরা-বিমানবন্দর সড়কে করুণ দশা

ভয়াবহ যানজটে ফ্লাইট মিস

আজাদ সুলায়মান

প্রকাশিত: ২২:৪৬, ২ অক্টোবর ২০২২

ভয়াবহ যানজটে ফ্লাইট মিস

বনানী-এয়ারপোর্ট সড়কে রবিবার অসহনীয় যানজট

 রাজধানীর উত্তরা-বিমানবন্দর সড়কে ভয়াবহ যানজট স্থায়ী রূপ নিয়েছে। কি দিন- কি রাত সবসময়েই একই চিত্র। দুঃসহ যানজটে প্রতিদিনই ঘটছে ফ্লাইট মিসের ঘটনা। কর্তৃপক্ষ নানা পদক্ষেপ নেয়ার পরও কিছুতেই পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাচ্ছে না। সিভিল এভিয়েশনের নির্র্দেশানুযায়ী- হাতে চার ঘণ্টা সময় নিয়ে এয়ারপোর্টে রওনা দিয়েও ফ্লাইট ধরা যাচ্ছে না। রবিবার সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে বেলা বারোটার আগ পর্যন্ত ওই এলাকা ছিল রীতিমতো অচল। সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্থিরচিত্রের মতো দেখা গেছে বিশালাকার যানজট। জসীম উদ্দিন মোড় থেকে দুই ঘণ্টায়ও এয়ারপোর্টে পৌঁছতে না পারায় ফ্লাইট মিস করেছেন নওগাঁর মহিদুর ম-ল। তার মতো আরও অনেককেই বিমান বন্দরে এসে কান্নাকাটি করতে দেখা গেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক থেকে দেশী বিদেশী সব ফ্লাইটই বিলম্বে ছেড়ে গেছে। তারপরও অন্তত ৪৩ জন ফ্লাইট মিস করেছেন বলে বিভিন্ন এয়ারলাইন্স সূত্রে জানা গেছে। টানা দীর্ঘ ছয় ঘণ্টার এমন  অচলাবস্থার অবসান ঘটে বেলা ১২টার পর। বনানী থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত যানচলাচল স্বাভাবিক হতে থাকে।
জানতে চাইলে বিমানবন্দর পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম বলেন, আমরা বার বার নোটিস দিয়ে হাতে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে যাত্রীদের এয়ারপোর্ট আসার অনুরোধ জানিয়েছি। এতে আগের চেয়ে অনেকটা উন্নতি ঘটলেও রবিবারের যানজট ছিল খুবই কঠিন। তবে আমরা সব এয়ারলাইন্সকেই চেক ইন কাউন্টার বেশি সময় খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছি যাতে কেউ এক ঘণ্টা আগে এসেও ধরতে পারেন ফ্লাইট। একইভাবে আমরা সিটি কর্পোরেশন ও বিআরটিকে অনুরোধ করেছি যাতে রাস্তার জলাবদ্ধতা নিরসন করে দেয়। তারা এতে সহায়তা করেছে। এভাবে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছি। বৃষ্টির প্রভাব কমে এলে এটাও ঠিক হয়ে যাবে।  
জানতে চাইলে ট্রাফিক উত্তরা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার নাবিল কামাল শৈবাল বলেন, বিমানবন্দর সড়কে যানজট নিয়ন্ত্রণে আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করছি। বিআরটিএ’র চলমান কাজের জন্য সড়কে অনেক গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এসব গর্তের পানি অপসারণ করতে শ্যালো মেশিন লাগানো হয়েছে। এখন সড়কে পানি কমছে, সেই সঙ্গে গতি বাড়ছে যান চলাচলে।
রবিবার খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভোর থেকে বেলা বারোটা পর্যন্ত প্রতিটি ফ্লাইটই বিলম্বের শিকার হয়েছে। প্রতিটি ফ্লাইটেই দু এক জন করে যাত্রী রিপোর্ট করতে পারেননি সময়মতো। অনেকে এয়ারপোর্ট এসেও ফ্লাইট ধরতে পারেনি।
এমিরেটসের সুপারভাইজার জানান, সকালের ফ্লাইটে বিজনেস ক্লাসের তিন জন যাত্রী যেতে পারেননি। এদের দুজন বিমানবন্দরের কাছাকাছি এসে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে এয়ারপোর্ট পৌঁছতে সক্ষম হলেও অপরএকজন বয়স্ক হওয়ার দরুন পারেননি। ফলে উনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ফ্লাইটই চলে গেছে। একজনকে রেখে অপর দুজনও যাত্রা বাতিল করতে বাধ্য হন। এমন ভিকটিম হয়েছেন আরও অন্তত ২৩ জন যারা নিজ নিজ এয়ারলাইন্সে অভিযোগ করেছেন।
বিমান সূত্র জানিয়েছে, তাদের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটের সব ফ্লাইটই বিলম্বের শিকার হয়েছে। অভ্যন্তরীণ রুটে অন্তত ২৩ জন ফ্লাইট মিস করেন। বিলম্ব হয়েছে লন্ডন ম্যানচেষ্টার সিঙ্গাপুর কাঠমান্ডু দিল্লীসহ সব রুটের ফ্লাইটে। একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ভোর থেকেই যানজটের খবর পেয়ে চেক ইন কাউন্টারগুলোতে নির্দেশ দেয়া হয় যাতে কিছুটা বিলম্ব হলেও প্রতিটি যাত্রীকেই ফ্লাইট ধরানো সম্ভব হয়। সেজন্য আধঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্বে ছেড়েছে ফ্লাই্টগুলো। বিমানের মতো বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলোও একই নীতি অনুসরণ করে।
এদিকে যানজটের দরুন আগমনী ফ্লাইটের যাত্রীরাও বিপাকে পড়েন। তাদের লাগেজ নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে দেখা গেছে কনকর্স হলে। ভোর থেকে  বেলা এগারোটা পর্যন্ত অন্তত ১৫টি ফ্লাইটের যাত্রীই ভোগান্তির শিকার হন। তাদের জন্য আগত গাড়ি রাস্তা থেকে সময়মতো এয়ারপোর্ট কনকর্স হল এরিয়ায় পৌঁছতে না পারায় যাত্রীদের বিশাল ভিড় দেখা দেয়।
এ সময় সৌদি থেকে আগত ওমরাহ হাজী গাফফার বলেন, আমি বেশ ক’জন হাজী নিয়ে সকাল নয়টায় ল্যান্ড করেছি। গ্রীন চ্যানেল থেকে বেরিয়ে এখানেই দাঁড়িয়ে আছি। কারণ আমাদের বাস নওগাঁ থেকে রওনা হয়েছে শনিবার সন্ধ্যায়। সে বাস নাকি আব্দুল্লাহপুর এসে আটকে আছে। একঘণ্টায় একচুলও অগ্রসর হতে পারছে না। এখন বেলা বাজে সাড়ে এগারোটা। কখন  আসবে আল্লাহই জানেন।
গাফফারের মতো কুয়েত থেকে এসেছেন মাহবুব, রমজান ও হামিদ আফ্রাদসহ অনেকেই।  তারাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আটকা আছেন গাড়ির জন্য । সময়মতো তাদের ভাড়া করা বা নিজের গাড়ি যানজটের কারণে বিমানবন্দর ঢুকতে পারছে না। অন্যান্য এয়ারলাইন্সেরও একই অবস্থা।
কিন্তু কেন এই ভয়াবহ যানজট এমন প্রশ্ন করা হলে এড়িয়ে গেছেন বিমানববন্দর গোল চত্বরে কর্মরত ট্রাফিক সদস্যরা। তারা শুধু বলেছেন, দেখেন না কাজ করছি। যানজটের কোন কারণ লাগে নাকি। এটা প্রত্যেক দিনের ঘটনা। চলতেই থাকবে এমন।
এদিন সরেজমিনে দেখা যায়, একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান থাকা ও বেহাল রাস্তার কারণে প্রতিনিয়ত ভোগাস্তি পোহাতে হচ্ছে ওই সড়ক দিয়ে চলাচলকারীদের। তার ওপর রবিবার ভোরে হওয়া বৃষ্টি রাজধানীবাসীর ভোগান্তি বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। এতে সকাল থেকেই স্থবির হয়ে পড়ে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কটি। সকাল ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত বিমানবন্দর সড়ক প্রায় থমকে ছিল। ঢাকার ভেতরে ঢোকা এবং বের হয়ে যাওয়ার দুই পথেই তীব্র যানজট। সেই সঙ্গে সড়কের মোড়গুলোতে কাজে বের হওয়া মানুষের ভিড়। এ কারণে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটাও দায় হয়ে পড়ে। কাজে বের হওয়া মানুষ যানজটের কারণে বাসে উঠছে না, আবার যারা বাসে করে যাচ্ছিলেন যানজট তীব্র হওয়ায় তারাও বাস থেকে নেমে হাঁটা শুরু করছেন। আব্দুল্লাহপুর থেকে উত্তরা, এয়ারপোর্ট, খিলক্ষেত, বিশ্ব রোড, বনানী, কুড়িল প্রগতি সরণিজুড়েই তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে বনানী, বিশ্বরোড, খিলক্ষেত, কাওলা, এয়ারপোর্ট, উত্তরা, আব্দুল্লাহপুর পেরিয়ে গেছে যানবাহনের দীর্ঘ সারি।  ট্রাফিক বিভাগের এক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিমানবন্দর সড়ক বলতে গেলে প্রায় কলাপস করেছে। ইনকামিং আউটগোইং কোনটাই হচ্ছে না। এর কারণ উন্নয়নকাজ চলমান থাকা ও বেহাল সড়ক। তার ওপর বৃষ্টির পানি গর্তে জমে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। তাই যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। যা দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি করছে। তাছাড়া বৃষ্টির মধ্যে অফিসগামী মানুষের ভিড়। মূলত আব্দুল্লাহপুর থেকে বিমানবন্দর সড়ক হয়ে বনানী পর্যন্ত আবার বনানী থেকে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত সড়কের দুই অংশজুড়েই তীব্র যানজটের কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন নগরবাসী। ট্রাফিক বিভাগ দ্রুত এ যানজট নিরসনে কাজ করে যাচ্ছে । বৃষ্টির কারণে সকাল থেকে রাজধানীতে গণপরিবহন সঙ্কট ছিল। ফলে কাজে বের হওয়া মানুষ গণপরিবহন না পেয়ে ছাতা মাথায় রাস্তায় অপেক্ষায় ছিল। রাস্তায় মানুষ দাঁড়িয়ে থাকার কারণেও অন্যান্য যানবাহনে চলাচলে বিঘœ ঘটে। যার প্রভাব পড়ে যানজটে। এর মধ্যে বিমানবন্দরের মতো একটি ব্যস্ত সড়কে তীব্র যানজট দেখা দেয়ায় তা পুরো শহরেই ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি।
 বেলা দশটার সময় দেখা গেছে, সারারাত বৃষ্টির দরুন উত্তরায় বিমানবন্দর সড়কে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। এ জন্য সড়কে সকাল থেকেই দেখা দেয় তীব্র যানজট। স্থবির হয়ে পড়ে বিমানবন্দরসহ এর আশপাশের সড়ক। চরম ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে শ্যালো মেশিন সংগ্রহ করে বিমানবন্দর সড়কের পানি সরাতে উদ্যোগ নেয় পুলিশের ট্রাফিক উত্তর বিভাগ। দুপুর ১২টার দিকে এই মেশিন দিয়ে তারা পানি সরানোর কাজ শুরু করে। ঘণ্টাখানেক পর কমে সড়কের পানি।

তখন বিমানবন্দর সড়কে যান চলাচলে গতি বাড়ে কিছুটা। তবে বিকেল ৩টা পর্যন্ত এই সড়কের যানজট নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি ট্রাফিক পুলিশ। পুলিশের ট্রাফিকের উত্তরা বিভাগ জানিয়েছে, এদিন ভোর থেকে রাজধানীতে শুরু হয় বৃষ্টি। এতে বিমানবন্দর সড়কের উত্তরার অর্ধেক অংশ পানির নিচে চলে যায়। ফলে সড়কটিতে গতি কমে যায় যান চলাচল। এর মধ্যে আবার সড়কের খানাখন্দ ও গর্তে পড়ার আশঙ্কায় যানবাহনগুলো পানির অংশ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। এতে উত্তরা ছাড়িয়ে খিলক্ষেত, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও সাতরস্তা পর্যন্ত যানজট ছাড়িয়ে যায়। দীর্ঘ সময় আটকে থেকে উপায় না পেয়ে হেঁটেই গন্তব্যে ছুটেন যাত্রীরা। ফলে ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে যানজট নিরসনে হিমশিম খায় ট্রাফিক পুলিশ। একইভাবে খিলক্ষেত, বাড্ডা, নতুন বাজার, রামপুরা এলাকা পর্যন্ত বিমানবন্দরগামী লেনে সৃষ্টি হয় যানজট। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ- যানজটের প্রধান কারণ উত্তরা এলাকায় বিআরটিএ’র প্রকল্প। প্রকল্পের কাজের জন্য সড়কে বড় বড় গর্ত হয়েছে। এসব গর্তে জমেছে পানি। এই পরিস্থিতিতে বিমানবন্দর হয়ে টঙ্গী বা গাজীপুরের দিকে যানবাহন দ্রুত গতিতে চলতে পারছে না। ফলে দেখা দিয়েছে তীব্র যানজট। পুলিশ জানিয়েছে, কিছুদিন আগেও বৃষ্টির কারণে সড়কে পানি জমে এমন যানজট তৈরি হয়েছিল। তখন বিআরটিএ প্রকল্পের সংশ্লিষ্টদের নিচের সড়ক সংস্কার করতে বলা হয়। কিন্তু তারা করব, করব বলে এখন পর্যন্ত সড়কগুলো ঠিক করেনি। ফলে আজও বিমানবন্দর সড়ক প্রায় অচল হয়ে পড়েছে।

 

×