ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২

জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস আজ

গ্যাসের চাহিদা মেটাতে কূপ খননের তাগিদ

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:৪৪, ৮ আগস্ট ২০২২

গ্যাসের চাহিদা মেটাতে কূপ খননের তাগিদ

কূপ খননের তাগিদ

বিশ্ববাজারের অস্থিরতার প্রভাবে দেশের জ্বালানি তেলের বাজারেও তৈরি হয়েছে অস্থিরতাব্যর্থ হয়েছে সরকারের সাশ্রয়ী নীতিতাই বাড়ানো হয়েছে ডিজেল, পেট্রোলসহ সব ধরনের জ্বালানি তেলের দামসাশ্রয়ী নীতির নামে দেশজুড়ে অব্যাহত রয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংওএকদিকে তীব্র গরমে লোডশেডিংয়ে যখন দিশেহারা জনজীবন তখন হঠা করে জ্বালানি তেল কিনতে মানুষজনকে গুনতে হচ্ছে অন্তত দ্বগুণ অর্থএমন এক অবস্থায় দেশজুড়ে আজ পালিত হতে যাচ্ছে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস

সরকার নানামুখী আয়োজনে দিবসটি পালন করলেও দেশের ভবিষ্যত নিরাপত্তা নিশ্চিতে উচ্চমূল্যে পরিশোধিত তেল না কিনে বরং দেশের অভ্যন্তরেই পরিশোধনের সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরাশুধু তাই নয়, আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে গ্যাসের চাহিদা মেটাতে দেশের অভ্যন্তরে কূপ খননের তাগিদও তাদেরসরকারের পক্ষ থেকেই বার বার বলা হচ্ছিল দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ সীমিত হয়ে আসছেকিন্তু প্রতিদিনই বাড়ছে গ্যাসের চাহিদাএ চাহিদা মেটাতে উচ্চমূল্যের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে হচ্ছে সরকারকেগ্যাস খাতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রতিবছরই ক্রমান্বয়ে এলএনজির আমদানি বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে

কিন্তু বিশ্ববাজারে উর্ধমুখী আমদানিনির্ভর এ পণ্যটির দাম২০২০-২১ অর্থবছর এলএনজি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকাওই অর্থবছর দেশে এলএনজিবাহী ৭৬টি কার্গো আমদানি করা হয়এসব কার্গো আমদানি ব্যয়, রি-গ্যাসিফিকেশন ব্যয়, ভ্যাট, এআইটি ও পোর্ট চার্জসহ মোট ১৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা খরচ হবেএছাড়া এলএনজি সরবরাহ করতে টার্মিনালের অপারেশন চার্জ বাবদ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে আরও ১৪০ কোটি টাকা দিতে হয়সব মিলিয়ে চলতি বছর এলএনজি আমদানিতে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছি ১৭ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা

কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) তাদের এক প্রতিবেদনে বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রাক্কলিত রাজস্ব চাহিদায় মোট গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ কমেছে, অথচ স্পট মার্কেট থেকে ৮৩ দশমিক ৪৭ টাকা মূল্যহারে  এলএনজি আমদানির পরিমাণ বেড়েছেফলে আর্থিক ঘাটতি চরমে পৌঁছেছে এবং গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির চরম চাপ সৃষ্টি হয়েছেসংস্থাটি বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত গড়ে কম-বেশি ৫০০ এমএমসিএফডি এলএনজি আমদানি করা হয়েছেকিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩১ মার্চ পর্যন্ত গড়ে আমদানি হয়েছে ৬২৯ দশমিক ৭৭ এমএমসিএফডি

তাতে দেখা যায়, স্পট মর্কেটে একদিকে এলএনজির দাম বেড়েছে, অন্যদিকে আমদানিকৃত এলএনজিতে ওই এলএনজির অনুপাতও বেড়েছেচড়া মূল্যে এলএনজি আমদানির এ ধারাবাহিকতায় বর্তমান অর্থবছরে ৩০ জুন পর্যন্ত পেট্রোবাংলা ও বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটার কমিশন (বিইআরসি) টেকনিক্যাল কমিটি উভয়ই গ্যসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেকিন্তু এরই মধ্যে দেশী গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি করেছে আইওসি প্রায় ৫৫ ও বিজিএফসিএল ১৫ এমএমসিএফডি

ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে চুক্তিভিত্তিক প্রতি ঘনমিটার এলএনজি আমদানি ব্যয় ছিল ভারিত গড়ে ২০ দশমিক ৫০ টাকাস্পট মার্কেট এলএনজির ক্ষেত্রে সে ব্যয় ছিল ২৬ দশমিক ১৭ টাকা২০২১-২২ অর্থবছরে উভয় ধরনের এলএনজির ক্ষেত্রে সে ব্যয় হয়েছে যথাক্রমে ৩১ দশমিক ৫৪ ও ৮৩ দশমিক ৪৭ টাকাআমদানি বাজারে এলএনজির মূল্য যখন স্বাভাবিক ছিল তখন পেট্রোবাংলা চুক্তিভিত্তিক এলএনজি আমদানি করেছে ২৮ দশমিক ৮৪ টাকা দরে

এমন অবস্থায় দেশের বর্তমান জ্বালানি সঙ্কটের পেছনে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের চেয়ে প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান না করাই বেশি দায়ী বলে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমামএক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, গত ২০ বছরে বাংলাদেশ মাত্র ২৬টি কূপ খনন করেছে, যা তেল-গ্যাস তথা হাইড্রোকার্বন পাওয়ার উচ্চ সম্ভাবনা আছে এমন দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ জ্বালানি নিরাপত্তায় বাংলাদেশের দুর্বলতাকে উন্মোচন করেছে কেবলএর মূল কারণ গ্যাস অনুসন্ধানের ওপর জোর দেয়ার বদলে ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানির ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতাআজকের এই সঙ্কট হঠা করে আসেনিএটি ধীরলয়ে কিন্তু নিশ্চিতভাবে এসেছেআমরা আগেই বলেছিলাম, এমন একটি সময় আসবে যখন এই ধরনের সঙ্কট দেখা দেবেএত স্বল্পহারে অনুসন্ধান চালিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে জ্বালানি নিরাপত্তা অর্জন করা সম্ভব নয়

তিনি বলেন, ২০১৮ সালের শেষে দিকে সরকার যখন এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়, তখন দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা এর প্রতিবাদ করেছিলেনকারণ এলএনজির দাম প্রায়ই আন্তর্জাতিক বাজারে ওঠানামা করেবিশ্বের সবচেয়ে বড় ব-দ্বীপ বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ অনাবিষ্কৃত গ্যাসসম্পদ আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ৩টি কূপ খনন করলে ১টিতে গ্যাস পাওয়া যায়, যেখানে বৈশ্বিক গড় ৫টি

আমাদের কাছে জরিপ প্রতিবেদন আছে এবং আমরা জানি যে, দেশের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ গ্যাসসম্পদ এখনও অনুসন্ধান করা হয়নিগত দুই দশকেরও বেশি সময় আগে পরিচালিত ২টি গবেষণার বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে ও রাষ্ট্রায়ত্ত পেট্রোবাংলা যৌথভাবে যে জরিপ চালিয়েছিল, তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৩২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাসের সম্ভাব্য মজুদ রয়েছেতার ১ বছর পর নরওয়েজয়ান পেট্রোলিয়াম ডিরেক্টরেট এবং বাংলাদেশের বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আরেক গবেষণায় দেখানো হয়, মজুদ গ্যাসের সম্ভাব্য পরিমাণ ৪২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট

শুধু তাই নয় ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সামুদ্রিক সীমানা নিয়ে ৩ দশকের পুরোনো বিরোধের অবসান হওয়ার পর বঙ্গোপসাগরের ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটারেরও বেশি এলাকার প্রায় চার পঞ্চমাংশের ওপর বাংলাদেশের কর্তৃক প্রতিষ্ঠা পেয়েছেকিন্তু সেখানেও অফশোর অনুসন্ধানের জন্য কোন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়নিভারত ও মিয়ানমার যখন সাগরে তাদের অংশে প্রাকৃতিক গ্যাসের অনুসন্ধান চালাচ্ছে, তখন আমরা ১টি জরিপও পরিচালনা করতে পারিনিতাই সঙ্কট কাটাতে লোডশেডিং বা মূল্যবৃদ্ধি না করে আমাদের মূল জায়গায় ফিরে যেতে হবেএ জন্য সরকারের উচিত সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন করা

জানতে চাইলে বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, নবায়নযোগ্য শক্তি সম্প্রসারণ এবং গ্রিন হাউস গ্যাস কমানোর জন্য বিশ্বব্যাপী প্রয়াসের অংশ হিসেবে সরকার নবায়নযোগ্য উস থেকে বিদ্যুত উপাদন উসাহিত করছেউন্নত দেশগুলো হাইড্রোজেনকে জ্বালানিতে রূপান্তরের জন্য কাজ করছেএখন সামুদ্রিক শক্তি, বায়ুশক্তি এবং ছাদের ওপর সৌর ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা করার সময়তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী পরিবেশসম্মত ও দূষণমুক্ত জ্বালানি ব্যবহারের অভিযানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ এখন সারা দেশে ৬০ লাখ সোলার হোম সিস্টেম (এসএইচএস) স্থাপনের মাধ্যমে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উস থেকে ৭৩০.৬২ মেগাওয়াট বিদ্যুত উপাদন করছে

সরকার সোলার হোম সিস্টেমের মাধ্যমে দুই কোটি প্রান্তিক মানুষকে বিদ্যুতের আওতায় এনেছে এবং দেশে নবায়নযোগ্য শক্তির উস সম্প্রসারণ ও স্থাপনের সরকারী প্রচারণার অংশ হিসেবে ভবিষ্যতে বিদ্যুত উপাদনে নবায়নযোগ্য শক্তির উসের অনুপাত ৪০ শতাংশ হবেতিনি জানান, সৌর সেচ, সৌর মিনি গ্রিড, বায়ুশক্তি, বর্জ্যশক্তি ইত্যাদি থেকে বিদ্যুত উপাদন বাড়ানোর জন্য নতুন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ চলছে

কূপ খনন কাজ জোরদারের পাশাপাশি দেশীয় পরিশোধনের সক্ষমতা বাড়াতে পারলে জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস-২০২২ এর মূল প্রতিপাদ্য বহুমুখী জ্বালানি, সমৃদ্ধ আগামীবাস্তবায়িত হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা

×