চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর
আগামী মাস থেকে চীনের বাজারে বাংলাদেশ ৯৯ শতাংশ পণ্যের শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা পাবে। রফতানি বাড়াতে আরও ১ শতাংশ পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দেশটি। এছাড়া যৌথ সহযোগিতা ও পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের জন্য অভিন্ন ভবিষ্যত প্রত্যাশা করে বাংলাদেশকে পাশে চেয়েছে চীন। এ জন্য তাদের গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভে (জিডিআই) যুক্ত হতে বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিয়েছে দেশটি। কোভিড পরিস্থিতির মধ্যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়ন দেখে বাংলাদেশের প্রশংসা করেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। রবিবার চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেনের দেড় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে এই বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ঘণ্টাখানেক ছিল দ্বিপক্ষীয় আলোচনা। এই সময়ে ৪টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। বৈঠকের পর চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীন একসঙ্গে কাজ করতে পারে। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেন, তার দেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে সমর্থন দেবে এবং একটি কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে তাদের সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে। ২৪ ঘণ্টার সফর শেষে এরপর বেলা পৌনে এগারোটায় ওয়াং ই ঢাকা ত্যাগ করেন।
জানা গেছে, বৈঠকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলটি তাড়াতাড়ি চালুর জন্য বাংলাদেশকে তাগিদ দিয়েছে চীন। এটি চালু করতে বাংলাদেশের তরফ থেকে যথাযথ উদ্যোগ নেয়ার আশ্বাসও দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ বিমান চীনে সরাসরি ফ্লাইট চালু করতে যাচ্ছে এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে চীন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এফডিআই বাড়ানোর জন্য চীনের সঙ্গে একসঙ্গে কাজের অঙ্গীকার করেছে। এছাড়া চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য জোর দাবি তুলে ধরা হয়েছে।
চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-এর ঢাকা সফরের বিষয়ে রবিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। সেখানে তিনি বলেছেন, চীন তাদের গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভে (জিডিআই) যুক্ত হতে বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিয়েছে। চীনের প্রস্তাব বাংলাদেশ খতিয়ে দেখবে বলেও জানান তিনি। ড. মোমেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে দারিদ্র্য দূর করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা দারিদ্র্য দূর করতে চীনের সহায়তা চেয়েছি। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে তারাও লড়াই করছেন। আমরা একযোগে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কাজ করব। এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বিভিন্ন দেশে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নিজ দেশকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়। আর এই বিচ্ছিন্নতায় কোন কোন পক্ষ উস্কে দিচ্ছে। তবে আমরা বলেছি আমরা সব সময় এক চীন নীতিতে বিশ্বাসী। ড. মোমেন বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে চীনের কাছে আমরা সহায়তা চেয়েছি। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছে।
সকালে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সামনের দিনে জয়েন্ট ফিজিবিলিটি ফর পসিবল প্রায়োরিটি বিজনেস বা ট্যারিফ চুক্তি এটা নিয়ে আলোচনার ব্যাপারে সম্মতি আছে। বাংলাদেশের ইকোনমিক জোনে বিশেষ করে আনোয়ারাতে যে চাইনিজ ইকোনমিক জোন তৈরি হচ্ছে, সেখানে অধিক পরিমাণ চীনা কারখানা, প্রযুক্তি স্থানান্তরে সহায়তা করবে দেশটি। এজন্য আগামীতে চীন বাংলাদেশের সঙ্গে একটা পিপিপি কো-অপারেশন এমওইউ সই করতে চায় বলেও বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি রফতানিনির্ভর। দু’দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে চীন আরও ১ শতাংশ বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাংলাদেশ এখন থেকে চীনের বাজারে ৯৯ শতাংশ পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, চীন আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে আরও অতিরিক্ত ১ শতাংশে ডিউটি ফ্রি সুবিধা দেবে। এই অতিরিক্ত ১ শতাংশের মধ্যে আমি মনে করি, বাংলাদেশের বিশেষ করে গার্মেন্টস ও ওভেন পণ্যে কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। আরও বেশি কিছু পণ্যে সীমাবদ্ধতা ছিল।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, বৈঠকে রোহিঙ্গা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে চীন অব্যাহতভাবে কাজ করবে বলে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মোমেন-ওয়াং ই বৈঠকে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের বিস্তারিত আলাপ হয়েছে। এছাড়া মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জগুলোর কারণে শুধু বাংলাদেশ নয়, অনেকেরই সমস্যা হচ্ছে। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে চীন অব্যাহতভাবে কাজ করে যাবে আশ্বাস দেয়া হয়েছে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গা ইস্যুটি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে খুব জোরালোভাবে বলেছেন। তিনি বলেছেন, এটাতে চীনের সহযোগিতা প্রয়োজন। এই সমস্যা সমাধানে তারা বলেছে, সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। শাহরিয়ার আলম জানান, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে তিনি ৫ বছর পর বাংলাদেশে এলেন। এর মধ্যে অর্ধেক সময় কোভিড পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গেছে। তারপরও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানুষের জীবনমান উন্নয়নে অভূতপূর্ব কাজ করে যাচ্ছেন। এটা দেখে চীন আনন্দিত।
বিশ্ব পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, পৃথিবীর প্রতিটি নাগরিকেরই অধিকার আছে একটা ভাল জীবনের। আমাদের সবারই সবচেয়ে বড় শত্রু হওয়া উচিত দারিদ্র্য। তিনি বলেছেন যে, চীনেও একটি বড় অংশে দারিদ্র্য আছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের এক বৈঠকের বরাত দিয়ে তিনি তা বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন, চীন গত কয়েক বছরে ৮০০ মিলিয়ন মানুষকে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকা-ের মাধ্যমে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছে। বাংলাদেশও সেই কাজটি করছে। অর্থনীতি ও মানুষের জীবনযাত্রার মানউন্নয়নের জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে যাওয়া প্রতিটি নাগরিকের বা প্রতিটি দেশের অধিকার।
তিনি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নাম উল্লেখ করে বলেছেন, তাদের ৯৬ মিলিয়ন সক্রিয় সদস্য আছে। তারা ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন নাগরিককে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। তার মতে, তাদের মধ্যে তেমন উল্লেখযোগ্য মতপার্থক্য নেই। কারণ তাদের লক্ষ্য একই। তা হলো : রিভাইটালাইজিং দ্য চাইনিজ ইকোনমি এবং সবার জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধি।
তিনি বলেছেন যে, কিছু রাষ্ট্র আছে যারা ভুল বোঝে বা মিস ইন্টারপ্রেট করে। সে বিষয়ে কিছুটা কথা হয়েছে। ‘এক চীন নীতি’র প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করায় বাংলাদেশকে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ধন্যবাদ জানান। তিনি আরও বলেছেন যে, বাংলাদেশের ইকোনমিক জোনে বিশেষ করে চট্টগ্রামে যে ইপিজেডটি তৈরি হচ্ছে সেখানে অধিক পরিমাণে চাইনিজ কারখানা ও প্রযুক্তি শিফট করতে তারা সহযোগিতা করবেন। সামনের দিনে তারা একটা পিপিপি কো-অপারেশন সমঝোতা চুক্তি করতে চান।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানান, বিশেষ অর্থনীতি অঞ্চল খুব তাড়াতাড়ি চালু করার তাগাদা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশের তরফ থেকে যেন ব্যবস্থা নেয়া হয়। সরাসরি ফ্লাইট চালুর বিষয়টিকে তিনি স্বাগত জানিয়েছেন। এর ফলে ২ দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বাড়বে। এটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুবই জরুরী।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেনের বক্তব্য সম্পর্কে শাহরিয়ার আলম বলেছেন, এত ব্যস্ততার মধ্যে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফরের জন্য তাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। আগামীতে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ আরও বাড়ানোর জন্য একসঙ্গে কাজ করা হবে। বাংলাদেশ বা শেখ হাসিনার সরকারের তরফ থেকে পররাষ্ট্র মোমেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর বিষয়ে তিনি বলেছেন। এটা একটা বড় ইস্যু। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিস্তারিত আলাপ হয়েছে। চীন বলেছে যে তারা চেষ্টা করছে। মিয়ানমারের যে অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জগুলো তাতে শুধু বাংলাদেশের নয়, অনেক দেশের সমস্যা হচ্ছে। রোহিঙ্গা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে চীন অব্যাহতভাবে কাজ করে যাবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোরালোভাবে বলেছেন যে, চীনের সহযোগিতা প্রয়োজন। সমস্যা সমাধানের চেষ্টা অনেক দূর এগিয়ে ছিল। এর ধারাবাহিকতা দরকার। রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। তারা বলেছে, চীন সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
এর আগে দুদিনের সফরে শনিবার বিকেল ৫টায় ঢাকায় আসেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।