গাজী আনিস
হেনোলাক্স গ্রুপে বিনিয়োগ করা ১ কোটি ২৪ লাখ টাকা ফেরত পেতে মৃত্যুর আগে থানা পুলিশ থেকে শুরু করে আদালতের দ্বারস্থ হয়েও না পেয়ে নিজ গায়ে আগুন দেয়া ব্যবসায়ী গাজী আনিস (৫০) মারা গেছেন। মঙ্গলবার সকাল ৬টায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে বার্ন ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডাঃ সামন্ত লাল সেন জানান, আনিসের শরীরের ৯০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল। অবস্থা শঙ্কটপন্ন হওয়ায় রাতেই তাকে আইসিইউতে নিয়ে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। সকালের দিকে তার মৃত্যু হয়।
গাজী আনিসের এই মৃত্যুকে পরিকল্পিত হত্যাকা- বলে দাবি করেছেন তার স্বজনরা। তারা বলছেন, হেনোলাক্স কোম্পানি ১ কোটি ২৪ লাখ টাকা আত্মসাত করায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেন গাজী আনিস। এই হত্যার পেছনে হেনোলাক্স কোম্পানির মালিক নুরুল আমিন ও তার স্ত্রী জড়িত। এ ঘটনায় মঙ্গলবার দুপুরেই গাজী আনিসের ভাই নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে হেনোলাক্স গ্রুপের মালিক নুরুল আমিন এবং তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন। আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে মামলাটি দায়ের করা হয়।
মামলা দায়েরের পর রাত ৮টার দিকে নুরুল আমিন এবং তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-৩। তবে আনিসের মৃত্যুর ঘটনায় দোষীদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। এর আগে সোমবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে নিজ গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন গাজী আনিস। পরে শাহবাগ থানা পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করায়।
র্যাব সদর দফতরের মিডিয়া উইংয়ের সহকারী পরিচালক ইমরান হোসেন জানান, মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে উত্তরা থেকে হেনোলাক্স গ্রুপের মালিক নুরুল আমিন এবং তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ বিষয়ে আজ বুধবার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানানো হবে। তবে এর তাদের গ্রেফতারে অভিযান চালায় শাহবাগ থানা পুলিশ। কয়েকটি স্থানে অভিযান পরিচালনা করেও তাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে শাহবাগ থানা পুলিশ।
মৃতের ভাই নজরুল ইসলাম জানান, আনিসের গাড়ি ও পানির পাম্পের ব্যবসা ছিল। সেসব ব্যবসা গুটিয়ে হেনোলাক্স কোম্পানির চেয়ারম্যান ডাঃ নুরুল আমিন ও তার স্ত্রী ডাঃ ফাতেমা আমিনের কথা অনুযায়ী ১ কোটি ২৪ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। লাভসহ পৌনে ৩ কোটি টাকা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা টাকা তো দিচ্ছিল না, উল্টো হয়রানি করছিল। নুরুল আমিন টাকা দিবে বলে জানিয়েছে। তাই গত ২৬ তারিখে আনিস ঢাকায় আসেন। কিন্তু নুরুল আমিন টাকা দেয়নি। তাই সবশেষ এ ঘটনা ঘটান আনিস।
নজরুল ইসলাম বলেন, টাকা পেতে আমার ভাই কুষ্টিয়া আমলি আদালতে নুরুল আমিন ও তার স্ত্রীকে আসামি করে দুটি মামলা দায়ের করেন। যা বিচারাধীন রয়েছে। গত ৩১ মে তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। কিন্তু কোন ফল না পেয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। তাই গাজী আনিসের মৃত্যুর জন্য হেনোলাক্স কোম্পানির নুরুল আমিন ও তার স্ত্রী দায়ী। অবিলম্বে নুরুল আমিন ও তার স্ত্রীর ফাঁসি দাবি করছি।
প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের দিন হেনোলাক্স গ্রুপের কাছ থেকে টাকা পাওয়া নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাস্টাস দেন গাজী আনিস। তিনি উল্লেখ করেন, ২০১৬ সঙ্গে হেনোলাক্স গ্রুপের কর্ণধার মোঃ নুরুল আমিন এবং তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ধীরে ধীরে তাদের সঙ্গে আমার সখ্য এবং আন্তরিকতা গড়ে উঠে। কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় এলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ, উপহার বিনিময়, ভাল রেস্তরাঁয় খাওয়া ও বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যেতাম। তাদের সঙ্গে একাধিকবার নিজ খরচে বিদেশে বেড়াতেও গিয়েছি।
২০১৮ সালে কলকাতা হোটেল বালাজীতে একই সঙ্গে অবস্থানকালে নুরুল আমিন ও ফাতেমা আমিন হেনোলাক্স গ্রুপে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয় এবং যথেষ্ট লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে বলে জানায়। এতে প্রথমে ১ কোটি টাকা পরে আরও ২৪ লাখ টাকা বিনিয়োগ করি। প্রাথমিক চুক্তি করা হলেও তাদের অনুরোধে চূড়ান্ত রেজিস্ট্রি চুক্তি করা হয়নি। বিনিয়োগ পরবর্তী চূড়ান্ত রেজিস্ট্রি চুক্তিপত্র সম্পাদন করার জন্য বারবার অনুরোধ করলেও নুরুল আমিন ও তার স্ত্রী গড়িমসি করতে থাকে।
তারা প্রতিমাসে যে লভ্যাংশ প্রদান করত সেটাও বন্ধ করে দেয় এবং টাকা চাওয়ায় কয়েকবার লোকজন দিয়ে হেনস্তা ও ব্ল্যাকমেইল করে। বর্তমানে লভ্যাংশসহ আমার ন্যায্য পাওনা ৩ কোটি টাকার অধিক উল্লেখ করেন তিনি। এ ঘটনায় তিনি প্রধানমন্ত্রীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনাও করেছিলেন। কিন্তু কোন মতেই তিনি সুরাহা পাননি। তাই নিজেই নিজেকে হত্যা করেন।
এ ঘটনায় হেনোলাক্স গ্রুপের মালিকদের বিচার চেয়ে মঙ্গলবার বেলা আড়াইটায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। গাজী আনিসের মামাতো ভাই তানভীর ইমামের নেতৃত্বে আয়োজিত মানববন্ধনে তারা এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন।
তানভীর ইমাম বলেন, আমার ভাই কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। হেনোলাক্স কোম্পানিকে দেয়া টাকা পেতে আমার ভাই মামলা করেও টাকা ফেরত পাননি। এতে তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। টাকা পেতে বহু জায়গায় ঘুরেছেন। কিন্তু কোন সুরাহা পাননি। তাই হতাশা থেকে আত্মহত্যা করেছেন তিনি।
এদিকে আনিসের মৃত্যুর ঘটনায় দোষীদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। আনিসের মৃত্যুর খবরে মঙ্গলবার সকালে বার্ন ইনস্টিটিউটে গিয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, তার যে সমস্যা তা স্থানীয় এমপি, চেয়ারম্যান কারোর সঙ্গে শেয়ার করেননি। জানলে আমরা অবশ্যই একটা ব্যবস্থা নিতাম। এই মৃত্যুর পিছনে যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে মামলার মাধ্যমে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুদ হাওলাদার বলেন, এ ঘটনায় মৃতের ভাই বাদী হয়ে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ এনে হেনোলাক্স গ্রুপের মালিক ও তার স্ত্রীকে আসামি করি মামলা করেছেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এদিকে মঙ্গলবার বিকেলে গাজী আনিসের মরহেদ ময়নাতদন্ত শেষে গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী নিজ বাড়িতে নিয়ে যান স্বজনরা। গাজী আনিস স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে যশোরে থাকতেন জানিয়ে তার ভাতিজা শাহবুব আলম বলেন, বড় মেয়ে মেধা রহমান আঁচল এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী। মেঝো মেয়ে প্রতিভা রহমান অহনা এসএসসি পরীক্ষার্থী এবং ছোট মেয়ে জয়িতা রহমান অবনী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত।
গাজী আনিস নিজ গায়ে আগুন দেয়ার খবর পাওয়ার পরপরই তারা বাবার জন্য কেঁদেই যাচ্ছেন। তাদের ঢাকায় আনা হয়নি। মৃত্যুর সংবাদও শোনানো হয়নি। তবে তারা খবর দেখে জেনেছেন। এরপর থেকেই বাবার শোকে কেঁদেই যাচ্ছেন।
দাফন সম্পন্ন ॥ এদিকে কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও ব্যবসায়ী গাজী আনিসুর রহমানের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। মঙ্গলবার রাত ১১টা ২০ মিনিটের দিকে জানাজা শেষে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার পান্টি ইউনিয়নের পান্টি কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।