ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

পিজিআরের ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ভাষণ

তেল-গ্যাস-বিদ্যুতে সাশ্রয়ী হোন ॥ প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২২:৫৭, ৫ জুলাই ২০২২

তেল-গ্যাস-বিদ্যুতে সাশ্রয়ী হোন ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় বিদ্যুত ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার পাশাপাশি সকলকে সঞ্চয় করার এবং দেশব্যাপী খাদ্য উপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে যে কোন সঙ্কট মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেনতিনি বলেন, আমাদের শুরু থেকেই সতর্ক থাকতে হবেআমরা যদি সাবধানে এগিয়ে যাই, ইনশাআল্লাহ আমাদের কোন সমস্যা হবে না, এটা আমার বিশ্বাস

মঙ্গলবার প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের (পিজিআর) ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারাবিশ্বেই তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছেএখন আন্তর্জাতিক বাজারে বিদ্যুত উপাদনের উপকরণগুলোর দাম অত্যধিক বেড়েছেঅনেক দেশেই এখন বিদ্যুতের জন্য হাহাকার তৈরি হয়েছেঅনেক উন্নত দেশেও কিন্তু দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে গেছেকাজেই আমাদের শুরু থেকেই সতর্ক থাকতে হবে

প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঢাকা সেনানিবাসের পিজিআর সদর দফতরের অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হনপ্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন পিজিআর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ জাহাঙ্গীর আলম

করোনাভাইরাস এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মুদ্রাস্ফীতির ক্রমবর্ধমান প্রবণতা, বিদ্যুতের অভাব এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্য সঙ্কটের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চলমান করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য আমেরিকা, ইংল্যান্ড, গ্রেট ব্রিটেনের মতো উন্নত দেশগুলোসহ বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছেপাশাপাশি কয়লা না পাওয়া এবং গ্যাস ও ডিজেলের মতো বিদ্যুত উপাদনকারী উপাদানের অব্যাহত মূল্য বৃদ্ধির কারণে সেখানেও এখন তীব্র বিদ্যুত সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছেযুদ্ধের কারণে নিয়মিত জাহাজ চলাচল না করায় বিশ্ব বর্তমানে পরিবহন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, পরিবহন ব্যয় অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে

সরকারপ্রধান বলেন, বিদ্যুতকেন্দ্রে বিদ্যুত উপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানির ব্যবহার কমাতে এলাকাভিত্তিক নির্দিষ্ট সময়ের লোডশেডিং করে বিদ্যুতের ব্যবহার কিছুটা কমানো যায় কি-না সে চিন্তাও করছেন তিনিতবে সে ক্ষেত্রে আকস্মিক নয়, মানুষকে প্রস্তুত থাকার সময়টা দিয়েই তা করা যেতে পারেতিনি বলেন, বিদ্যুতের ব্যাপারে আমাদের শুধু সাশ্রয়ীই হলে হবে না, আমি যেমন চিন্তা করেছি কিছুটা সময় বিদ্যুত উপাদন একটু কমিয়ে দিয়ে বিদ্যুত উপাদনের যে উপাদানগুলো সেগুলো যেন আমরা কম ব্যয় করতে পারি

বিএনপি-জামায়াতের আমলে দেশবাসী প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা লোডশেডিং প্রত্যক্ষ করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন বিশ^ পরিস্থিতির কারণে সঙ্কট উত্তরণে এলাকা ভিত্তিক কিছুটা লোডশেডিং করা লাগতে পারেএখন আমরা একটা সুনির্দিষ্ট সময় যদি ধরে দেই যে, একেক এলাকাভিত্তিক কিছুক্ষণের জন্য সেখানে বিদ্যুতের কিছুটা লোড শেডিং হবে, হঠা যাবে হঠা আসবে না, যাতে মানুষ প্রস্তুতি নিতে পারবে, সেভাবেই আমাদের কিছু কিছু পদক্ষেপ এখন থেকেই যদি আমরা নিই, তাহলে আগামী দিনে যে আরও সমস্যাটা দেখা দিতে পারে, সেটার থেকে আমরা নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারব

অনেক উন্নত দেশে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছেউল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রতিইঞ্চি জমি এবং জলাশয়কে কাজে লাগানোর মাধ্যমে খাদ্য উপাদন বৃদ্ধির জন্য ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে সকলের প্রতি আহ্বান জানানতিনি বলেন, সে ক্ষেত্রে আমরা যদি সাশ্রয়ী হয়ে উঠি এবং আমাদের সঞ্চয় বাড়াই তাহলে যে কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারবতার সরকার প্রতিটি ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দিয়েছে এবং দেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে প্রতিটি গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষকে ঘরবাড়ি করে দিচ্ছে

সবার ঘরে সরকার বিদ্যুত পৌঁছে দিয়েছিল এবং সবাই নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুত পাচ্ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন আন্তর্জাতিক বাজারে বিদ্যুত উপাদনের উপকরণগুলোর দাম অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে, অনেক দেশে এখন বিদ্যুতের জন্য হাহাকারসরকার আর ভর্তুকি দিয়ে কূলাতে পারছে নাপ্রত্যেকটা পরিবার, প্রত্যেকটা মানুষ এবং প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠান ন্যূনতম খাদ্য উপাদনের পদক্ষেপও যদি নেয়, তাহলে এই যে বিশ্বব্যাপী যে মন্দাটা, এর অভিঘাত থেকে আমরা নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারবকেননা, আমাদের মাটি ও মানুষ আছে, আর এই মাটি অত্যন্ত উর্বর এবং সে কথা জাতির পিতাই আমাদের বলে গেছেন

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশকে যারা হেয় প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিল বা আমাকে, আমার পরিবারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করে এবং আমার মন্ত্রিসভার মন্ত্রী, সচিব, উপদেষ্টাকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করে যারা অসম্মান করতে চেয়েছিল, তাদের উপযুক্ত জবাব আমরা দিয়েছি, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমেতাই পদ্মা সেতু শুধু একটা সেতুই নয়, আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং আমাদের স্বতন্ত্র  জাতিসত্তারও বহির্প্রকাশ

পঁচাত্তর পরবর্তী দেশে একের পর ক্যু-পাল্টা ক্যুর ঘটনার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যার পর বাংলাদেশের যারা স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী যাদের বিচারকার্য শুরু হয়েছিল, তাদেরই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসানো হয়েতা ছাড়া জাতির পিতার হত্যাকারীদের ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্স জারি করে বিচারের হাত থেকে মুক্তি দেয়া হয়বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে তাদের পুরস্কৃত করা হয়

তিনি বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ক্ষমতায় থাকার কারণেই এই সেনাবাহিনীতে ১৯ বারের মতো ক্যু হয় এবং বহু সেনা সদস্য, সৈনিক, অফিসার মৃত্যুবরণ করেনএমন একটা সময় ছিল, যখন অফিসারদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হামলা করা হয়েছেঅনেকের স্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে, পরিবারকে হত্যা করা হয়েছেএ রকমও ঘটনা তখন ঘটতে থাকে একের পর একপ্রতিরাতে বাংলাদেশে কার্ফু চলতমানুষের কোন অধিকারই ছিল নামানুষ স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারত নাএ রকম একটা পরিবেশ বাংলাদেশে ছিল

বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ২১ বছর পর ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেপঁচাত্তরে আমি ও আমার ছোট বোন বিদেশে ছিলাম১৯৮১ সালে আমাকে দেশে ফিরতে দেয়া হয়নিঅনেকটা জোর করেই দেশে ফিরতে হয়েছিলযেখানে খুনীদের রাজত্ব, যেখানে অপরাধীদের রাজত্ব; আমি জানতাম যে কোন সময় তারা আমাকে মারতে পারেআমি সেটা পরোয়া করিনি।  মানুষের জন্য ফিরে আসিআসার পর থেকে আমার লক্ষ্য ছিল, এক দিকে যেমন বাংলাদেশের মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা, পাশাপাশি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ যেখানে আমার বাবা নিজের হাতে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী গড়ে তুলে গেছেন; সেগুলো যাতে আরও উন্নত হয় সেদিকে দৃষ্টি দেয়া

সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়ন ও উন্নয়নে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেয়া নানা পদক্ষেপ তুলে ধরার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকারের নেয়া নানা উদ্যোগের কথাও জানান সরকারপ্রধানপ্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি প্রথম ১৯৯৮ সালে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজএবং মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজিপ্রতিষ্ঠা করেন১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিংএবং আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজপ্রতিষ্ঠা করেন এবং আওয়ামী লীগ সরকারই প্রথম ২০০০ সালে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীতে নারী অফিসার নিয়োগ প্রদান করে২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর বাংলাদেশকে আর্থ-সামাজিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা প্রণীত ১৯৭৪ সালের প্রতিরক্ষা নীতিমালার আলোকে আমরা ফোর্সেস গোল-২০৩০প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন শুরু করে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীকে আরও আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর করে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিয়েছি

তিনি বলেন, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পিস বিল্ডিং সেন্টারপ্রতিষ্ঠা করেছিজাতীয় প্রতিরক্ষানীতি-২০১৮প্রণয়ন, এ্যারোস্পেস ও এভিয়েশন বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং সিএমএইচগুলোকে অত্যাধুনিক হাসপাতালে রূপান্তর করাসহ পিজিআর সদস্যদের জন্য ঝুঁকিভাতা প্রবর্তন এবং আবাসনের বন্দোবস্তোসহ বিভিন্ন কল্যাণমূলক পদক্ষেপের উল্লেখ করেন তিনি

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা কারও সঙ্গে যুদ্ধ করব নাআমরা শান্তি চাই এবং জাতির পিতা আমাদের যে প্রতিরক্ষা নীতিমালা দিয়েছেন- সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়,’ আমরা সেই নীতিই মেনে চলছিকিন্তু একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আমাদের যেন সমস্ত রকম প্রস্তুতি থাকে এবং বিশেষ করে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার যেগুলো প্রতীক, সেগুলো যেন যথাযথভাবে গড়ে ওঠে, আমরা তার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছি এবং বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। 

প্রধানমন্ত্রী এ সময় রোদ, ঝড়, বৃষ্টি মাথায় করে পিজিআর সদস্যদের দায়িত্ব পালনেরও ভূয়সী প্রশংসা করেনতিনি বলেন, ‘নিñিদ্র নিরাপত্তাই গার্ডসের লক্ষ্যএই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে রেজিমেন্টের সদস্যগণ সাহস, আন্তরিকতা, পেশাগত দক্ষতা, সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা এবং দেশপ্রেমের শপথে বলীয়ান হয়ে দায়িত্ব পালন করবেকর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার, নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং পেশাগত অনুশীলনের মাধ্যমেই এই রেজিমেন্ট আগামীতে আরও সমৃদ্ধ হবে

×