
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন আজীবন সম্মাননা-২০২২
শখের হাঁড়িতে শিল্পিত রূপ দেয়া এক কারিগর সুশান্ত কুমার পাল। রকমারি আল্পনাসহ লোকজ বাংলার নানা অনুষঙ্গে রাঙিয়ে তোলেন শখের হাঁড়ি। বংশপরম্পরায় করে মাটির গড়া হাঁড়ির শরীরে মেলে ধরেন শিল্পের সৌকর্য। বাংলার লোকজ ঐতিহ্যকে লালন করা ৫৫ বছরের সেই কর্মজীবনের স্বীকৃতি পেলেন রাজশাহীর এই কারুশিল্পী। তাকে প্রদান করা হলো শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন আজীবন সম্মাননা-২০২২। আর শুধু সুশান্ত পাল নয়, যুগের পর যুগ ধরে কারশিল্পের নানা শাখায় নিয়োজিত শিল্পীদের জানানো হলো সম্মাননা। বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তিন কারুশিল্পীকে প্রদান করা হলো লোক ও কারুশিল্পী পদক। শুধু কি তাই কি তাই? কারুশিল্পের প্রসারে ভূমিকা রাখা দুই উদ্যোক্তাকে প্রদান করা হলো লোক ও কারুশিল্প উদ্যোক্তার পুরস্কার। বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রথমবারের মতো এই সম্মাননা ও পদক প্রদান করা হলো। বৃহস্পতিবার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার সেমিনার কক্ষে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। একই অনুষ্ঠানে লোক ও কারুশিল্পের সংবাদ প্রচারে ভূমিকা রাখার কারণে দুই সাংবাদিককে মিডিয়া ফেলোশিপ পুরস্কার দেয়া দেয়া হয়।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সম্মাননাপ্রাপ্ত সুশান্ত কুমার পালকে সম্মানী হিসেবে ৩ লাখ টাকা প্রদান করা হয়। সেইসঙ্গে দেড় ভরি ওজনের স্বর্ণপদক ও সনদপত্র প্রদান করা হয় এই কারুশিল্পীকে। দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে রূপার অলংকারে কারুকাজ করা বগুড়ার কারুশিল্পী মিলন হোসেনকে প্রদান করা হয় লোক ও কারুশিল্পী পদক। একই পদক পেয়েছেন দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে সুজনিকাঁথা তৈরি করা ঢাকার কদমতলীর কারুশিল্পী পারভিন আক্তার। এছাড়াও এই পুরস্কার পেয়েছেন চার দশকের বেশি সময় অর্থাৎ ৪২ বছর ধরে আল্পনা আঁকা চাঁপাইনবগঞ্জের দেখন বালা বর্মণ। এই তিন কারুশিল্পীকে সম্মানী হিসেবে এক লাখ টাকা এবং এক ভরি ওজনের সোনার মেডেল দেয়া হয়। লোক ও কারুশিল্প উদ্যোক্তা পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলো তরুণ কুমার পাল ও আফসানা আসিফ। এই দুই উদ্যোক্তাকেও একই সম্মানী ও স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। মিডিয়া ফেলোশিপ পুরস্কারপ্রাপ্ত দুই সাংবাদিক হলেন ডিবিসি নিউজের তাহসিনা সাদেক এবং দেশ রূপান্তরের রবিউল হুসাইন মোল্লা।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ আবুল মনসুর। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন। বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক ড. আহমেদ উল্লাহর সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সাবিহা পারভীন। উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল।
দেশের কারুশিল্প রক্ষার তাগিদ দিয়ে মোঃ আবুল মনসুর বলেন, বহির্বিশ্বে আমাদের কারুশিল্পের ব্যাপক সমদার রয়েছে। অথচ বিশ্ব ঐতিহ্য নিয়ে ইউনেস্কো নানামুখী কাজ করলেও নিজস্ব এই ঐতিহ্য নিয়ে দেশে সেভাবে কাজ হয়নি। কারুশিল্পের সঙ্গে প্রাকৃতিক বিষয়টি সম্পৃক্ত থাকায় এটির চাকচিক্য কম বলে আমাদের আগ্রহও কম। কিন্তু জাতিগত এই ঐতিহ্যের বিষয়ে সচেতন হতে হবে। এই পদক প্রদানের মাধ্যমে ঐতিহ্যকে রক্ষার পাশাপাশি সচেতনতা সৃষ্টির একটি উদাহরণ তৈরি হলো।
নিসার হোসেন বলেন, এখনও দুনিয়াজুড়ে জাতিগত যেসব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি পৃথিবীকে আলোড়িত করে চলেছে দেখা গেছে তার প্রতিটিই হাজার বছরের পুরনো। ঐতিহ্য যত পুরনো হয় তত বেশি সমৃদ্ধ হয়। ১৮৮৮ সালেও এদেশের শখের হাঁড়ির প্রদর্শনের তথ্য পাওয়া যায়। সেই সুবাদে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান্তরালে সাংস্কৃতিক কিংবা ঐতিহ্যগত সমৃদ্ধির কথা বলেছেন জয়নুল আবেদিন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ছাড়া শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে জাতির মানসিক বিকাশ ঘটে না। এই বাস্তবতায় দেশের লোকজ ঐতিহ্যের দিকে নজর দিতে হবে। এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে সুশান্ত কুমার পাল যদি শখের হাঁড়ি তৈরি বন্ধ করে দেন তাহলে এই কারুশিল্পের পথচলা থমকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ বর্তমানে দেশের একমাত্র এই পরিবারটিই শখের হাঁড়ি নির্মাণ করছে। অথচ একসময় পুরো ভারতবর্ষে প্রতিনিধিত্ব করত আমাদের চিত্রিত মৃৎপাত্র। এমনকি পটুয়া কামরুল হাসানও শিল্পকর্ম সৃজনে শখের হাঁড়ির অনেক মোটিফ খুঁজে নিয়েছেন। তাই এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
সাবিহা পারভীন বলেন, আমাদের প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে লোক ও কারুশিল্প। এটা আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। এছাড়া অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক সমৃদ্ধ এদেশের কারুশিল্প।