ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ১০:২৫, ২৬ জুলাই ২০১৯

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

একটা অস্থির সময়। নিজের চারপাশটাকে ঠিক চেনা যাচ্ছে না। সংশয়। সন্দেহ। গুজব। আতঙ্ক। হঠাৎ কেমন যেন কামড়ে ধরেছে। বদলে যাচ্ছে চেনা জগৎ। মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে এত কথা হয়, আজ সেই মূল্যবোধের ক্ষয়ই দেখতে হচ্ছে শুধু। রাজধানী শহর ঢাকার মানুষ তো অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত। সচেতন। এই তাহলে শিক্ষা-দীক্ষার পরিচয়? সচেতন যে বলা হয়, সচেতনতার এ কোন্ নমুনা আমরা দেখছি? অনেক প্রশ্ন। গত কয়েকদিনের ঘটনাবলি এসব প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মানুষ হওয়ার অযুত আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে এ শহরের অনেকেই দানব হয়ে উঠছেন। প্রকাশ্যে পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলছে আরেক মানুষকে। হাত এতটুকু কাঁপছে না। ধার ধারছে না বিচার বিবেচনার। তাই মধ্যযুগীয় বর্বরতা দেখতে হচ্ছে আমাদের। মানুষ হওয়ার মানদন্ডে আমরা কোথায়, তা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেলেন তাসলিমা বেগম রেণু। সম্পূর্ণ নির্দোষ এই নারী সমাজের নির্দয় নিষ্ঠুর আচরণের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। প্রকাশ্যে সবার চোখের সামনে পিটিয়ে মারা হয়েছে তাকে। শাপকেও এভাবে পিটিয়ে মারা হয় না, উফ, কী বীভৎস সে ছবি! তার চেয়েও ভয়ঙ্কর তথ্য এই যে, মহা অন্যায় ক্ষমাহীন অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সম্মিলিত শক্তি দ্বারা। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে? গত শনিবারের ঘটনা। রেণু গিয়েছিলেন বাড্ডা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। ট্রাডিশনাল বাঙালী মা। দুই সন্তানের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তাদের ভর্তি বিষয়ে খোঁজ নিতে স্কুলটিতে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কে জানত রাজধানীর একটি বিদ্যাপীঠ তার জন্য কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প হয়ে যাবে? তাই হলো। এক অভিভাবকের মনে হলো রেণু ছেলেধরা। মনে করাই যথেষ্ট। চিৎকার শুরু করে লোক জড়ো করলেন তিনি। গুজবে কান দিলেন বেকার বিকারগ্রস্তরাও। তারা রেণুকে ঘিরে ধরে এই প্রশ্ন ওই প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। উত্তর শোনা হলো কি হলো না। তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেন- রেণু ছেলেধরা! অমনি শুরু হয়ে গেল টানা-হেঁচড়া। আক্রান্ত নারীকে নিয়ে যাওয়া হলো প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে। ততক্ষণে বাইরে জড়ো হওয়া পাষন্ডরা দলে ভারি হয়েছে। সংখ্যায় একশ’র বেশি। প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে ঢুকে রেণুকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা নারীকে বিদ্যালয় ভবনের দুই তলা থেকে চুল ধরে টেনে নিচে নামালো এক সবজি বিক্রেতা। সন্তানের ভবিষ্যত ভাবনায় অস্থির অসহায় মায়ের মাথা হাতে উঁচু করে আছাড় দেয়া হলো মেঝেতে। ঘাতকদেরই একজনের মুখে থেকে এমন বর্ণনা শোনা গেছে। এবং কী আশ্চর্য, মূল ঘাতকটির নাম হৃদয়! আজ কি তাহলে হৃদয়ের অর্থও বদলে গেল? মান্না দে গেয়েছিলেন, ‘হৃদয় আছে যার সেই তো ভালবাসে...।’ গানটি আজ কি মিথ্যা হতে চলেছে?। ভূপেন হাজারিকা গেয়েছিলেন, মানুষ যদি সে না হয় মানুষ/দানব কখনো হয় না মানুষ/যদি দানব কখনো বা হয় মানুষ/লজ্জা কি তুমি পাবে না ও বন্ধু...। বন্ধুজন আপনারা কি লজ্জা পাচ্ছেন? এদিকে ক্রমেই ডালপালা মেলছে গুজব। নানা ধরনের গালগল্প ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। আতঙ্ক তৈরির চেষ্টা মোটামুটি স্পষ্ট। সবই যে সচেতনভাবে করা হচ্ছে তা হয়ত নয়। তবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির একটি পাঁয়তারাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ অবস্থায় সকলকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। এর অংশ হিসেবে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে মাইকিং করতেও দেখা যাচ্ছে। পুলিশের পক্ষ থেকে গুজবে কান না দেয়া ও গুজব সৃষ্টিকারীদের ধরিয়ে দেয়ার অনুরোধ জানানো হচ্ছে নগরবাসীকে। বুধবার সূত্রাপুর এলাকায় দৃশ্যটি দেখে মনে হচ্ছিল, শহর ঢাকায় এত সবজান্তা, জ্ঞানী গুণী, তারপরও ভেতরে ভেতরে এত দেউলিয়াত্ব কেন? নিজের বিচার বিবেচনা মুড়িঘণ্ট করে খেয়ে কী সুন্দর ফেসবুকে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে একদল লোক। রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতি সব তারা বুঝেন। শুধু নিজেকে বুঝতে ব্যর্থ! আফসোস। ডেঙ্গুর কথায় আসা যাক। মশাবাহিত এই রোগ ঢাকায় প্রথম দেখা দিয়েছিল ২০০০ সালে। এরপর থেকে কম বেশি আছে। তবে বর্তমান অবস্থা ভয়ঙ্কর। মশার সঙ্গে একসময় নগর-পিতা যুদ্ধ করেছেন। এখন পুত্রটি। কিন্তু সাফল্য নেই। টেলিভিশন স্ক্রিনে সাঈদ খোকন আছেন। কথাও বলছেন ডেঙ্গু নিয়ে। অবশ্য এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা কত তা নিয়ে তার বিশেষ মাথাব্যথা বলেই মনে হচ্ছে। সংখ্যা নিয়ে বাহাস করতেও দেখা যাচ্ছে তাকে। কাজের কী হলো? না, দক্ষিণের মেয়রের কাছে তেমন কোন উত্তর নেই। উত্তরে আছেন আতিকুল। তিনিও দু’হাতে মশা মেরে চলেছেন। এরপরও গোটা রাজধানী দখলে নিয়েছে এডিস মশা। ফলাফল- ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বেড়েই চলেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, বুধবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৫৬০ জন ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ঢাকায়? ৫৫৯ জন! স্মরণ করিয়ে দেয়া ভাল, গত জুন থেকেই ডেঙ্গু জ্বরের খবর আসছিল। মশাবাহিত এ রোগে বেশ কিছু মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু সতর্কতামূলক কর্মকান্ড চলেছে ঢিমেতালে। এমনকি এ পর্যায়ে এসে জানা যাচ্ছে, এতদিন ধরে ছিটানো মশার ওষুধ কাজে আসছে না। বিদেশ থেকে মশা মারার কার্যকর ওষুধ আনা হবে! ঘটনার ঘনঘটার মাঝে ঢাকার রাস্তায় বোমা পেতে রাখার উদ্বেগজনক ঘটনাও ঘটেছে। গত মঙ্গলবার রাতে খামারবাড়ি ও পল্টন এলাকা থেকে দুটি বোমা উদ্ধার করা হয়। পুলিশ চেকপোস্টের কাছে বোমাগুলো রাখা ছিল। অনুমান করা যায়- প্রাথমিক টার্গেট আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রাস্তার ধারে পেতে রাখা বোমায় সাধারণ মানুষের হতাহত হওয়ার আশঙ্কাও ছিল। নগরবাসীর ভাগ্য ভাল বলতে হবে, কোন ধরনের ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু ঘটতে কতক্ষণ? তাই বোমার উৎস অনুসন্ধান ও জড়িতদের খুঁজে বের করার জোর দাবি উঠেছে। ঢাকার সচেতন মানুষ মাত্রই মনে করছেন, এভাবে বোমা পেতে রাখার ঘটনা অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। আগের কিছু ঘটনার সঙ্গে এ ঘটনার যোগসূত্র আছে। যারা সমাজ রাষ্ট্র ও সরকারকে নড়বড়ে করতে চায় তারাই নতুন করে ফনা তুলার চেষ্টা করছে বলেই অনুমান। তবে প্রকৃত সত্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেই বের করতে হবে। যত দ্রুত বের করা যাবে ততই মঙ্গল।
×