
ওয়াজেদ হীরা ॥ দেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল। অন্যতম পুষ্টিকর এই ফলকে বলা হয় মাংসের বিকল্প। বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে কাঁঠালের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকলেও দেশে মৌসুম ব্যতীত অন্য সময় খুব একটা দেখা যায় না। ভারতের পরই কাঁঠাল উৎপাদনের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও আঠা বেশির কারণে ভারত-বাংলাদেশের কাঁঠালে আগ্রহ কম আমদানিকারক দেশগুলোর। তবে বিভিন্ন গবেষণার তথ্য ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন সুস্বাধু এই ফল নানা ধরনের রোগ-ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে রাখতে যেমন সাহায্য করে তেমনি দিন দিন কাঁঠাল দিয়ে বিভিন্ন আইটেম তৈরির ব্যবহারও বাড়ছে। উৎপাদনের স্বর্গরাজ্য হলেও মৌসুম ছাড়া কাঁঠাল নিয়ে তেমন একটা আগ্রহ নেই কারো। সেই সঙ্গে নেই কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহারও। তাই কোটি কোটি টাকার কাঁঠাল নষ্টও হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন বিশ্বের সম্ভাব্য খাদ্যসঙ্কট মোকাবেলায় কাঁঠালের উৎপাদন বৃদ্ধিও একটি সমাধান হতে পারে। প্রতি বছর উৎপাদিত কাঁঠাল নষ্ট না করে বহুমুখী ব্যবহার আর রফতানির ক্ষেত্রে আরও বেশি জোর দিলে সরকারের আয় হবে অনেক এমনটাই বলছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, দেশের প্রায় সব জেলায় উৎপাদিত এই ফলটি অধিকাংশ সময় পাকা হিসেবেই খাওয়া হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে ২০১৮ সালে দেশে ৩৩ হাজার একর জমিতে ১০৬১ হাজার টন কাঁঠাল পাওয়া যায়। আর বিভিন্ন তথ্যে আরও জানা গেছে উৎপাদিত কাঁঠালের ৩৩-৩৪ শতাংশই নষ্ট হয় যথাযথ প্রক্রিয়াকরণের অভাবে। দেশের কাঁঠাল উৎপাদন নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১০-১১ অর্থবছরে ৭৯ হাজার ২৮০ হেক্টর জমিতে কাঁঠালের উৎপাদন ছিল ১৩ লাখ ৫২ হাজার ৮৪ টন। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৭৮ হাজার ৮১২ হেক্টর জমিতে উৎপাদন ছিল ১৬ লাখ ১৮ হাজার ৬৯৬ টন। এতে আবাদের জমি কমলেও উৎপাদন বাড়ার বিষয়টি দেখা গেছে। এছাড়াও ২০১১-১২ অর্থবছরে ১৮ লাখ ৭৯ হাজার ৬১৩ টন, ২০১২-১৩ অর্থবছরে বেশি উৎপাদন ছিল ৩২ লাখ টন, ১৩-১৪ অর্থবছরে ১৬ লাখ ১৮ হাজার ৬৯৬ টন, ১৪-১৫ অর্থবছরে ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ৮৬৯ টন কাঁঠাল উৎপাদন হয়। অথচ বিশে^র ১৫টি দেশে এই ফল রফতানি হলেও উৎপাদিত ফলের বিপরীতে তা খুবই কম।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩৯৩ টন এবং ২০১৭-১৮ সালের জুন পর্যন্ত রফতানি ছিল ৭০০ টন। অথচ কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাঁঠাল গাছ একবার রোপণের পর খুব কম যতœ নিলেও চলে। কিন্তু ধান, গম ও ভুট্টার মতো জনপ্রিয় অন্যান্য শস্য উৎপাদনে প্রচুর সেচ দিতে হয় এবং কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে। কাঁঠাল চাষে এসব ঝামেলা নেই বললেই চলে। কাঁঠাল গাছ বহুবর্ষজীবী হওয়ায় এটি প্রতিবছর রোপণের প্রশ্ন আসে না। গ্রীষ্মকালীন একেকটা গাছে পাঁচ থেকে সাত বছর যাবৎ ফল ধরে। তা ছাড়া কোন কোন গাছে বছরে ১৫০ থেকে ২০০টি কাঁঠাল ধরে। জানা গেছে, কাঁঠালের সবই প্রয়োজনীয়। কাঁঠাল কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থাতেই খাওয়া যায়। কাঁঠাল শুকিয়ে সংরক্ষণের পাশাপাশি স্যুপ, চিপস, রস (জুস), আইসক্রিম ইত্যাদি খাবার তৈরিতেও কাঁঠাল ব্যবহার করা যায়। কাঁচা কাঁঠাল কান্দা বা ইচোড় সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। পাকা ফল বেশ পুষ্টিগুণে ভরা। কাঁঠালের আঁটি তরকারির সঙ্গে রান্না করে খাওয়া হয় অথবা পুড়িয়ে বাদামের মতো খাওয়া যায়। পাকা ফলের কোষ সাধারণত খাওয়া হয়, এই কোষ নিংড়ে রস বের করে তা শুকিয়ে আমসত্বের মতো ‘কাঁঠালসত্ব’ও তৈরি করা হয়। গাছ থেকে তৈরি হয় মূল্যবান আসবাবপত্র। কাঁঠাল ফল ও গাছের আঁঠালো কষ কাঠ বা বিভিন্ন পাত্রের ছিদ্র বন্ধ করার কাজে ব্যবহৃত হয়। তাই এই ফলটির গাছ থেকে শুরু করে সব কিছুই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হাফিজুল হক খান জনকণ্ঠকে বলেন, কাঁঠালকে মাংসের বিকল্প বলা হয়। আমাদের ‘কাঁচা কাঁঠালের ভেজিটেবল মিট প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ কর্মসূচী’ নামে একটি প্রকল্প গত বছর থেকে চালু আছে। এর মাধ্যমে কিভাবে মানুষ কাঁঠাল কাঁচা অবস্থায় সংরক্ষণ করবে তা জানানোর চেষ্টা করছি। জানা গেছে ৫৫-৬৫ দিনের পরিপক্ব কাঁচা কাঠাল সংগ্রহ করে ভেজিটেবল মিট হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের এক তথ্যে জানা গেছে, কাঁঠালই সেরা ফল স্লোগানে ২০১৮ সালের মে মাসে, কেরালা রাজ্য সরকার কাঁঠালকে সরকারী ফল হিসেবে ঘোষণা করে। কেরালার কৃষিমন্ত্রী ভিএস সুনীল কুমার আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গার্ডিয়ানকে বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও ব্রিটেনসহ কাঁঠালের রফতানি গত বছর ৫০০ টন বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ ৮০০ টন পৌঁছতে পারে। জ্যাকফ্রুট তার মাংসিক টেক্সচারের জন্য বিখ্যাত। গার্ডিয়ানের ওই তথ্য মতে সাবেক মাইক্রোসফ্টের এক কর্মকর্তা জ্যাক জোসেফ রীতিমতো কাঁঠাল নিয়ে কাজ করছেন। গত ৫ বছর ধরেই তিনি এটি করছেন। এক গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, কেমোথেরাপি চলাকালে মানুষের রক্তের কোষের যথাযথ মাত্রা বজায় রাখতে কাঁঠাল সহায়ক করতে পারে। তিনি আরও বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, গত বছর কাঁঠালের সময় কেরালায় ডায়াবেটিস ওষুধের ব্যবহার হ্রাস পেয়েছিল, যখন সরকার তার রাজ্যের ফলের ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছিল।
বাংলাদেশেও কাঁঠালের নানা উপকারিতা নিয়ে আলোচনা হয়। কাঁঠালের জাত বিষয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ ও ভারতে চাষকৃত কাঁঠালের জাত হলো- গালা ও খাজা। গালা ও খাজা কাঁঠালের মাঝামাঝি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ‘রসখাজা’। এছাড়াও আছে রুদ্রাক্ষি, সিঙ্গাপুর, সিলোন, বারোমাসী, গোলাপগন্ধা, চম্পাগন্ধা, পদ্মরাজ, হাজারী প্রভৃতি জাতের কাঁঠাল। তবে এদের মধ্যে হাজারী কাঁঠাল বাংলাদেশে আছে, বাকিগুলো আছে ভারতে। দেশের উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে বারি কাঁঠাল-১ (২০০৮) এবং বারি কাঁঠাল-২ (২০১০)। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এই জাত সৃষ্টি করে। বারি কাঁঠাল-১ সারাদেশে চাষের উপযোগী। মধ্যম সাইজ (৯ কেজি) গাছপ্রতি ১২৫টি ফলসহ ওজন ১১৮১ কেজি পর্যন্ত। হেক্টরপ্রতি ফলন ১১৮ টন। বারি কাঁঠাল-২ অমৌসুমি ফল। উফশী জাত, মধ্যম সাইজ (৭ কেজি), গাছপ্রতি ৫৪-৭৯টি ফলসহ ওজন ৩৮০-৫৭৯ কেজি। হেক্টরপ্রতি ফলন ৩৮-৫৮ টন। এছাড়াও বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়-জার্মপ্লাজ সেন্টার ময়মনসিংহ কর্তৃক উদ্ভাবিত বাউ কাঁঠাল ১। এটি নিয়মিত ফলধারণকারী বামন জাত। ফলের ওজন ১০-২০ কেজি।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র ফল বিভাগের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. জিল্লুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, কাঁঠালের সুনির্দিষ্ট জাত নেই, বৈচিত্র্যতাও বেশি। একই ধরনের কাঁঠাল খুব বেশি পাওয়া যায় না। কেননা বীজ থেকে মাতৃগাছ হয় না। তবে কলম করলেই কেবল একই ধরনের ফল পাওয়া সম্ভব। আমরা বারি থেকে তিনটি জাত বের করেছি এক্ষেত্রে রফতানিতে সহায়তা করবে। তিনি আরও বলেন, এই জাতগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো অফ সিজনেও আপনি কাঁঠাল পাবেন। এজন্য ‘বারোমাসি কাঁঠালের বিস্তার ও ফলন যাচাই প্রকল্পের আওতায় গাজীপুর, ময়মনসিংহ, খাগড়াছড়ি, নরসিংদী এলকায় কৃষক পর্যায়ে বাগান সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আমরা কাজ করছি। কাঁঠালের চাহিদার কথা উল্লেখ করে এই বিজ্ঞানী বলেন, আমরা কাঁঠাল নিয়ে নান ধরনের গবেষণা করেছি। বিদেশীদের কাছে এই ফলের বীজের চাহিদা প্রচুর। তবে এই ফলের বহুমুখী ব্যবহার দরকার। একই সঙ্গে সবজি হিসেবে ব্যবহার প্রথম থেকেই করা উচিত তাহলে কিছু নষ্ট কমে আসবে।
বারি উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র ফল বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. বাবুল চন্দ্র সরকার জনকণ্ঠকে বলেন, কাঁঠালের যেহেতু আলাদা বৈশিষ্ট্যের সেক্ষেত্রে কলম গাছের প্রতি কৃষক পর্যায়ে আগ্রহ কম। আবার একটা নির্দিস্ট সময়ে সবাই ফল বাজারে নিয়ে আসে বহুমুখী ব্যবহার নেই তাই যেমন নষ্ট হয় তেমনি বিষয়টি নিয়ে অনেকের আগ্রহ থাকে না। তবে আমরা ভাল জাত তৈরি করতে পেরেছি। সরেজমিনে গাজীপুরের কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের কলম গাছের নানা ধরনের পরিচর্যা করতেও দেখা গেছে। জানা গেছে, কাঁঠাল শুকিয়ে সংরক্ষণের পাশাপাশি স্যুপ, চিপস, রস (জুস), আইসক্রিম ইত্যাদি খাবার তৈরিতেও কাঁঠাল ব্যবহার করা যায়।
২০১৬ সালে বিশ্বের ফল উৎপাদনের মধ্যমেয়াদী লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এফএও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। অন্যতম পুষ্টিকর ফল কাঁঠালকে মাংসের বিকল্প ওই প্রতিবেদনে বলা হয় সারা বিশ্বে বছরে ৩৭ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাঁঠাল হয় ভারতে যা ১৮ লাখ টন। দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। এখানে ১০ লাখ টন উৎপাদন হয়। পুষ্টিমানের দিক থেকে অন্যতম এই ফলের আমদানি খুব দ্রুত হারে বাড়াচ্ছে চীন। তবে চীন মূলত উৎপাদনে তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড থেকে কাঁঠাল আমদানি করে। জাপান, মালয়েশিয়ার মতো পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো কাঁঠাল আমদানির দিকে ঝুঁকছে। এই দেশগুলোর বাংলাদেশ ও ভারত থেকে কাঁঠাল আমদানি না করার অন্যতম কারণ হচ্ছে, এই দুই দেশের কাঁঠালে আঠা থাকে। আর এখানকার কাঁঠালে একধরনের বুনো গন্ধ থাকে, যা পূর্ব এশিয়ার মানুষের পছন্দ নয়।
এদিকে প্রতি বছর উৎপাদিত কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহার না থাকা এবং পর্যাপ্ত রফতানি না করায় যে পরিমাণ নষ্ট হচ্ছে তার মূল্য বাৎসরিক ৫০০ কোটি টাকা জানান বারির পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। এ সময় মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ মিয়ার উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহার বাড়াতে এবং অপচয় কমাতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের অধীনে আমাদের বিভাগ ও নিউটেশন সলিউশন একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে যা চলতি মে থেকে শুরু হবে। প্রস্তাবিত আড়াই কোটি টাকার এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো- উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা, প্রক্রিয়াজাত নিয়ে কাজ করবে। গ্রাহকের চাহিদা ও ভ্যালু এ্যাড করতেও কাজ করবে প্রকল্পটি। তিনি বলেন, আমারও থাইল্যান্ডের মতো চিপস করতে চাই। এছাড়াও অর্গানিক, ফ্রোজেন কাঁঠাল, ভিনেগার করতে চাই। আমরা মনে করি বহুমুখী ব্যবহার করলে অপচয় কমে আসবে।
কাঁঠালের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা ॥ ভারতীয় উপমহাদেশ ও আশপাশের অঞ্চলের সীমানা ছাড়িয়ে ফলটিকে পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে অনেক দিন ধরেই। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে কাঁঠাল জনপ্রিয় করার বিভিন্ন উদ্যোগের অংশ হিসেবেই এখন বিভিন্ন দেশে কাঁঠালের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে কাঁঠাল বাণিজ্য থেকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসবে। এছাড়াও প্রবাসী বাঙালীরা বাংলাদেশী কাঁঠাল খুব বেশি পছন্দ করেন। কয়েক বছর ধরে হবিগঞ্জের বড় ও ভাল কাঁঠাল ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মধ্যপ্রাচ্যে লন্ডন, সৌদি আরব, দুবাই, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে। কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যানমতে, দেশের কাঁঠাল উৎপাদন কয়েকটি জেলায় সীমাবদ্ধ যেমনÑ দিনাজপুর, ঢাকা, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি জেলায় উৎপাদন হচ্ছে। এছাড়া টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, যশোর, কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম, সিলেট ও পাবনা জেলায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ উৎপাদন হয়। কাঁঠালের নানামুখী ব্যবহার সবার কাছে ঠিকমতো উপস্থাপন করতে পারলে এটি আরও সম্ভাবনাময় মনে করা হচ্ছে।
বারির পোস্ট হারভেস্ট বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হাফিজুল হক খান বলেন, আমরা চিপস, জ্যাম, জেলি, করতে পারি। এর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আছে কেউ ট্রেনিংও নিতে পারে। তবে রফতানি করতে চাইলে আরও আধুনিক মেশিনারি দরকার হবে। এসব করলে কাঁঠালের চাহিদা যেমন থাকবে বারো মাস তেমনি আয়ও আসবে।
তবে রফতানি করতে সরকারকে সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্যবসায়ী সমাজকেও এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সঙ্গে কাজ করতে হবে।
সংরক্ষণে জাগবে সম্ভাবনা ॥ জাতীয় ফল কাঁঠালে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি। কোলস্টেরলমুক্ত এই ফলে নেই কোন ক্ষতিকারক চর্বি। কাঁঠাল কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থাতেই খাওয়া যায়। কাঁঠাল পাকলে কোষ খাওয়া হয়, এই কোষ নিংড়ে রস বের করে খাওয়া হয় এবং তা শুকিয়ে আমসত্বের মতো ‘কাঁঠালসত্ব’ও তৈরি করা যায়। সংরক্ষণের অভাবে প্রতিবছর লাখ লাখ টাকার কাঁঠাল পচেগলে নষ্ট হয়। এজন্য সংরক্ষণ পদ্ধতি জরুরী। প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে কাঁঠাল রফতানি করেও প্রচুর বৈদেশিক অর্থ উপার্জন করাও সম্ভব বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
হরেক পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা ॥ কাঁঠাল একটি সুস্বাদু রসালো ফল। এর রয়েছে নানা পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা। কাঁঠালের উপকারিতা সম্পর্কে কথা বলেছেন একাধিক খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞানী। পুষ্টি বিজ্ঞানী ফারাহ মাসুদার মতে, নানান পুষ্টিগুণে ভরপুর কাঁঠাল। কাঁঠালে বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন এ, সি, বি-১, বি-২, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়ামসহ নানা রকমের পুষ্টি ও খনিজ উপাদান পাওয়া যায়। এসব উপাদান আমাদের শরীরকে সুস্থ ও সবল রাখতে সাহায্য করে। এর পাশাপাশি ভিটামিনের চাহিদাও পূরণ করে কাঁঠাল।
জানা গেছে, কাঁঠালে বিদ্যমান বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান কাঁঠালে রয়েছে বিটা ক্যারোটিন যা দৃষ্টি শক্তি ভাল রাখে, দাঁত ও হাড় সুস্থ রাখে, ত্বক সুন্দর করতে সাহায্য করে। কাঁঠালে সামান্য পরিমাণ প্রোটিনও পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা কাঁঠালে ১.৮ গ্রাম, কাঁচা কাঁঠালে ২০৬ গ্রাম ও কাঁঠালের বীজে ৬.৬ গ্রাম প্রোটিন পাওয়া যায়। এই প্রোটিন দেহের গঠনে সাহায্য করে। কাঁঠালে রয়েছে শ্বেতসার। কাঁঠালে ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যায়। ‘এ’ ভিটামিন দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। কাঁঠালের এ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান চোখের রেটিনার ক্ষতি প্রতিরোধ করে। কাঁঠালে ভিটামিন বি-১ ও বি-২ পাওয়া যায়। ভিটামিন ‘সি’ শরীরকে নানা রকম ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস থেকে রক্ষা করে। তাছাড়া এই ভিটামিনটি সর্দি-কাশি ও জ্বর প্রতিরোধ করে। এটি ত্বক, দাঁত ও হাড়ের সুস্থতা বজায় রাখে। এছাড়াও ভিটামিন ‘সি’ এর এ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কোষকে নানা রকম ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। কাঁঠালে কিছু পরিমাণ আয়রন পাওয়া যায়। পাকা কাঁঠালে আয়রনের পরিমাণ ০.৫ মি.গ্রা, কাঁচা কাঁঠালে ১.৭ মি.গ্রা এবং বীজে ১.৫ মি.গ্রা। চাহিদা অনুযায়ী আয়রন গ্রহণ করে পেটের অসুখ, সংক্রামক রোগ, যেমন— ম্যালেরিয়া, কৃমি, আলসার, রক্ত আমাশয় ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। কাঁঠালে রয়েছে পটাশিয়াম যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। তাছাড়া সঠিক পরিমাণে কাঁঠাল খেলে স্ট্রোকের ঝুঁকিও অনেকটা কমে যায়। তথ্যে আরো জানা গেছে, কাঁঠাল কার্বোহাইড্রেটের একটি অন্যতম উৎস। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা কাঁঠাল থেকে ৪৮ কিলোক্যালরি, কাঁচা কাঁঠাল থেকে ৫৩ কিলোক্যালরি এবং কাঁঠালের বীজ থেকে ১৩০ কিলোক্যালরি পরিমাণ শক্তি পাওয়া যায়। তাই শরীরের প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান কাঁঠাল থেকে পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন পুষ্টি বিজ্ঞানীরা। কাঁঠালে প্রচুর পরিমাণে ক্যারোটিন পাওয়া যায়। কাঁঠালের হলুদ ও রসালো অংশে রয়েছে ক্যান্সার প্রতিরোধোক উপাদান। এ্যান্টিঅক্সিডেন্টেরও একটি ভাল উৎস। কাঁঠাল হজমে সাহায্য করে, কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিহত করে। কাঁঠাল ত্বকের বলিরেখা বা বয়সের ছাপ কমাতে সহায়তা করে। চেহারায় লাবন্য দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য কাঁঠাল খাওয়ার পরামর্শ দেন অনেক খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞানীই। এছাড়াও কাঁঠাল আলসারের প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। উইকিপিডিয়াতেও কাঁঠালের নানামুখী পুষ্টিগুণের কথা জানা যায়। কাঁঠালের ভিটামিন বি ৬ যা হৃদরোগের ঝুঁঁকি কমায়। কাঁঠালে বিদ্যমান ক্যালসিয়াম কেবল হাড়ের জন্য উপকারী নয় রক্ত সংকোচন প্রক্রিয়া সমাধানেও ভূমিকা রাখে। ছ’মাস বয়সের পর থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি শিশুকে কাঁঠালের রস খাওয়ালে শিশুর ক্ষুধা নিবারণ হয়। অন্যদিকে তার প্রয়োজনীয় ভিটামিনের অভাব পূরণ হয়। চিকিৎসাশাস্ত্র মতে, প্রতিদিন ২০০ গ্রাম তাজা পাকা কাঁঠাল খেলে গর্ভবতী মহিলা ও তার গর্ভধারণকৃত শিশুর সব ধরনের পুষ্টির অভাব দূর হয়। কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক কৃষিবিদ ড. মোঃ নুরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, কাঁঠালের পুষ্টিজ্ঞান কারও অজানা নয়। তবে পাকা কাঁঠাল খাওয়ার প্রবণতা আমাদের বেশি। কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহার নিয়ে আমাদের জানতে হবে প্রচারণা থাকতে হবে। এতে নষ্টও কমমে আবার ব্যবহারও বাড়বে।
কাঁচা কাঁঠালের ব্যবহার বাড়ানোর কথা উল্লেখ করে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. আবুল কালাম আযাদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন প্রণোদনা সরকার দিতে পারে। উন্নত দেশে দেখেছি কাঁঠালের কোয়া হিসেবে বিক্রি হয়। আমাদের সে পর্যায়ে হয়তো আসেনি তবে নষ্ট কমাতে নানা উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। বহুমুখী ব্যবহার বৃদ্ধির বিকল্প নেই। কাঁঠাল নিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরিতে বেসরকারী খাতকে এগিয়ে আসতে হবে আর কেউ এগিয়ে আসলে বারি সেই সহয়তা দিবে বলেও জানান তিনি।
সবার মতেই কাঁঠাল একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ ফল। জাতীয় এই ফলকে ব্যবহার করা যায় নানাভাবেই। শুধু মৌসুমে বা পাকা অবস্থায়ই নয় কাঁচা থেকে শুরু করা যায় এর ব্যবহার।