ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হোতা আসলাম সহযোগীসহ গ্রেফতার

প্রোডাকশন হাউস ও ক্যাফের আড়ালে মাদক সিন্ডিকেট

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ২৫ মে ২০১৮

প্রোডাকশন হাউস ও ক্যাফের আড়ালে মাদক সিন্ডিকেট

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ কথিত চলচ্চিত্র ও মিউজিক ভিডিও নির্মাণের আড়ালে গড়ে তোলা প্রোডাকশন হাউস ও চাইনিজ ক্যাফের আড়ালে রাজশাহীভিত্তিক মাদক সিন্ডিকেটের সন্ধান মিলেছে। এ সিন্ডিকেটের হোতা ও সহযোগীকে লক্ষাধিক ইয়াবাসহ গ্রেফতারের পর বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। এখন পর্যন্ত প্রোডাকশন হাউস থেকে কোন চলচ্চিত্র কিংবা মিউজিক ভিডিও রিলিজ না হলেও তার আড়ালে মাদকের অন্ধকার জগত গড়ে তুলেছিল এ শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী। তার নাম আসলাম সরকার। বুধবার বিকেলে কক্সবাজারে র‌্যাবের হাতে সহযোগীসহ আটকের পর রাজশাহীতে তার মাদকরাজ্যের বিস্তর খোঁজ মিলেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বছর কয়েক আগে টেলিফোন ও ফটোকপির দোকানের কর্মচারী ছিল আসলাম সরকার। রাজশাহী নগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকার একটি দোকানে কয়েক বছর চাকরি করেছেন। সেখান থেকেই পরিচয় ঘটে কয়েকজন কলাকৌশলীর সঙ্গে। এরপর নিজেই গড়ে তোলেন ‘সরকার প্রোডাকশন হাউস’। এই প্রতিষ্ঠানের নাম ভাঙ্গিয়ে আসলাম সরকার গড়ে তোলে অপরাধ জগত। নারীদের দিয়ে অনৈতিক কর্মকা- আর মাদক ব্যবসার কারবারে কয়েক বছরের মধ্যেই বনে যান কোটিপতি। অবশেষে শূটিং করার নামে কক্সবাজার গিয়ে এক লাখ আট হাজার ইয়াবার চালান নিয়ে আসার পথে র‌্যাবের হাতে ধরা পড়ে কুখ্যাত এ মাদক স¤্রাট ও নানা অপরাধের হোতা আসলাম সরকার (৪০)। কক্সবাজারের কলাতলী এলাকা থেকে র‌্যাব-৭ এর সদস্যরা তাকে গ্রেফতার করে। এ সময় পুরো সেটের দুই নারীসহ (কথিত নায়িকা) ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে অবশ্য সম্পৃক্ততা না থাকায় ৮ জনকে মুচলেকায় ছেড়ে দেয়া হয়। এ সময় প্রায় ৩০ লাখ টাকা মূল্যের মাইক্রোবাসটি জব্দ করে র‌্যাব। র‌্যাব সূত্র জানায়, সপ্তাহ খানেক আগে শূটিংয়ের টিম নিয়ে কক্সবাজারে ঢুকে রাজশাহী অঞ্চলের মাদক চক্রের অন্যতম হোতা আসলাম সরকার। ওই টিমে আসলাম ও তার মাইক্রোবাসের ড্রাইভারসহ ছিল ১০ জন। তবে প্রথম থেকেই র‌্যাবের গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিল ওই টিমটি। পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে মাইক্রোবাসের তেলের টেংকির ভেতর করে সে ইয়াবা নিয়ে যাচ্ছিল রাজশাহীতে। এ ঘটনায় আসলাম ও তার ড্রাইভার মাসুদ রানাকে গ্রেফতার দেখান হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীর ‘সরকার প্রোডাকশন হাউস’ ও ‘ব্ল্যাক ক্যাফে’ এর স্বত্বধিকারী আসলাম সরকার। সে নগরীর রাজপাড়া থানাধীন ডিঙ্গাডোবা এলাকার আজিজুল আলমের ছেলে। রাজশাহীতে আসলাম সরকারের বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ছয় থেকে সাতটি বিয়ে করেছে সে। বিভিন্ন থানায় নারী ঘটিত মামলাও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। মাদকসহ নানা অনৈতিক কর্মকা-ের ব্যবসা করে এখন তিনি বহু অর্থের মালিক বনে গেছেন। নগরীর ঘোষপাড়াস্থ রাজশাহী মেডিক্যাল অডিটরিয়ামের পূর্বে অবস্থিত ‘ব্ল্যাক ক্যাফে’ নামে তার একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ওই ভবনটিতে সে গড়ে তোলে অপরাধ জগত। তিন তলার ওই ভবনটি পুরোটাই ভাড়া নিয়ে সেখানে মাদকসহ নারীদের দিয়ে অনৈতিক কর্মকা- চালিয়ে আসছিল। স্থানীয়দের দেয়া তথ্যমতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ব্ল্যাক ক্যাফেতে তরুণ-তরুণীদের নিয়ে প্রতিদিন বসত মাদকসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকা-ের আসর। বাইরে থেকে সব সময় বন্ধ করে রাখা হতো এই ক্যাফেটির দরজা। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই এর ভেতরে কি ঘটছে। অপরিচিত কাউকে ওই ক্যাফের মূল অংশে প্রবেশ করতে দেয়া হতো না। মূলত ওই ভবনে ‘সরকার প্রোডাকশন হাউজ’ এর কর্মকা-ের নামে চলত অপরাধ জগত। সেখানে নারীদের মডেল হিসেবে ব্যবহার করে মাদকের পাশাপাশি অপরাধ জগতের স্বর্গ গড়ে তোলে আসলাম। সুন্দরী নারীদের ব্যবহার করে বিত্তশালী পরিবারের ছেলেদের নিয়ে গিয়ে ইয়াবাতে আসক্ত করাত এই মাদক সম্রাট আসলাম সরকার। নানাভাবে শূটিংয়ের পর চলচ্চিত্র ও মিউজিক ভিডিও রিলিজের প্রলোভনে নারীদের জিম্মি করত এই আসলাম সরকার। একবার কোন নারী কার ফাঁদে পা দিলে আর বেরিয়ে আসতে পারত না। পরে তাদের রাজধানী ও কক্সবাজারের বিভিন্ন হোটেলে নিয়ে গিয়ে দেহ ব্যবসাতেও বাধ্য করা হতো। তার অনৈতিক কর্মকা-ের শিকার কয়েকজন কিশোরী চঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। নাম ঠিকানা প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, মাদকের পাশাপাশি দেহ ব্যবসায় তাদের বাধ্য করত আসলাম। শূটিংয়ের নামে কক্সবাজারে গিয়ে ক্যামেরার ব্যাটারি খুলে তার ভেতর ইয়াবা নিয়ে আসত রাজশাহীতে। রাজশাহীর বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে নারী ঘটিত অভিযোগও রয়েছে। নগরীর রাজপাড়া থানার ওসি হাফিজুর রহমান বলেন, থানায় বেশ কয়েকটি অভিযোগ রয়েছে আসলাম সরকারের বিরুদ্ধে। রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও সিনিয়র সহকারী কমিশনার ইফতে খায়ের আলম জানান, পুলিশ তার ওপর নজর রাখছিল। কয়েকবার তার ব্ল্যাক ক্যাফেতে অভিযানও চালানো হয়েছে। সিলগালাও করে দেয়া হয়েছিল। স্থানীয়রা জানান, তার ব্ল্যাক ক্যাফেই ছিল অপরাধ জগত। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর সেখানে আড্ডা বসত তরুণ-তরুণীদের। অনেকে সেটিকে চাইনিস রেস্টুরেন্ট মনে করলেও ভেতরে চলত অনৈতিক কর্মকা-। সাধারণ মানুষ যাতে ভেতরে কি হচ্ছে বুঝতে না পেরে সেজন্য তার ক্যাফের সামনে ফুচকার দোকানও দিয়েছিল আসলাম। তার ক্যাফের ভেতরে আলাদা আলাদা কক্ষও ছিল। এদিকে বিপুল ইয়াবা চালানসহ আসলাম ও তার সহযোগী চারঘাটের মাসুদকে গ্রেফতারের পর এবার আন্তঃজেলা মাদক চক্রের হোতা বাঘা সীমান্ত এলাকার মাদক স¤্রাট কালাম মোল্লাকে খুঁজছে পুলিশ। তার নামে অস্ত্র ও হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন থানায় রয়েছে একাধিক মামলা। স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বাঘা সীমান্ত এলাকার হেলালপুর গ্রামের কৃষক আকছেদ মোল্লার ছেলে কালাম মোল্লা। মাদকের স্বর্গরাজ্য গড়ে কালাম মোল্লা সবচেয়ে বেশি সম্পদের মালিক বনেছেন। তার নামে অস্ত্র ও হত্যা মামলাসহ বাঘা, চারঘাট, ঈশ্বরদী, লালপুর, সিরাজগঞ্জ ও ঢাকার টঙ্গী থানা মিলে রয়েছে প্রায় ২০টি মামলা। সারাদেশে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এলাকা থেকে লাপাত্তা রয়েছে কালাম মোল্লা। জানা গেছে, কক্সবাজারে আসলাম সরকার ও মাসুদ গ্রেফতারের পর গা ঢাকা দিয়েছে কালাম মোল্লা। কালাম মোল্লা তার নিজ এলাকায় আলিশান দুটি বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এই বাড়ি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকা। এছাড়াও নিজ এলাকায় সম্পদ (জমি) কিনেছেন প্রায় অধশত বিঘা। জেলার বাঘা থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রেজাউল হাসান জানান, তিনি গত বছরের শেষ সময় এ থানায় যোগদানের পর সীমান্ত এলাকার চোরাকারবারিদের নামের তালিকা সংগ্রহের কাজ শুরু করেছেন। এর মধ্যে কালাম মোল্লাকে এ অঞ্চলের শীর্ষ চোরাকারবারি হিসেবে পেয়েছেন তালিকায়। তিনি জানান, বাঘা থানায় কালাম মোল্লার নামে ১০টি মাদকের ও একটি প্রাইভেটকার চুরির মামলা রয়েছে।
×