এম শাহজাহান ॥ দেশ-বিদেশে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে রফতানি প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক ধারা বজায় রয়েছে। প্রতিবছর রফতানি আয় বাড়ছে ৩ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলারের। রূপকল্প-২১ এর লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আগামী চার বছরের মধ্যে পণ্য ও সেবা খাতের রফতানি হবে ৬০ বিলিয়ন ডলার। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে প্রতিবছর ৫ বিলিয়ন ডলারের রফতানি বাড়ানো প্রয়োজন। রফতানি আয়ে গতি আনতে ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ১৮টি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জানা গেছে, রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়ন এবং দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যেতে ৫০ বিলিয়ন তৈরি পোশাক বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া ৫ বিলিয়ন চামড়া ও চামড়জাত পণ্য, আর বাকি ৫ বিলিয়ন আসবে অন্যান্য খাত থেকে। কিন্তু বৈশ্বিক মন্দা, প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া, প্রচলিত বাজার এবং পণ্য আমদানিতে নির্ভরশীলতা থাকাসহ বিভিন্ন কারণে রফতানি আয়ে কিছুটা চ্যালেঞ্জ যুক্ত হয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই যাতে রফতানি আয় বাড়ে সেলক্ষ্যে সরকারী এবং বেসরকারী পর্যায়ে বেশকিছু পদক্ষেপ রয়েছে।
সূত্র মতে, গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে দেশে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় পূরণ হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪১ বিলিয়ন ডলার। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩৭ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার। এর আগের অর্থবছরে ৩৪ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয় হয় দেশে। গত কয়েক বছরের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায় রফতানির নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা প্রায় পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছেন উদ্যোক্তারা। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের ২০১৭-১৮ জুলাইয়ে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশিত হালনাগাদ পরিসংখ্যান প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অর্থবছরের প্রথম মাসে রফতানি খাত থেকে আয় হয়েছে ৩২০ কোটি ৭০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ আয় ছিল ২৫৩ কোটি ৪৩ লাখ ১০ হাজার ডলার। এ হিসাবে জুলাইয়ে রফতানি খাতের আয় বেড়েছে ২৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
এছাড়া প্রাথমিক, উৎপাদনমুখী শিল্প ও কম্পিউটার সেবা এ তিন ভাগে রফতানি আয়ের মোট পরিমাণ প্রকাশ করে ইপিবি। এতে উৎপাদনমুখী শিল্পপণ্যের রফতানি থেকে আয় বেড়েছে ২৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। আবার প্রাথমিক পণ্য রফতানিতে আয় বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। প্রাথমিক পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে হিমায়িত খাদ্য ও মাছ এবং কৃষি। জুলাইয়ে হিমায়িত খাদ্য ও মাছের রফতানি আয় বেড়েছে ৫৭ দশমিক ৩২ শতাংশ, আয় হয়েছে ৫ কোটি ৯৪ লাখ ২০ হাজার ডলার।
উৎপাদনমুখী শিল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্লাস্টিক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, তৈরি পোশাক, ফার্নিচার এবং প্রকৌশল পণ্য। জুলাইয়ে প্লাস্টিক খাতের রফতানি আয় বেড়েছে ১৩ দশমিক ৭০ শতাংশ। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের আয় বেড়েছে ২৬ দশমিক ১৯ শতাংশ।
এছাড়া তৈরি পোশাক খাতে ওভেন ও নিট পণ্যের আয় বেড়েছে। ওভেন পণ্যের আয় বেড়েছে ১৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। নিট পণ্যের আয় বেড়েছে ১৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। আর প্রকৌশল পণ্যের রফতানি আয় বেড়েছে ৭০২ শতাংশ।
রফতানিতে জিএসপি ও ব্রেক্সিটের কোন প্রভাব পড়েনি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব পরিবর্তন ও যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বাণিজ্যে কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে তা পর্যালোচনা করেছে সরকার। কিন্তু এর কোন প্রভাব দেশের রফতানি আয়ে পড়েনি। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ব্রিটিশ এমপি রুশনারা আলীর সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকের পর তিনি জানান, ইইউ থেকে যুক্তরাজ্য বেরিয়ে গেলেও তার কোন নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পড়েনি। এছাড়া দেশটিতে রফতানিতে আগেও যেসব সুযোগ-সুবিধা ছিল এখনও তা বহাল আছে। কোটা ও ডিউটি ফ্রিতে পোশাক রফতানি হচ্ছে যুক্তরাজ্যে। একই অনুষ্ঠানে রুশনারা আলী জানান, বাংলাদেশ থেকে আগের নিয়মেই পণ্য কিনবে যুক্তরাজ্য। শুধু তাই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের পাশে আছে ব্রিটেন।
জানা গেছে, বাংলাদেশী পণ্য রফতানির সবচেয়ে বড় বাজারের একটি হলো ইউরোপ। এছাড়াও যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক বিনিয়োগকারী দেশ। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের মূল্যমানের পণ্য যুক্তরাজ্যে রফতানি হয়, যেখানে এককভাবে তৈরি পোশাক খাতের অবদান ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অপ্রচলিত পণ্যও যুক্তরাজ্যে রফতানি হয়ে থাকে।
এদিকে বেক্সিটের প্রভাব ও মার্কিন নেতৃত্ব পরিবর্তনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যেসব প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে তা থেকে উত্তরণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি কৌশল নির্ধারণ করে। জিএসপি ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ১৬টি শর্ত পূরণ হওয়ার পরও তা পুনর্বহাল করা হয়নি। এখন জিএসপি সুবিধার বাইরেও দেশটিতে রফতানি বাড়ছে। যদিও পোশাক রফতানিতে যুক্তরাষ্ট্র কখনও জিএসপি সুবিধা দেয়নি।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শুভাশিষ বোস জনকণ্ঠকে বলেন, ব্রেক্সিট এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের পরিবর্তনের ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে কিছুটা পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ইতোপূর্বে বাংলাদেশের রফতানিও কিছুটা কমে যায়, তবে এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। রফতানি প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ধারায় রয়েছে।
তিনি বলেন, রফতানি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর কৌশল নির্ধারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। নতুন বাজার অনুসন্ধান এবং অপ্রচলিত পণ্যের রফতানি বাড়াতে চলতি বাজেটে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া পণ্যের ডিজাইন ও গুণগতমান বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হয়েছে। সরকারের এসব উদ্যোগের ফলে রফতানি প্রবৃদ্ধি বাড়বে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
এদিকে রফতানিকারকরা বলছেন, দেশের রফতানি খাত এখনো বহুমুখী হয়ে উঠতে পারেনি। মোট রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশের উৎস এখনও তৈরি পোশাক। পণ্যটির রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলেই সামগ্রিক রফতানি খাতে এর ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে। পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী জনকণ্ঠকে বলেন, চার বছরের মধ্যে ৬০ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের প্রবৃদ্ধির হার আরও বাড়াতে হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য অনেক কমে গেছে। এছাড়া রফতানি খাত এখনও পোশাকনির্ভর। এ নির্ভরশীলতা কাটিয়ে ওঠাই আমাদের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ।
রফতানি বাড়াতে যেসব বিশেষ উদ্যোগ
২০২১ সাল নাগাদ শুধু তৈরি পোশাক খাত থেকে রফতানি আয় ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। ইতোমধ্যে রফতানি আয়ে গতি আনতে ১৬টি বিশেষ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, সরকারী ও বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংক, আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যের প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থা, যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মস পরিদফতরে সংস্কার, বন্দর সমন্বয়ে ডিজিটাল সেল প্রতিষ্ঠা, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো পুনর্গঠন এবং জাতীয় রফতানি হাউস স্থাপন সংক্রান্ত কার্যক্রম এবং তা বাস্তবায়নে নানামুখী পদক্ষেপ করা হয়েছে। এছাড়া রফতানি বাণিজ্য সম্প্রসারণের প্রয়োজনে বাণিজ্যের বিভিন্ন খাতে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে পরিকল্পনা গ্রহণ এবং উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের কারিকুলামে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটি) ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি অন্তর্ভুক্তকরণেরও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। যেসব দেশ রফতানি উন্নয়নে এগিয়ে, যেমন- ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, মালয়েশিয়াকে রোল মডেল হিসেবে দেখিয়ে বিদেশে বাংলাদেশ মিশনসমূহের কমার্শিয়াল উইংসমূহে কর্মরত কাউন্সিলরদের আরও কার্যকর করতে আর্থিক ক্ষমতা প্রদানের বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। বিদেশী মিশনসমূহে কর্মরত কমার্শিয়াল কাউন্সিলরদের নিয়ে ঢাকায় প্রতি দুই বছর অন্তর সম্মেলন অনুষ্ঠান এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উন্নয়নে ঢাকাস্থ বিদেশী মিশনসমূহে কর্মরত কমার্শিয়াল কাউন্সিলরদের নিয়ে প্রতি বছর সম্মেলন ও মতবিনিময় সভা করারও উদ্যোগ নেয়া হবে। এছাড়া কোম্পানি আইন ১৯৯৪ এর যে ধারা ইজি অব ডুয়িং বিজনেস’র ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে তা দ্রুত সংশোধনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।