ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মঞ্চনাটক ॥ নাজনীন বেগম

নৃত্যনাট্য শকুন্তলা

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬

নৃত্যনাট্য শকুন্তলা

২৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার শিল্পকলা একাডেমি জাতীয় নাট্যশালা মঞ্চে ‘শকুন্তলা’ নৃত্যনাট্যটি প্রদর্শিত হয়। ‘ভাবনা’র প্রযোজনায় নৃত্যনাট্যটির নির্দেশক ছিলেন সামিনা হোসেন প্রেমা। মহাভারতের কাহিনী থেকে নেয়া মহাকবি কালিদাসের শৈল্পিক শৌর্যে তৈরি ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ অবলম্বনে তপোবন মঞ্চে ‘শকুন্তলা’র শিল্পী ও কলাকৌশলীরা চমৎকারভাবে নৃত্যনাট্যটি উপস্থাপন করে দর্শকদের মাতিয়ে রাখেন। মহাভারতের অনুপম প্রেমের উপখ্যান দুষ্মন্ত-শকুন্তলা মহাকবি কালিদাসের অমর সৃষ্টির নান্দনিক মহিমায় যে শৈল্পিক সুষমা লাভ করে, তা যেমন বিস্ময়কর তেমনি অতুলনীয়। মহাকবি কালিদাস বাংলা সাহিত্যের এক অনুসরণীয় এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পব্যক্তিত্ব। এমন কৃতী আর সফল সৃষ্টি নায়ককে তার কাব্য প্রতিভার জন্য রাজা বিক্রমাদিত্যের কাছে পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। তখনকার প্রচলিত ধারা অনুযায়ী রাজাধিরাজ তার সভায় জ্ঞানী-গুণী আর প-িত ব্যক্তিদের লালন-পালন থেকে আরম্ভ করে ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়ে তাদের সম্মানিত করতেন। যুগের প্রয়োজনে, সময়ের দাবি মেটানোর নিরন্তর তাগিদে কালিদাস আজও প্রাসঙ্গিক এবং অপরিহার্য। তিনি সমকাল কিংবা আধুনিক নন, একেবারে চিরকালের। ভাবনার প্রযোজনায় ‘শকুন্তলা’ নাটকটির মঞ্চায়ন সেই সম্ভাবনারও দিকনির্দেশ করে। কাহিনীর অভিনবত্ব এবং চমৎকারিত্বের সঙ্গে কুশীলবদের অভিনয়ের যে সমন্বয় তাতে দর্শকের করতালিতে পুরো পরিবেশ হয়ে ওঠে আনন্দমুখর। ২০০৭ সালে ‘ভাবনা’র নৃত্যশিল্পীদের যাত্রা শুরু হয়। শকুন্তলা চরিত্রের রূপায়ণকারী সামিনা হোসেন প্রেমার হাত ধরেই। প্রেমার নির্দেশনার ভাবনার শিল্পীরা নৃত্যের তালিম নিতে থাকেন। ভাবনার পূর্ণাঙ্গ প্রথম প্রযোজনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভানু সিংহের পদাবলী’ ২০০৭ সালে। ‘শকুন্তলা’ নৃত্যনাট্যকে ভাবনা প্রথমবারের মতো দর্শকের মঞ্চে উপস্থাপন করে। নজরুলসঙ্গীত, শাস্ত্রীয়সঙ্গীত এবং নাটকের দৃশ্যের প্রয়োজনে লোকনৃত্যও সংযোজন করা হয়। নেপথ্যে সূত্রধরের কণ্ঠ দেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, রাজা দুষ্মন্তের কণ্ঠ দেন শিমুল মোস্তফা, শকুন্তলার সঙ্গে কণ্ঠ মেলান তামান্না তিথি। তপোবনের প্রাকৃতিক মনোরম ঐশ্বর্যে শকুন্তলার বেড়ে ওঠার যে দৃশ্য প্রদর্শিত হয়, তা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। তীর-ধনুক হাতে মৃগয়ার বেশে দুষ্মন্তের চরিত্রটিও দর্শকদের নজর কাড়ে। গান্ধর্ব মতে শকুন্তলা দুষ্মন্তের বিয়ের দৃশ্যটিও দর্শকরা চমৎকারভাবে উপভোগ করেন। এরপর শকুন্তলা-দুষ্মন্তের বিরহের করুণ রাগিনী উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের ভারাক্রান্ত করে তোলে। শকুন্তলার চরিত্রে প্রেমার অভিনয় সাড়া জাগানো। শিশু শকুন্তলার চরিত্রে জায়না নূর জাকারিয়া মানানসই। দুষ্মন্তের চরিত্রে সুকোমল ইফতেখার কাকন দর্শকদের মুগ্ধ করে রাখে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল দুষ্মন্তশকুন্তলার একমাত্র সন্তান ভরতের চরিত্রে ইরন অদিতির অভিনয় কৌশল। শিশুরা আসলে সবচেয়ে বেশি স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় করে। শকুন্তলার দুই প্রিয় সখী অনুসূয়া ও প্রিয়ংবদার চরিত্রে শ্রেয়সী মনি শশি এবং মধুরিমাদের অভিনয় দর্শকদের ভাল লেগেছে। শকুন্তলার আরও একটি বিশেষ চমক ছিল দুষ্মন্তের কণ্ঠের গানগুলো। স্বনামখ্যাত নজরুল সঙ্গীতশিল্পী খায়রুল আনাম শাকিলের কণ্ঠে নজরুলের অনবদ্য গানগুলো দর্শকরা বিশেষভাবে উপভোগ করেছেন। আর শকুন্তলার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন প্রিয়াঙ্কা গোপ। নৃত্য, গীত, বাদ্য, রাগ-রাগিনী সুর ঝঙ্কার আর অভিনয়ের শৈল্পিক দ্যোতনায় শকুন্তলা দর্শকদের মন জয় করতে পেরেছে। ‘ভাবনা’ নৃত্যগোষ্ঠীর এই ধরনের আরও ঐতিহ্যিক প্রযোজনা দর্শকদের মুগ্ধতায় ভরিয়ে দেবে, এই আশা আমরা করতেই পারি। দেশ যখন বিভিন্ন অশুভ তৎপরতায় সাময়িকভাবে উৎকণ্ঠিত, ঠিক সেই সময় এই ধরনের শুভ উদ্যোগগুলো আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনাকে আরও মজবুত করবে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে জোরদার করবে এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের সহজ মিলনের পথ নির্দেশ করবে। সবশেষে বলতে চাই রুচিশীল দর্শকের উপচে পড়া ভিড়ে ভাবনার এই সফল প্রযোজনা আমাদের ভাবনার জগতকেও সমৃদ্ধর করবে। যার প্রভাব শুধুমাত্র শিল্প সংস্কৃতিতেই নয়, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বলয়েও এসব সৃষ্টিকর্ম রাখবে অনবদ্য ভূমিকা ।
×