ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

গুলিস্তান-পল্টন

দিনে ওঠে ৩০ লাখ

প্রকাশিত: ১৭:৩৪, ২ অক্টোবর ২০২২

দিনে ওঠে ৩০ লাখ

ফুটপাথে বসা হকার

ঢাকার রাস্তায় প্রায় তিন লাখ হকারের মধ্যে গুলিস্তান, পল্টন ও মতিঝিলের ৪৫টি ফুটপাথে বসছে প্রায় ১৫ হাজার। যদিও এই এলাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তালিকাভুক্ত হকার আছেন ২ হাজার ৫০২ জন। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা হওয়ায় এবং পল্টন ও গুলিস্তান বিভিন্ন ধরনের ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় এসব এলাকায় প্রতিনিয়তই মানুষের ভিড় লেগেই থাকে।

এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের প্রধান একটি রুট হলো পল্টন, গুলিস্তান। এসব এলাকার ফুটপাথ দিয়ে কোনভাবেই হাঁটা যাচ্ছে না। হকাররা ফুটপাথ দখলের পর সড়কের একাংশও দখল করে বসেছেন। এদের প্রত্যেকের কাছ থেকে দৈনিক ১০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হয়। চাঁদার হার গড়ে ২০০ টাকা করে হলে ১৫ হাজার হকারের কাছ থেকে দিনে ৩০ লাখ টাকা চাঁদা ওঠে। চাঁদার এই টাকা স্থানীয় নেতা-কর্মী, পুলিশ, সিটি করপোরেশনের কর্মচারী ও চাঁদা তোলার কাজে নিয়োজিত লাইনম্যানরা ভাগ করে নেয়। হকাররা দিনের আয় দিয়ে কোন রকম সংসার চালালেও এদের কাছ থেকে তোলা চাঁদার টাকায় আয়েশি জীবনযাপন করছে চাঁদাবাজ ও নিয়ন্ত্রকরা। তাদের কাছে ফুটপাথ যেন টাকা বানানোর মেশিন। 

গুলিস্তান, পল্টন ও মতিঝিলের ফুটপাত কাদের দখলে, এসব ফুটপাত থেকে দৈনিক কি পরিমাণে চাঁদা তোলা হয়, চাঁদার ভাগ কার কার পকেটে যায়- এসব জানতে বেশ কয়েকদিন হকার সেজে, বিভিন্ন কৌশলে অনুসন্ধান করা হয়। জনকণ্ঠের অনুসন্ধানে গুলিস্তানের অলিগলিতে গড়ে ওঠা প্রায় ১৫টি ইউনিটের নেতা, হকার নেতা, থানা ও ট্রাফিক পুলিশসহ লাইনম্যানদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ওখানকার ফুটপাত থেকে দৈনিক তোলা প্রায় ৩০ লাখ টাকার মধ্যে অর্ধেক পায় পুলিশ। বাকি অর্ধেক পান স্থানীয় নেতা, লাইনম্যান ও সিটি কপোরেশনের মাস্টার রোলে চাকরি করা কয়েকজন সার্ভেয়ার ও বিদ্যুতের দেখভালের দায়িত্বে থাকা স্টাফরা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ওই এলাকার সড়কগুলো লাল, হলুদ ও সবুজ জোনে চিহ্নিত করে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করলেও হকাররা ফের সড়কে বসছেন। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক কয়েকজন নেতা, লাইনম্যান ও অসাধু কতিপয় পুলিশ সদস্যকে ম্যানেজ করেই রেড জোনে বসছেন হকাররা। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, খদ্দর মার্কেটের কর্ণার থেকে নবাবপুর/হানিফ ফ্লাইওভার ব্রিজ পর্যন্ত গুলিস্তান ফুটপাতে প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এক শিফট, আর বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত আরেক শিফটে দোকান বসানো হয়। ফুটপাতের ওপর চৌকি বসানো হকারদের কাছ থেকে প্রতি হাত কিংবা ফুট অনুযায়ী চাঁদা তোলা হয়। এক হাত লম্বা চৌকির জন্য ১০০ টাকা। আর মূল সড়কের পাশে ছোট ছোট পসরা সাজিয়ে বসা ভাসমান হকারের কাছ থেকে গড়ে ১০০ টাকা করে তোলা হয়। মূলত বিকেল বেলা চাঁদার টাকা তোলে লাইনম্যানরা। ওই সব এলাকায় বেশ কয়েকদিন ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

দেখা যায়, খদ্দর মার্কেট থেকে পার্টি অফিসের পশ্চিম কর্ণার পর্যন্ত ফুটপাথের হকারদের কাছ থেকে চাঁদা তোলে একজন লাইনম্যান। রমনা ভবনের পশ্চিম পাশ, পার্টি অফিসের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশ থেকে গোলাপ শাহ মাজার পর্যন্ত চাঁদা তোলে চারজন। তাদের তোলা চাঁদার টাকা প্রতিদিন রাতে বুঝে নেন ওখানকার বেলপট্টি ২নং ইউনিটের এক নেতা। 

হকার সেজে এই পাঁচজন লাইনম্যানের কাছে গেলে তারা বলেন, সমস্যা নেই, আপনারে একটা জায়গায় বসাইয়া দিমুনি। সড়কে ছোট পসরার দোকান বসালে ১০০ টাকা করে দিতে হবে। অগ্রিম দিতে হবে ১০ হাজার টাকা। আর মূল ফুটপাতে বসতে চাইলে আগে পজিশন কিনে নিতে হবে। ৩/৪ হাতের একটা পজিশন কিনতে ৪/৫ লাখ টাকা লাগবে।’ 

এখন যারা ফুটপাথে আছেন তারা কেউ ১ বছরের চুক্তিতে, কেউ আরও বেশি সময়ের চুক্তিতে কিনেছেন। তবে তাদেরও চাঁদা দিতে হয়। অভিযান চালালেও তাদের উচ্ছেদ করা হয় না। দোকান বসানোর বিষয়ে বেলপট্টি ২নং ইউনিটের নেতার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা ওই নেতার কাছে নিয়ে যেতে রাজি হননি। তারা সবাই বলেন, আমরাই সব। ওনাকে শুধু রাতে সব টাকা বুঝিয়ে দেয়া হয়। 

হল মার্কেটের সামনের ফুটপাথ তো দখলেই, সঙ্গে পুরো রাস্তায়ই হকারদের দখলে চলে গেছে। দুই পাশের রাস্তা দিয়ে পথচারীদের হাঁটা দায়। ফলের দোকান, জুতা, মানিব্যাগ, বেল্টসহ হরেক রকমের পসরার ভ্রাম্যমান দোকানে ঠাসা দুই রাস্তা। রাস্তা দুটিতে চার স্তরে দোকান বসানো হয়েছে। বাদ যায়নি ডিভাইডারও। পায়ে হেঁটে হল মার্কেটের এক মিনিটের সীমানা অতিক্রম করতে ৫/৬ মিনিট লেগে যায়। ওখানকার তিনজন লাইনম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা ২০নং ওয়ার্ড যুবলীগের এক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। সদরঘাট যেতে ঢাকা ও গুলিস্তান ট্রেড সেন্টারের ভেতরের দোকান ঘেঁষা ফুটপাত ও মূল সড়কও হকারদের দখলে। 

ফুলবাড়িয়া সড়কের ব্যস্ত এই সড়কটির একটি অংশ লেগুনা ও গাজীপুরগামী বিভিন্ন পরিবহনের দখলে। ওখানে লেগুনা রাখতে দৈনিক ২৫০ টাকা করে দিতে হয় কয়েকজনকে। ট্রেড সেন্টারের বিপরীত পাশের ফুলবাড়িয়া সড়কের হকারদের কাছ থেকে ৬ জন লাইনম্যান চাঁদা তোলে ওখানকার একটি ক্লাবের নামে। 

ওসমানী উদ্যানের পূর্ব পাশের ফুটপাথ, দক্ষিণ পাশ থেকে টিএন্ডটি পর্যন্ত চাঁদা তোলে পাঁচজন। নগর ভবন ও পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের বিপরীত পাশের ওসমানী উদ্যান সংলগ্ন বসা পুরান মোবাইলের দোকান, বেল্ট, মানিব্যাগের দোকান থেকে চাঁদা তোলে মামা-ভাগিনাসহ ৬ জন লাইনম্যান। ফুলবাড়িয়ায় হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের জুতা পট্টির তিনজন, পূর্ব পাশে কাপ্তান বাজার থেকে সুন্দরবন স্কয়ার পর্যন্ত চাঁদা তোলে চারজন। পোয়া মার্কেটের সামনের চাঁদা নেয় দুজন লাইনম্যান। কাপ্তান বাজার সংলগ্ন ফ্লাইওভারের নিচে মুরগি পট্টি থেকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের একজন প্রভাবশালী নেতার ছেলে মাসে ১ লাখ টাকা চাঁদা নেয়। 

আহাদ পুলিশ বক্সের সামনে থেকে পাতাল মার্কেট পর্যন্ত চাঁদা তোলে শালা-দুলাভাই। ভাসানী স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশ থেকে রাজধানী হোটেল পর্যন্ত চারজন, ওয়ারী সিলভারডেল প্রিপারেটরী এ্যান্ড গার্লস হাই স্কুলের সামনের ৫০ জন হকারের কাছ থেকে চাঁদা তোলে এক নারী ও স্কুলের একজন দারোয়ান। তবে এর ভাগ পায় স্কুল কমিটির কয়েকজন। 

ফুলবাড়িয়া থেকে বংশাল পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে হকারদের সংখ্যা হাতেগোনা হলেও সদরঘাটগামী মানুষের ওখান দিয়ে হাঁটা বড়ই দায়। কেননা, রাস্তার দুই পাশে পাইপ, স্যানিটারী, টিউবওয়েল, বয়লার, সিরামিকের ৫ হাজার দোকান রয়েছে। এসব দোকানে পণ্য ক্রয় করতে আসা ক্রেতা ফুটপাত ও মূল সড়ক দখল করে ভ্যান, কাভার্ডভ্যানে মালামাল বোঝাই করছেন। ট্রাফিক পুলিশ ওখানকার যানজট এড়াতে ও ফুটপাত উন্মুক্ত রাখতে রাত ৯টার পর থেকে ট্রাকসহ অন্যান্য গাড়ি লোড, আনলোড করার সময়সীমা বেধে দিলেও তা মানছে না ব্যবসায়ীরা। এসব প্রশাসনের চোখের সামনেই ঘটছে। 
পল্টন ও মতিঝিল এলাকা॥ পল্টন এলাকার বায়তুল মোকাররমের স্বর্ণের দোকানের পশ্চিম পাশের হকারদের কাছ থেকে চাঁদা নেয় তিনজন। বাসস অফিসের সামনে চাঁদা তোলে আরেক লাইনম্যান। পল্টনের সব ও গুলিস্তানের (পল্টন থানাধীন) বেশ কয়েকটি ফুটপাত থেকে লাইনম্যানরা যে চাঁদা তোলে, তা জমা দেয়া হয় একজনের কাছে। ওই লাইনম্যান ও তার ছেলে চাঁদার টাকা ভাগ করে বিভিন্ন সেক্টরে দেয়। বাবা-ছেলে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা ও পল্টন থানা পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করে। তাদের হাত দিয়েই পুলিশের হাতে পৌঁছে চাঁদাবাজির বিশাল একটি অংক। মূলত গুলিস্তান ও পল্টন থানাথীন ফুটপাত চালায় ওই লাইনম্যানসহ আর দুজন। এই তিনজন নিজেদের দলীয় নেতা পরিচয় দিয়ে চাঁদা তোলে এবং চাঁদার অর্ধেক সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের কর্মকর্তাদের হাতে পৌঁছে দেয়। 
পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ সালাউদ্দিন মিয়া বলেন, ওই এলাকার ফুটপাত থেকে যেসকল লাইনম্যান চাঁদা তোলে, আমরা সব সময় তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে থাকি। আমাদের থানার কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের সামনের ফুটপাথের চাঁদা নেয় এক লাইনম্যান, তার ছেলেসহ ছয়জন। চাঁদার এই ভাগ স্কুল কমিটির অনেকে পায়। শাপলা চত্বর কেন্দ্রিক ৫ শতাধিক হকারের কাছ থেকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশের মাছের দোকানিদের কাছ থেকে ৫০০ থেকে ১২০০ টাকা করে চাঁদা তোলে দুজন। সোনালী ও রুপালী ব্যাংকের সামনের ফুটপাথ থেকে নেয় একজন লাইনম্যান ও তার ছেলে। মতিঝিল ফুটওভার ব্রিজ ও আলী-কো অফিসের সামনে থেকে বক চত্বর পর্যন্ত চাঁদা নেয় তিনজন। 

গুলিস্তান, পল্টন ও মতিঝিলের এসকল লাইনম্যানের অধিকাংশই মামলার আসামি। ২০১৬ সালে হকার উচ্ছেদ অভিযানে গিয়ে হামলার শিকার হন দক্ষিণ সিটি কপোরেশনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা, ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ। এ ঘটনায় পল্টন, মতিঝিল ও শাহবাগ থানায় দায়ের করা মামলার আসামি উল্লিখিত লাইনম্যানের অনেকে। এদের অনেকে জেলও খেটেছেন। জামিনে বেরিয়ে স্থানীয় নেতাদের ছত্রছায়ায় ফের ফুটপাতের চাঁদাবাজি করছে। 
শুধু পুলিশ, স্থানীয় নেতা ও লাইনম্যানরাই নয়; এসব এলাকার ফুটপাত থেকে নিয়মিত চাঁদার ভাগ পায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কপোরেশনের বেশ কয়েকজন স্টাফও। সার্ভেয়ার বিভাগের কয়েকজন স্টাফ নিয়মতি চাঁদা নেয়। তবে তারা হকারদের কাছ থেকে নয়, লাইনম্যানদের কাছ থেকে দৈনিক ও সপ্তাহিক হারে এই চাঁদা নিয়ে থাকে। গুলিস্তান ও পল্টন এলাকার সিটি কপোরেশনের বিদ্যুতের খুঁটি থেকে হকারদের বিদ্যুতের লাইন দেয়া বাবদ মোটা অংকের টাকা নেয় বিদ্যুৎ দেখভালের দায়িত্বে থাকা একজন স্টাফ। 

দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার ৭৫টি ওয়ার্ডের ফুটপাথে বসা হকারদের একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে অন্যান্য দেশের হকারদের মত নতুন উদ্যোগ হাতে নিয়েছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ৩ ক্যাটাগরিতে যথা লাল, হলুদ ও সবুজ ক্যাটাগরিতে সড়কগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে যেসব সড়ক লাল এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেসব সড়কে কিংবা ফুটপাথে কোন হকার বসতে দেয়া হবে না। হলুদ চিহ্নিত সড়কে ফুটপাথের প্রশস্ততা অনুযায়ী আংশিক জায়গায় হকার বসতে দেয়া হবে। সেটা শুক্রবার বসবে। তবে ভিআইপি মুভমেন্টের সময় বসতে দেয়া হবে না। আর সবুজ চিহ্নিত সড়কে হকাররা সব সময়ই বসতে পারবে। 

ফজলুর রহমান

×